ভবঘুরেকথা
ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : সাত

আগে থেকেই একটা কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল, মঞ্চের কাছাকাছি যেতে উত্তেজনাটাও টের পাওয়া গেল। রাত জুড়ে লালন গান হবে পদ্মা পাড়ে। সেই উপলক্ষে পাড় ঘেঁষে বিশাল জায়গা জুড়ে টানানো হয়েছে শামিয়ানা। সারি সারি চেয়ার পাতা হয়েছে তার তলায়। ফাল্গুনী বাতাসে তড়তড় করে উড়ছে শামিয়ানার চারধারে ঝুলে থাকা রঙবেরঙের নকশাকাটা কাপড়।

একপাশে বড়সড় একটা মঞ্চ। মঞ্চ-শামিয়ানা ছাড়িয়ে অনেকটা ফাঁকা জায়গা রেখে নদীর সমান্তরালে যে রাস্তাটা গিয়েছে গ্রামের ভেতর দিয়ে। সেটাকে ঘিরে বসেছে বিশাল মেলা। এক পাশে নাগরদোলা অন্যপাশে খেলনাপাতি থেকে খাওয়াদাওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় কতোকিছুর যে দোকান বসেছে তা বলে শেষ করার উপায় নেই। খুঁটিতে খুঁটিতে ঝুলে থাকা ডেকোরেটারের বাতি আলোকিত করেছে রাতের পরিবেশ।

বিক্রমপুরের শ্রীনগর ছাড়িয়েও আরো বেশ কিছুটা এগিয়ে নাম ভুলে যাওয়া এক মাজারকে ঘিরে চলছিল তিনদিনের ওরশ। তারই শেষদিন সন্ধ্যা থেকে হবে লালনের গান আর শেষরাতে কবিগান। এমনি কথা শুনে আমিও উপস্থিত।

সন্ধ্যা হতে চললো এখনো কেনো গান শুরু হচ্ছে না সেটা ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছি মাজারের দিকে। সেসময় শিল্পী মামুন নদীয়া বেশ নাম করেছিল। লালন শিল্পী বলতেই এক নামে লোকে তাকে চেনে। তার আগমনে কমিটির লোকজন বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। তাকে বসানো হয়েছে মাজারের প্রধান খাদেমের কাঠের ঘরখানায়।

রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। এরই ফাঁকে মিষ্টি কুমড়ার তরকারির সাথে গরম গরম ভাতের সেবা চলে আসলো। মামুন নদীয়া আমাকে হাত ধরে উনার পাশে বসালেন। ঘটনা অন্যকিছুই না; এই ঘরে একমাত্র আমিই উনার কথা শুনছিলাম; বাকিরা বাকিদের কথা উনাকে শুনাচ্ছিলেন।

ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা মৌমাছির ধর্ম। তার জন্মই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা। তেমনি সাধনায় গুটিকতক মানুষই মৌমাছির মতো সাধনাকে জীবনের ব্রত করে তুলতে পারে। আর তারাই এগিয়ে যায় সাধনায়। আবার একটা দলের সকল মৌমাছিই যে কেবল মধু সংগ্রহ করে তাও কিন্তু নয়।

দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক কথা শুনতে শুনতে সম্ভবত উনি ক্লান্ত; তাই গলার স্বর নামিয়ে আমার সাথে কিছু তত্ত্ব আলোচনা করে ফেললেন।

যদিও তখনো সেসব কিছুই বোঝার কোনো ক্ষমতা আমার জন্মায়নি; সেটা তিনি ভালোই বুঝতে পারছিলেন। তাও বলে চলছিলেন। আজ এতদিন পরে ভাবলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়; এই যে আমরা সাধনার রহস্য জানার জন্য অল্পতেই অস্থির হয়ে উঠি। বুঝতে চাই না এই রহস্যভেদ বুঝতে হলে নিজেকে তৈরি না করলে তা বোঝা সম্ভব নয়।

একটা সহজ বিষয় প্রথমে সহজে বুঝে নিতে হবে যে, এতকাল ধরে প্রকাশ্যে প্রচলিত থাকার পরও যে মতবাদ তার রহস্য গুপ্ত রাখতে পেরেছে; সেই রহস্য যে কোন যদু-মধু-রাম-সাম চাইলেই বুঝে ফেলবে তা তো নয়। গণিত-বিজ্ঞান-দর্শনের মতোই সকল জ্ঞানকে ধারণ করতে হলে যেমন একটা দীর্ঘ সময় দিতে হয়, কঠিন অধ্যবসায় করতে হয়। তেমনি সাধন রহস্য বুঝতে হলেও এর ব্যত্যয় ঘটালে চলবে না। রীতিমত তপস্যা করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।

আবার সাধন রহস্য বুঝতে শুরু করলেই যে সকলে তা ধারণ করতে পারে তাও নয়। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা শিখতে পারলেই যেমন সকল কীটপতঙ্গই মৌমাছি হয়ে উঠে না। তেমনি জানতে শুরু করলেই কেউ সাধক হয়ে উঠে না। সাধক হতে হলে দীর্ঘ পথ পারি দিতে হয়।

মৌমাছির ধর্ম যেমন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা তেমনি সাধকের ধর্ম হলো ফুলরূপী ব্রহ্মাণ্ড থেকে সঠিক জ্ঞানের মধু আহরণ করা। যে সাধক এমনটা করতে পারে সেই সাধনায় সিদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আর যিনি নির্বাণ চান তাকে হাঁটতে হয় আরো অনেক অনেক দূরের পথ।

ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা মৌমাছির ধর্ম। তার জন্মই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা। তেমনি সাধনায় গুটিকতক মানুষই মৌমাছির মতো সাধনাকে জীবনের ব্রত করে তুলতে পারে। আর তারাই এগিয়ে যায় সাধনায়। আবার একটা দলের সকল মৌমাছিই যে কেবল মধু সংগ্রহ করে তাও কিন্তু নয়।

তারা একটা সুশৃঙ্খল নেতৃত্বে নির্দিষ্ট অনুশাসন মেনে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলে। সকলের কাজও এক নয়। কেউ হয়তো পথ দেখায়, কেউ ঘর বাঁধে, কেউ সুশৃঙ্খল করে সাজায়। আরো নানান ভাবে ভাগ করে তারা পুরো কাজটি দিনের পর দিন করে চলে। সকলের সমন্বয়ে একটি কাজকে পূর্ণরূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়। সাধককেও অনুরূপভাবেই এগিয়ে যেতে হয় সাধনার পথে।

নিজেকে তৈরি করতে করতে যেমন এগিয়ে যেতে হয় তেমনি কাজ করে যেতে হয় সামগ্রিক ভাবনা নিয়ে। নিজেকে জানার এই সাধনা প্রকৃতপক্ষে নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে এই অপার ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ হিসেবে নিজের প্রকৃত কর্ম কি তারই অনুসন্ধান করে।

নিজেকে তৈরি করতে যেয়ে সাধক যখন নিজেতে মত্ত্ব হয়ে যায় অর্থাৎ সামগ্রিক কল্যাণের ভাবনায় না গিয়ে নিজের কল্যাণে মত্ত্ব হয় তখনই সাধক বিপথে চলে যায়। যাক সে কথা। সেবা নেয়ার পর শুনলাম কুষ্টিয়া থেকে আরেকটা বড় দল এসেছে। কথাটা শুনেই মন চনমন করে উঠলো। তৎক্ষণাৎ তাদের সন্ধানে বের হয়ে গেলাম।

যে বন্ধুটির আমন্ত্রণে এসেছি শেষে তার স্মরণাপন্ন হওয়ার পর কুষ্টিয়া থেকে আগত দলটিকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো। বন্ধুটি আমাকে শিল্পীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। এর আগেও বেশকিছু বাউলশিল্পীর সাথেই পরিচয় হওয়ার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে। আলাপচারিতাও হয়েছে।

এই নিয়ে এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত কথা চালাচালি হচ্ছে; সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি ভরসা দিয়ে চলে গেলেন বটে। কিন্তু খেয়াল করলাম বেশকিছু ছেলেপিলে আমাদেরকে গোল করে ঘিরে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত আমাদেরকে স্থানীয় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা দেয়া হলো।

কিন্তু এই দলটির সাথে পরিচয় হওয়ার পরই মনে হলো সত্যিকারর্থে বাউলকে চিনতে শুরু করলাম। শিল্পী আর সাধকশিল্পীর মাঝে যে ব্যবধান তার আঁচ পেতে শুরু করলাম।

এই প্রথম এমন মানুষদের সাথে এতো কাছ থেকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম যাদের মাঝে অহং বিষয়টা নেই। আর এই তালিকায় প্রথম যে মানুষটির সাথে পরিচয় হলো উনার নাম রব ফকির। দোতারাটা আরেকজনের হাতে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি মানুষের স্বাদ পেলাম-জীবনের স্বাদ নিলাম। অহং এর আলিঙ্গন আর বিনয়ের আলিঙ্গনের মাঝে যে পার্থক্য তা যেন স্পষ্ট হলো।

নীল-সাদা শামিয়ানা ঘেরা ছোট একটা জায়গায় চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসেছিলেন তারা। সেখানে আমার জন্যও চেয়ারের ব্যবস্থা করা হলো। মঞ্চে উঠার জন্য সকলে অপেক্ষা করছেন কিন্তু কি যেন একটা ঝামেলা হচ্ছে। মান্নান ভাই জানালো মাদ্রাসার লোকজন ঝামেলা করতেছে লালনের গান গাইতে দিবে না।

আমি তো অবাক, লালনের গান গাইতে দিবে না! রব ফকির বললো, দাদা আপনি এইসব ভাইবেন না আপনি চা খান। গরম গরম চা পান করতে করতে ভাবছি ঘটনা কি? এই আয়োজন তো করেছেন স্থানীয় রাজনৈতিক লোকজনই। তাহলে সমস্যা কি? তারাই তো ক্ষমতায়।

ওরশে লালন গানের জন্য একটি রাত বরাদ্ধ করেছেন স্বয়ং স্থানীয় ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা। আর সেই ছাত্রনেতার পেছনে আছেন এমপি-মন্ত্রী-পুলিশ সবাই। তবে কি সবাই মিলেও মাদ্রাসার লোকজনকে সামাল দিতে পারছেন না?

সেই ছাত্রদল নেতা লালনের বিশাল ভক্ত। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে সব আয়োজন করেছেন, সবই ঠিক ছিল। কিন্তু লালনের গান হবে শুনেই মাদ্রাসার লোকজন এক হতে শুরু করেছে। কুষ্টিয়া থেকে যারা এসেছে তাদের কিছুতেই গাইতে দিবে না।

এই নিয়ে এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত কথা চালাচালি হচ্ছে; সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি ভরসা দিয়ে চলে গেলেন বটে। কিন্তু খেয়াল করলাম বেশকিছু ছেলেপিলে আমাদেরকে গোল করে ঘিরে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত আমাদেরকে স্থানীয় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা দেয়া হলো।

মঞ্চে স্থানীয় শিল্পীরা গাইছেন। আইয়ুব বাচ্চুর গান গাইছে কেউ, কেউ একটা আসিফের গান গাইলো, তারপরই হয়তো একটা কিশোরী এসে গেয়ে গেলো রবীন্দ্রসংগীত। এভাবে যার যা খুশি গাইছে। আমি রব ফকিরকে বল্লাম, দাদা বসেন আমি একটু দেখে আসি। রব ফকির বললো, দাদা বেশি দূরে যাবেন না ঘটনা সুবিধার না।

প্যান্ডেল ঘেরা জায়গাটা থেকে বেড়িয়ে মেলা পেরিয়ে মঞ্চের দিকে গিয়ে দেখি এদিকটায় প্রচুর মাদ্রাসার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা বসে গান শুনছে। মেলা থেকে এটা সেটা কিনে খাচ্ছে। মাজারের দিকটায় যেয়ে বুঝলাম ভিভিআইপিরা দফায় দফায় মিটিং করছেন।

উৎসুক মানুষ সেখানে ভিড় করে আছে। বন্ধুটিকেও ঐখানে পেয়ে গেলাম। সে জানালো সব ঠিক হয়ে যাবে। কথাবার্তা হচ্ছে। এশার নামাজের পরই গান শুরু হবে।

এই অংশটায় আরেকটা মাজার। দোচালা ছাদের বিশাল খোলা মাজারটার পাশেই নির্মাণাধীন একটা দোতলা কাঠেরবাড়ি। বাড়িটার একতলায় কোনো দরজা-জানালা নাই। কাজ চলছে দেখেই বোঝা যায়। এই দিকটায় বিদ্যুৎ নেই। মাজারের সামনে একটা উঁচু বেদির উপর গনগনে আগুনের একটা হ্যাজাক জ্বলছে।

এক সময় তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়ে মঞ্চে ঘোষণা আসলো এখন নামাজের বিরতি। বিরতির পর লালনের গান হবে। গান গাইবেন কুষ্টিয়া থেকে আগত মামুন নদীয়া ও বিশিষ্ট লালন শিল্পীরা। আমি ফিরে আসলাম রব ফকিরদের কাছে।

এসে জানলাম যন্ত্রীরা মঞ্চে যাবে আগে; শিল্পীরা যাবে সব ঠিকঠাক হলে। আবার বসে পরলাম আড্ডায়। একসময় ডাক আসলো। দলটার সাথে আমিও গেলাম। এই অল্পকিছু সময়ের মধ্যে মানুষগুলো কেমন আপন হয়ে গেলো। আপন মানুষ আসলে আপনই থাকে জন্মজন্মান্তর ধরে; কেবল দর্শনের অপেক্ষা মাত্র।

প্রথমে কিছুসময় আলোচনা পর্ব চললো। রাজনৈতিক কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর শিল্পীরা মঞ্চে উঠে বসলেন। আমি খুব কাছাকাছিই আছি। মামুন নদীয়া প্রথমেই একটা সাঁইজির দৈন্য গান ধরলেন। কিন্তু গান শেষ হওয়ার আগেই শত শত মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিক্ষকরা একযোগে হুংকার করতে শুরু করলো।

ছাত্রদলের ক্ষমতাশালী উদ্যমী ছেলেগুলোকে অসহায় লাগতে লাগলো। শত শত রাজনৈতিক কর্মীও তাদের আটকাতে পারছে না। এসময় পুলিশের একটা দল শিল্পীদের ঘিরে ফেলে বললো আপনারা আপনাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের সাথে চলেন। রব ফকির অস্থির চোখে আমাকে খুঁজছিলেন।

আমাকে পেয়ে বললো, দাদা আপনিও আমাদের সাথে চলেন। আমরা বড় বড় পা ফেলে পুলিশের বেরিকেডের ভেতরে দিয়ে মেলার বিপরীত দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কমিটির কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। চিৎকার-চেঁচামেচি-হুংকার-চেয়ার ভাঙ্গাভাঙ্গি পেছনে ফেলে বেশ কিছুটা এগিয়ে মাজারের পেছন দিকে গাছপালা ঘেরা একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছালাম।

এই অংশটায় আরেকটা মাজার। দোচালা ছাদের বিশাল খোলা মাজারটার পাশেই নির্মাণাধীন একটা দোতলা কাঠেরবাড়ি। বাড়িটার একতলায় কোনো দরজা-জানালা নাই। কাজ চলছে দেখেই বোঝা যায়। এই দিকটায় বিদ্যুৎ নেই। মাজারের সামনে একটা উঁচু বেদির উপর গনগনে আগুনের একটা হ্যাজাক জ্বলছে।

আমাদেরকে নি:শব্দে সেই দোতালা বাড়িটার উপরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাড়িটা পুরোপুরি তৈরি না হলেও উপরের ঘরটি বেশ পরিপাটি। প্রায় ১০ ফুট বাই ২০ ফুটের ঘরটায় উপরে উঠার সরু কাঠের সিঁড়ির অংশটা ছাড়া বাকি অংশটায় কাঁথা দিয়ে শোবার আয়োজন করা আছে।

মাজারের লোকজন বললো পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে আপনাদের নিয়ে যাব। এইদিকটায় কেউ আসবে না। আপনারও বের হবেন না। আপনাদের যা যা লাগবে তার ব্যবস্থা করতেছি। তবে একটু সময় লাগবে কারণ এখানে যে আপনাদের রাখা হয়েছে সেটা জানানো যাবে না কাউকে।

মঞ্চে গান বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এতো দূর থেকেও নানাবিধ উত্তেজনা আমরা টের পাচ্ছি। এক জগ পানি, কয়েকটা মোমবাতি, ম্যাচ বাক্স আর দুইখানা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে গেল একজন। আমরা গোল হয়ে চুপচাপ বসে আছি। মোমবাতি জ্বালাবো কিনা তারও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

অনেকটা সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে সকলে মিলে ঘরটার কাঠের পাটাতনের উপর বিছানো কাঁথা-পাঁটি সব তুলে পরিস্কার করে ঠিকঠাক করে গোল করে এমন ভাবে বিছালাম যাতে মাঝের অংশটা ফাঁকা থাকে। সেখানে মোম জ্বালানো হবে। ঘরে বিশেষ কিছু নেই যার উপরে মোম জ্বালানো যায়।

দূরে কারো পায়ের শব্দ পেলেই শক্ত হয়ে উঠছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। উত্তেজনায় সময় কাটছে না কিছুতেই। সবাই প্রায় নি:শ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। একসময় নিরবতা ভেঙ্গে একটা পায়ের শব্দ উঠে এলো দোতলা পর্যন্ত। এসে জানালো ভয়ের কিছু নাই। মঞ্চে আর লালন গান হবে না এই কথা বলার পর উত্তেজনা কিছুটা কমেছে।

তাই আপাতত ভয়ের কিছু নেই। তিনি জানালা খুলে দিলেন। বললেন আপনারা আরাম করেন। খাবার-দাবার দিতে একটু দেরি হবে; ঝামেলা শেষ হয় নাই। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বললো, দাদা এইখানে কি আমরা গান করতে পারি? ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, এই অবস্থায় আপনারা গান বাজনা করবেন?

আপনারা বুঝতে পারছেন বাইরে কি হচ্ছে? রব ফকির বললো, আমরা ফকির মানুষ গান না করে কি করবো? ভদ্রলোক কাকে জানি ফোন করলো। একটু পরেই আরো দুই তিনজন আসলো। নিজেদেরে মধ্যে ফিসফিস করে কি সব বলে তারপর সম্মতি দিয়ে বললো, ঠিক আছে অসুবিধা নাই আপনারা গান বাজনা করেন; তবে বেশি জোরে না করাই ভালো।

মোমবাতি জ্বালিয়ে বসেন। আমি আরো মোম পাঠাচ্ছি। নিচে তো কোনো দরজা নাই যে বন্ধ থাকবে। তাই কেউ আসতে চাইলে আগে বলবেন আমার সাথে যাতে কথা বলে আসে। আর আমার লোক আসলে আগে আমার নাম বলবে। এছাড়া কাউকে এখানে বসতে দিবেন না। অবশ্য আমাদের লোক আছে সামনে তাদের টপকে কেউ আসতে পারবে না।

তখন দেশে জঙ্গীবাদ সেভাবে প্রকাশ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেনি তাই হয়তো আমরা সেই ঘটনাটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাই ভাবছিলাম। শংঙ্কা থাকলেও ততটা উৎকণ্ঠা হয়তো ছিল না। আজ এই কাহিনী ঘটলা হয়তো ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতো।

অনেকটা সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে সকলে মিলে ঘরটার কাঠের পাটাতনের উপর বিছানো কাঁথা-পাঁটি সব তুলে পরিস্কার করে ঠিকঠাক করে গোল করে এমন ভাবে বিছালাম যাতে মাঝের অংশটা ফাঁকা থাকে। সেখানে মোম জ্বালানো হবে। ঘরে বিশেষ কিছু নেই যার উপরে মোম জ্বালানো যায়।

নয়তো কাঁথায় আগুন লেগে আরো বড় ঝামেলা তৈরি হতে পারে। যাই হোক আমরা মাঝের পাটাতনের উপর মোম জ্বালিয়ে বসে পরলাম। শুরু হলো গান। পালা করে রব ফকির, মান্নান ভাই, আনু কাকা গান শুনাতে লাগলেন। কি কি গান শুনিয়েছিলেন সব গানের কথা আজ আর মনে নেই।

তবে আমি লালন সাঁইজির একটা কালাম শোনানোর জন্য বিশেষ অনুরোধ করেছিলাম। রব ফকির আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, একথা দাদা না বললেও হইতো। আমি এখন এই পদটাই ধরতাম। বলেই শুরু করলেন-

জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা,
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবি দেখি তা না-না-না।।

আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে,
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।।

ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি
এক জলেই সব হয় গো শুচি,
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাকেও ছাড়বে না।।

গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়।,
লালন বলে জাত কারে কয়
এ ভ্রম তো গেল না।।

কেনো সাঁইজির এই পদটা আমি দীর্ঘদিন মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম আমি নিজেরও জানি না। ‘জাত’ শব্দটা কবে প্রথম শুনেছিলাম সেটা হয়তো আজ আর মনে করা সম্ভব না। তবে মনে পরে সেই শৈশবে একদিন বাড়ি ফিরে দেখি মাথায় বিশাল সাদা রঙের পাগড়ী, আলখাল্লা পরা শক্ত পোক্ত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ঘরে বসে আছেন। শুনলাম তিনি আমার দাদা। দাদাকে আমি এর আগে কখনো দেখিনি।

কোনো অজ্ঞাত কারণে আমার জ্ঞান হওয়ার পর দাদা আমাদের বাসায় এর আগে কখনো আসেন নি। আমারো দাদা বাড়ি যাওয়া হয় নি। মাথা নিচু করে দাদার কাছে গেলাম। দাদা কাছে টেনে নিয়ে বললেন, এই সন্ধ্যার সময় কোথা থেকে আসলা? আমি মৃদু কণ্ঠে চকচকে চোখে বল্লাম, লক্ষ্মীপুঁজা দেখতে গিয়েছিলাম।

দাদার চোখেমুখে কাঠিন্য দেখা দিলো। কঠিন কণ্ঠে আম্মাকে ডেকে বললেন, “বৌমা ওকে এখনি গরম পানি দিয়া গোসল করাও।” আমি সেইদিন জানলাম আমরা মুসলমান আর আমার যে বন্ধুটির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম ওরা হিন্দু।

এমনি একদিন আমরা চুপচুপ করে লুকিয়ে ধুকধুক মনে ভাবছি কখন ধরা পরে যাই। ঠিক তখনি একটা তীব্র চিৎকার পুরো পাড়াকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। আমরা ছুটে পাড়ার মাঝের রাস্তায় আসতেই দেখি পাঁচতলা বিশাল হলুদ রঙের বাড়িটার ঠিক সামনে সদ্য কিছু একটা পরেছে। একটা বিশাল কাপড় বাতাসে উড়ছে।

তাদের জাত আলাদা, তাদের ধর্ম আলাদা। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসছিল। এসব কি বলছে লোকটা? আমরা তো একসাথেই খেলি, একই স্কুলে পড়ি। কই এর আগে এসব কথা তো এইভাবে আমাকে কেউ কোনো দিন বলেনি!

আড়ালে ডেকে মা বলেছিল দাদা আসলে তার সামনে সেসব কথা না বলতে। তাহলেই সমস্যা নেই। দাদা চলে যাওয়ার পর ঘরের পরিবেশ আগের মতোই হয়ে গেলো। আগের মতোই দুপুরবেলা সকলে ঘুমিয়ে পরলে লুকিয়ে খেলতে যাওয়া। সবকিছু কি আসলেই আগের মতোই ছিল? সত্যি?

নাকি ‘জাত’ শব্দটা অভিধানে ঢুকে গিয়েছিল? তবে একথা সত্য ‘জাত’ ‘ধর্ম’ এসব শব্দের প্রকৃত মানে আমি কোনোদিনই আলাদা করে বুঝতে পারিনি। তবে বহু বহুবার একথা আমি শুনেছি চারপাশের লোকজনের কাছ থেকে।

নাম না জানা এক বাউলসাধক একবার বলেছিল, বাপ জগতে জাত দুইটাই। একটা হইলো নারী অন্যটা পুরুষ। আর এই পুরুষের মাঝেই নারীর বাস আর নারীর মাঝে পুরুষের। এ বড় আজিব গোলকধাঁধা বাপ। তাই বাপজি জাত নিয়া জাতাজাতি না করে মানুষ চিনতে শেখো। মানুষ রতন চিনতে পারলে সব ভেদ কাটবে।”

জাত নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। আমরা দুপুর হলেই সকলকে ফাঁকি দিয়ে খেলতে চলে যেতাম। খেলার নাম পলান্তিস। শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলে লুকোচুরি। সকলে লুকাবে একজন খুঁজে বের করবে। পাড়ার যতটা অংশে যানবাহন কম চলতো সেই অংশটা জুড়ে খেলা চলতো। এর ওর বাড়ি, সরু গলি, এটা সেটার পেছনে লুকাতাম।

এমনি একদিন আমরা চুপচুপ করে লুকিয়ে ধুকধুক মনে ভাবছি কখন ধরা পরে যাই। ঠিক তখনি একটা তীব্র চিৎকার পুরো পাড়াকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। আমরা ছুটে পাড়ার মাঝের রাস্তায় আসতেই দেখি পাঁচতলা বিশাল হলুদ রঙের বাড়িটার ঠিক সামনে সদ্য কিছু একটা পরেছে। একটা বিশাল কাপড় বাতাসে উড়ছে।

শব্দ শুনে আরো কিছু মানুষও এসেছে। অনেকে দুপুরের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গেছে বলে বকাঝকা করতে করতে আসছে। আমরা তখনো বুঝে উঠতে পারিনি আদৌতে কি ঘটেছে। একজন মহিলা যখন লাশ বলে চিৎকার করে উঠলো তখন আমরা আরেকটু কাছে গিয়ে দেখলাম।

হ্যা সত্যি কথা, একজন মানুষ পরে আছে। নাহ্! একে ঠিক মানুষ বলা যায় না। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শাড়ি পড়া একটা শরীর বললেই বরং ভালো। বিভৎস সেই দৃশ্য।

একজন নারী পাঁচতলার ছাদ থেকে পরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। জীবনের প্রথম মৃত্যু দেখা এভাবে হবে কে জানতো। একটা মানুষ কেনো লাফিয়ে পরেছিল সেই ছাদ থেকে? নাকি কেউ ফেলে দিয়েছিল? পাড়ায় নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। খুন, আত্মহত্যা, পরকীয়া ইত্যাদি নতুন নতুন শব্দগুলো আমাদের অভিধানে যুক্ত হতে শুরু করলো।

ধীরে ধীরে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে দেয়ালের সেই দাগ হালকা হতে থাকলো। আমরাও আবার খেলায় মেতে উঠলাম। হলুদের বদলে সবুজ করা করা হলো বাড়িটার গায়ে। এলো নতুন ভাড়াটিয়া। সকলে সকলের নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। কেবল আমি আজো বুঝলাম না জাত কারে বলে।

বেশ কয়েকদিন পুলিশ জায়গাটা ঘিরে রাখলো। বাসা থেকেও আমাদের কাউকে বের হতে দেয় না। কিছুদিন পর যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলো। তখন এই রাস্তায় গিয়ে দেখেছি সেই পাঁচতলা বাড়িটার চারতলা থেকে দুইতলা পর্যন্ত একটা চার আঙ্গুলের লাইন বাঁকা হয়ে নেমে গেছে।

এ পাশটায় কোনো জানালা বা বারান্দা ছিল না বাড়িটার। হলুদ রঙের মাঝে বেশ বসে যাওয়া চার আগুলের দাগটা দেখলেই মনে হতো মানুষটা শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবার জন্য কিছু একটা ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।

বাড়িটা ততদিনে ভুতুড়ে হয়ে গেছে। ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ছেড়েছে। বাড়িওয়ালার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে দেখেছিলাম মৃত মহিলার দুটি ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে তাদের পিতাও একদিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।

শুধু আমরা অনেক অনেকদিন দুপুরবেলা কোনো রূপ খেলাধুলা না করে সেই বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িটার খোলা ছাদের উপর বসে আঙ্গুলের স্পষ্ট দাগগুলোর দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতাম। কি ভাবতাম কে জানে। তবে সকলের মনে প্রশ্নটা থাকলেও সম্ভবত বাবুই প্রথম প্রশ্নটা করেছিল। আচ্ছা মানুষ মরলে কোথায় যায়?

রাতের আকাশে তারা দেখলে কখনো কখনো মনে হতো, সত্যিই কি মানুষ মারা গেলে তারা হয়ে যায়? আচ্ছা! সব জাতের… সব ধর্মের… মানুষই কি মরে গিয়ে এক আকাশের তারা হয়? বহুবার ভেবেছিলাম দাদাকে এই প্রশ্নটা করবো। কিন্তু দাদার সাথে কখনোই এতোটা সখ্যতা গড়ে উঠেনি যাতে করে এই প্রশ্নটা করা যায়।

ধীরে ধীরে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে দেয়ালের সেই দাগ হালকা হতে থাকলো। আমরাও আবার খেলায় মেতে উঠলাম। হলুদের বদলে সবুজ করা করা হলো বাড়িটার গায়ে। এলো নতুন ভাড়াটিয়া। সকলে সকলের নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। কেবল আমি আজো বুঝলাম না জাত কারে বলে।

মরে গেলে কি সবার জাত-ধর্ম একই হয়ে যায়? নাকি জন্মেরকালে একই থাকে? এইসব খুবই গোলমেলে ব্যাপার। সাধারণ বুদ্ধিতে ধরবে না। সে চেষ্টা করেও আপাতত লাভ নেই। তবে জাত-ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে যে বজ্জাদি চলছে তা তো নতুন কিছু নয়। স্বয়ং লালন সাঁইজিও বলেছেন-

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ
দেখলাম না এ নজরে।।

সুন্নত দিলে কয় মুসলমান
নারীর তবে কী হয় বিধান,
বামুন চিনি পৈতেয় প্রমাণ
বামুনী চিনি কী করে?

কেউ মালা কেউ তজবী গলে
তাই তো রে জাত ভিন্ন বলে,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কারে।।

জগৎ বে’ড়ে জাতের কথা
জাতের গল্প যথা তথা,
লালন বলে জাতের ফাৎনা
ডুবিয়েছি সাধ-বাজারে।।

এইতো সেবার লালনের গান করার অপরাধে রাজবাড়ির পাংশায় মোহম্মদ ফকিরসহ আরো ২৮জন বাউলের চুল-দাঁড়ি কেটে দিলো মৌলবাদী গোষ্ঠী। লালন ভক্তদের মনে আঘাত লাগলো। মোহম্মদ ফকিরের বার্ষিক অনুষ্ঠান সময় পিছিয়ে যখন পুনরায় আয়োজন করা হলো। তখন দলে দলে মানুষের পদচারণায় মুখোর হলো পাংশার চর।

আমাদের কণ্ঠে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বচন থাকলেও বাউলরা ক্ষমা দিয়েই সাধুসঙ্গ শুরু করলো। সুর দিয়েই অসুরকে বদ এই মন্ত্রেই চলে বাউল সাধকরা। জাত নিয়ে বাউলদের মাতামাতি নেই। বাউল-ফকির-সাধকরা মেতে থাকে প্রেমে। মোহিত হয়ে থাকে গানে-বাজনায় সুরে-তালে। এতেই সুখ, এতেই সাধনা। কার সাথে সংর্ঘষে যাবে?

তবে কি বাউলরা চিরকালই মৌলাবাদের রোষানলে থাকবে? বাউলরা কি প্রতিবাদ করবে? প্রতিবাদ করা কি বাউলে ধর্ম? বাউল মতে কি প্রতিবাদ আছে? সেসব অনেক কথা, অন্য একদিন হয়তো এ নিয়েও কথা হবে। তবে মজনু শাহ্’র কথা বলাই যায়। যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৭৬০ সালে ফকির-সন্ন্যাসীদের এক করেন।

চার দশকের বেশি সময়ধরে চলা এই আন্দোলন ইতিহাসে ‘ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। তবে সব সাধনা যেমন এক না, তেমনি সকল সাধনার প্রতিবাদের ভাষাও এক না। লালন সাধকরা প্রেম দিয়েই ব্রহ্মাণ্ড জয় করতে চায়। চায় প্রেমময় একটা ব্রহ্মাণ্ড।

এই যে এই নিগ্রহ, এই যে অপমান, এই যে সামাজিক বঞ্চনা এতোকিছুর পরও মোহম্মদ ফকির বলেছিল, “আমরা সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছি… ক্ষমাই পরম ধর্ম…।” সেই সময় তার কথা শুনে মনে হয়েছিল কেন ক্ষমা করতে হবে সকলকে?

কিন্তু এখন মনে হয় অন্যকে ক্ষমা করতে না পারলে মনের ভেতরে যে বিষ জমা হয় সেটা অন্যের কি ক্ষতি হয় তা জানি না। তবে নিজের যে চরম ক্ষতি হয় সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর সাধক অন্যের তো দূরের কথা নিজের ক্ষতিতেও যেতে চায় না। সাধকের একই কথা-

ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়।
আকাশ-পাতাল খুঁজিস যারে এই দেহে সে রয়।।

শুনতে পাই চার কারের আগে
আশ্রয় করেছিল রাগে,
সে বেশে অটলরূপ ঝেঁপে
মানুষ-লীলা জগতে দেখায়।।

লামে আলেফ লুকায় যেমন
মানুষে সাই আছে তেমন,
তা নইলে কি সব নূরীতন
আদম-তনে সেজদা জানায়।।

আহাতে আহাম্মদ হ’ল
মানুষে সাই জন্ম নিল,
লালন মহা ফ্যারে প’লো
সিরাজ সাঁইর অন্ত না পাওয়ায়।।

সাধক মানুষের ভেতরই গুরু খুঁজে বেড়ায়। আর দেহের মাঝে ব্রহ্মাণ্ড। তাই সে ভালো-মন্দ, ছোট-বড়, জাত-ধর্ম এসব ভাবনা নিয়ে সময় কাটায় না। সাধকের কাছে সকল সময়ই সুসময়, সকল মানুষই সুমানুষ, সকল পরিস্থিতিই সুপরিস্থিতি। কারণ সাধক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নয়।

তিনি জানেন পরিস্থিতি পরিবর্তের ক্ষমতা তার নেই; সে পারে মনোস্থিতি পরিবর্তন করতে। তাই সে মনের এমন স্থিতিতে অবস্থান করে যাতে ব্যক্তি-বস্তু-পরিস্থিতি তার উপর বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না। তাই এই জাগতিক যে লীলা চলছে অহনিশি তাতেই সাধক ডুবে থাকে।

এবং সকল সাধক-ভক্ত-অনুরাগী-আশেককে আহবান করে এই লীলায় ডুবে দেখবার। যে ডুবতে পারে সেই বুঝতে পারে কিরূপ লীলাময়। সাধনায় না ডুবলে এর স্বরূপ বোঝার ভিন্ন কোনো উপায়-অন্ত নেই।

পুলটার পাশে যখন পাকা ব্রিজ হলো। তখন সকলে খুশি হয়ে ওঠেছিল। কত আনন্দ। এখন আর ভয়ে ভয়ে পার হতে হবে না। কিন্তু যেদিন পুলটা থেকে কাঠ খুলে খুলে নিয়ে যাচ্ছিল সরকারি লোকজন। তখন আশপাশের সব পাড়ার লোক জড়ো হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। এতোদিনের স্মৃতি শেষমেষ কয়েকটা খুঁটি হয়ে থেকে গেলো।

তখন আমাদের বাসার পাশে ধোলাইখালের যে অংশটা শেষ হতে হতে কিছু দূরে গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পরেছিল। তার উপরে ছিল একটা কাঠেরপুল। এই পুলের নামে পুরো এলাকাটিও পরিচিত ছিল কাঠেরপুল নামে। বেশ ছিমছাম সুন্দর সেই পুল।

দুপাশে কাঠের রেলিং দেয়া চওড়া কাঠের পাটাতনের একের পর এক গাঁথা পুলটা দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়িতে। দুইপার ধরে বেশ কিছুটা উপরে উঠে মাঝের জায়গাটা সমতল। সুযোগ পেলে সেই পুলের দিয়ে রিকশাও চলাচল করতো। রিকশা উঠে গেলেই বাঁধতো বিপত্তি। মানুষকে দাঁড়িয়ে পরতে হতো দুইপাশে। রিকশা চলে যাওয়ার পর পার হতে হতো।

তাই মাঝে মাঝেই কে বা কারা যেন সেই পুলের মাঝখান থেকে কিছু কিছু পাটাতন খুলে ফেলতো। এতে রিকশা যেমন যেতে পারতো না; তেমনি আমরাও যেতেও ভয়ানক ভয় পেতাম। সেই শূন্য পাটাতনের ফাঁকা দিয়ে নিচে তাকালেই পিলে চমকে যেত।

পুলটার পাশে যখন পাকা ব্রিজ হলো। তখন সকলে খুশি হয়ে ওঠেছিল। কত আনন্দ। এখন আর ভয়ে ভয়ে পার হতে হবে না। কিন্তু যেদিন পুলটা থেকে কাঠ খুলে খুলে নিয়ে যাচ্ছিল সরকারি লোকজন। তখন আশপাশের সব পাড়ার লোক জড়ো হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। এতোদিনের স্মৃতি শেষমেষ কয়েকটা খুঁটি হয়ে থেকে গেলো।

সেই পুলকে ঘিরে কতো গল্প ছিল। হঠাৎ একটা গজিয়ে উঠা পাকা ব্রিজ গল্পটা পাল্টে দিলো। পুরান ঢাকার মানুষগুলো এমনি। পুলটা থাকার সময় প্রতিদিন পাড়ার মোড়ে বসে কত অনুযোগ-অভিযোগ করতো। কিন্তু যেদিন পুলটা আর থাকলো না সেদিন কি কান্না কি কান্না।

সেই টিকে যাওয়া খুঁটিটাকে ঘিরে কারা যেন মানত করতো। শীতকালে খালের পানি শুকিয়ে গেলে সেই খুঁটির গোরায় বেল-তুলশীর পাতা, জবাফুল দেখা যেত। মানুষজন মানত করে লাল-হলুদ সুতা বেঁধে দিয়ে যেত। কখনো কখনো কলাপাতার উপর নানান খাবার, মুড়ি, খৈ, চাল, ফল, বাতাসা দেয়া হতো।

কখনো বা লাল কাপড়ের উপর চাল, পয়সা, নারিকেল, কলা দিয়ে যেত কে বা কারা। এতে মানত পূর্ণ হতো কিনা জানি না তবে যেদিন খবর হতো খুঁটির গোড়ায় ভোগ দেয়া হয়েছে সেদিন বড়দের হাত ধরে আমরাও দেখতে যেতাম। সিকান্দার কাকা বলতো এসব নাকি জ্বীন তাড়ানোর জন্য দেয়া হয়।

সেই গদির উপর হালকা রঙের দামী চাদর বিছানো হয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকানোর জন্য নরম বালিশ। মেঝের মাঝ বরাবর পিতলের সুদর্শন চ্যাপ্টা থালার উপর সুগন্ধি আগরবাতি জ্বলছে। পাশে কয়েকটা ঝুড়িতে বিভিন্ন ফল, বেশকিছু ফুলদানিতে আকর্ষণীয় সব সুগন্ধি ফুল। একপাশে বেশ কিছু মোমবাতি।

তারা খুশি থাকলে মানুষকে বিপদে ফেলে না। আমরা জ্বীন ভূতের কথায় ভয় পাওয়ার চেয়ে তাদের দেখার কোনো উপায় আছে কিনা সেটা জানতে সিকান্দার কাকার পিছু পিছু হাঁটতাম। তিনি জ্বীন ভূতের নানা কাহিনী শোনাতেন রসিয়ে রসিয়ে। তবে কোনো গল্পই শেষ করতেন না।

অর্ধেকটা বলে উদাস হয়ে বলতেন আজ যা পরে একদিন শোনাবোনে। সিকান্দার কাকাও একটা আজব মানুষ ছিলেন তার সম্পর্কে কখনো সুযোগ হলে বলবো।

তাও বেশ কয়েকবছর আগের কথা, পরিচিত ভদ্রলোক জানালেন প্রবাসী এক সুফি গবেষক ঢাকা এসেছেন। উনার আবার লালন-বাউল-নাথ সাধকের উপর ব্যাপক আগ্রহ। দেশে এসেছেন সে বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। নিজের গবেষণার বিষয়ে আলোচনা করতে একটা ঘরোয়া মজলিসের আয়োজন করেছেন ভদ্রলোক।

আমি যাচ্ছি, তুই যাবি নাকি? এই রকম একটা প্রস্তাব শুনে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। দিনক্ষণ মেনে চলে গেলাম ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর সেই বাড়িতে। পরিচিত ভদ্রলোকটির টিকিটি দেখতে না পেয়ে গেট দিয়ে ঢুকবো কি ঢুকবো না বুঝতে পারছিলাম না।

এমন সময় একজন বেড়িয়ে এসে জানতে চাইলো আমি সেই আলোচনায় এসেছি কিনা। শুনেই আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বসতে বললো। জানালো লোকজন আসতে শুরু করেছে। উপরে দিয়ে বসুন।

উঠান পেরিয়ে নির্জন বাড়ির সোজা দোতলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখি এদিকটায় মোটামুটি বড় একটা আয়তাকার ঘরকে মজলিসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে। মেঝের দামী কার্পেটের মাঝের অংশটা বৃত্তাকারে ফাঁকা রেখে চারপাশে নরম গদির টানা আসন পাতা হয়েছে।

সেই গদির উপর হালকা রঙের দামী চাদর বিছানো হয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকানোর জন্য নরম বালিশ। মেঝের মাঝ বরাবর পিতলের সুদর্শন চ্যাপ্টা থালার উপর সুগন্ধি আগরবাতি জ্বলছে। পাশে কয়েকটা ঝুড়িতে বিভিন্ন ফল, বেশকিছু ফুলদানিতে আকর্ষণীয় সব সুগন্ধি ফুল। একপাশে বেশ কিছু মোমবাতি।

ঘরটির ছাদের মাঝে যে ঝাড় বাতিটি ঝুলছে তাকে কেন্দ্র করে পুরো ঘরটিকে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের সূক্ষ্য কারুকাজ করা কাপড় দিয়ে অনেকটা জলসাঘরের রূপ দেয়া হয়েছে। দরজার ঠিক বিপরীত দিকে মাঝ বরাবর প্রধান আসন করা হয়েছে।

একটা সাদা রঙের মোটা কাপড়ের আসনের দুপাশে দুটি সাদা গিলাফের ধবধবে কোলবালিশ। ঘরটির এতো সাজসজ্জাতেও কোথাও উগ্রতা বা মাত্রাতিক্ততার ছোঁয়া নেই। যিনি সাজিয়েছেন তার রুচির তারিফ করতেই হয়ে। ঘরটার মধ্যে পা রেখেই একটা মুগ্ধতা চলে এলো।

ঘরটা এখনো ফাঁকাই বলা যায়। ডান দিকে আসনের কাছাকাছি দুজন বসে আছেন। একজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে নিয়ে হাতে থাকা বইতে মনোযোগ দিলেন। অন্যজন হাঁটুতে মাথা গুজে বসে আছেন। বাম পাশের দরজার কোনে একজন সর্বকেশী সাদা রঙের মলিন পোশাক পরা সাধু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।

সুফি সাধকরা সাধারণত একটু জমকালো চকচকে পোষাক পরতে পছন্দ করেন। এইসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় সুফি গবেষক চলে আসলেন। আমার কল্পনাকে বাস্তব করে দিয়ে সত্যি সত্যি সেই গবেষক জড়ির কারুকাজ করা বেগুনী রঙের শেরওয়ানী পায়ে নাগড়া মাথায় মির্জা গালীবের মতো টুপি পরে ঘরে প্রবেশ করলেন।

আমার মতো ছাপোষা মানুষের মূল আসনের থেকে দূরত্ব রেখেই বসা উচিৎ। আমি যার আমন্ত্রণে এসে উপস্থিত হয়েছি উনি নিজেই এখনো আসনেনি। আসবেন কিনা তারও ঠিক নেই। এই রূমে তাকে কেউ চিনে কিনা তাও বা কে জানে। তাই বেশি কিছু না ভেবে সাধুর পাশে ঘরের অন্ধকার কোণে বসে পরলাম।

লোকজন আসতে শুরু করলো। বোঝাই যাচ্ছে সকলেই বেশ প্রভাবশালী। অনেকের সাথেই সেক্রেটারি এসেছেন। সেক্রেটারিরা অবশ্য এখানে বসার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা ফোনে আদেশ পেলেই এটা সেটা এনে দিচ্ছে। উপস্থিত অনেকেই নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিচিত মনে হলো।

তারা গল্পে মেতে উঠলো নিজেদের নিজেদের ছোট ছোট দলে। আমি আর সাধু এক কোণে চুপচাপ বসে আছি। তবে সাধু বেশ চকচকে চোখ করে আগ্রহ নিয়ে দূর থেকেই তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। ঘরে আমাদের মতো আরো গুটি কয়েক মানুষ আছে যাদের কেউ পাত্তাটাত্তা দিচ্ছেন না।

তাদের কথার ফাঁকে সেই সাধুটি আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তারা হাত নেড়ে এমনভাবে তাকে অবজ্ঞা করলো যেন কোনো অচ্ছুত ঢুকে পরেছে এই ঘরে। সাধু আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে আবার চোখ বন্ধ করলেন।

সকলের আলোচনাকে উপেক্ষা করে আমি আমার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলাম। ভাবতে লাগলাম সেই সুফি গবেষক কেমন হতে পারে। পিসি সরকারের মতো চকমচে জাকালো আজব কোনো পোষাক পরে আসবেন? মাথায় জড়ি লাগানো বিশাল পাগড়ী পায়ে নাগড়া? এমন কিছু কি?

সুফি সাধকরা সাধারণত একটু জমকালো চকচকে পোষাক পরতে পছন্দ করেন। এইসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় সুফি গবেষক চলে আসলেন। আমার কল্পনাকে বাস্তব করে দিয়ে সত্যি সত্যি সেই গবেষক জড়ির কারুকাজ করা বেগুনী রঙের শেরওয়ানী পায়ে নাগড়া মাথায় মির্জা গালীবের মতো টুপি পরে ঘরে প্রবেশ করলেন।

তবে তাকে মোটেও আজব লাগছে না। দারুণ সুদর্শন এই মানুষটিকে অপূর্ব মানিয়েছে এই পোশাকে। ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে যুবরাজের চরিত্রের জন্য একেবারে যর্থাথ বলা যায়। ঘরে প্রবেশ করেই সকলকে লম্বা সামাল দিলেন ভদ্রলোক।

সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো হাসি মুখে। হৈ হৈ করে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। হাত বাড়ালো ধরলো উনার সাথে হাত মেলানোর জন্য। তিনি অবশ্য এসবে খুব আগ্রহ না দেখিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠলেন, গুরুজি কই! গুরুজি আসেন নাই?

সিসটিন চ্যাপেলের গায়ে মাইকেল এঞ্জেলোর পেইন্টিং, কত কত ফ্রেসকোস, কত কত মন্দিরের গায়ে অসংখ্য কারুকার্য, ধর্ম মানে বাইবেল, কোরান, গীতা, ধর্ম মানে সাহিত্য, লিটারেচার, ধর্ম মানে এক কথায় আর্ট।

ভদ্রলোক সকলকে পাশ কাটিয়ে আমার পাশে থাকা গুরুজিকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তার চরণে নতমস্তকে ভক্তি দিয়ে বললেন, গুরুজি আপনি এইখানে কেনো? আপনি আসনে বসেন। পরম ভক্তিতে ভদ্রলোক সাধুকে নিয়ে আসনে বসালেন। নিজে গুরুজির পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পরলেন।

এতোক্ষণ যারা সাধুকে অবজ্ঞা করেছিলেন; তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন; তারাই এখন এমনভাব দেখাতে শুরু করলেন যেন এই সাধুর জন্যই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আসলে আমরা সকলে এভাবেই বোল পাল্টে ফেলি। নিজেদের প্রয়োজন হলে আমরা ঠিকই জাত-ধর্ম, উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব সব ভেদ ভুলে যাই।

বুকে আলিঙ্গন করে নেই। কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই জাত নিয়ে আবারো বজ্জাতি শুরু করে দেই। এই জাত-ধর্মের বারাবারিতে মানব সভ্যতাকে দিনদিন সভ্য বলাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জাত-ধর্ম, উঁচু-নিচু, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীটা আর মানুষের জন্য বাসযোগ্য থাকবে না।

জাত ধর্মের সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে হয়তো সংজ্ঞার অতলে হারিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানী-গুণী জন বহুবার বহু ভাষায় বহুভাবে এর সংজ্ঞা দিয়েছেন। আজ এই শেষ রাতে সেইসব আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এতোসব শক্ত শক্ত কথা এখন আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

খুব মনে পরছে ‘ম্যাডলি বাঙালি’ চলচ্চিত্রে অঞ্জন দত্তের একটা সংলাপ। এই সংলাপটায় অদ্ভুদ একটা আকুতি আছে। আছে মানবতার অপূর্ব মেলবন্ধন। ধর্ম আর রাজনীতিকে আলাদা করে ভাববার জন্য ম্যাডলি বাঙালি’র প্রোটাগনিস্ট অঞ্জন দত্ত ধর্ম আর রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলা একটা চরিত্র বলছেন- “তুমি রাজনীতি নিয়ে কথা বলছো ধর্ম নিয়ে নয়।

…তুমি ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাটা শোনো… আমায় এক মিনিট সময় দাও…আমি বলছি ধর্ম মানে কি… ধর্ম মানে আজান। ধর্ম মানে কাওয়ালী। ধর্ম মানে হিন্স, ক্যারল, কীর্তন, সংকীর্তন। ধর্ম মানে মসজিদ, মন্দির, চার্চেস, ক্যাথিড্রাল, বিশাল বিশাল সব আর্কিটেকচার।

সিসটিন চ্যাপেলের গায়ে মাইকেল এঞ্জেলোর পেইন্টিং, কত কত ফ্রেসকোস, কত কত মন্দিরের গায়ে অসংখ্য কারুকার্য, ধর্ম মানে বাইবেল, কোরান, গীতা, ধর্ম মানে সাহিত্য, লিটারেচার, ধর্ম মানে এক কথায় আর্ট।

এবং এই আর্টের এই জগৎটার একটা বড় অংশ হচ্ছে সংগীত। …সেটা সংকীর্তন হতে পারে, বান্দিস হতে পারে, কিংবা রক মিউজিক হতে পারে। তুমি যে মিউজিকটা করছো সেটা সম্ভবই হতো না। যদি না বহুদিন আগে একটা কালো ক্রীতদাস টিন বাজিয়ে তার ঈশ্বরের কাছে গলা খুলে না গাইতো।

কিংবা কোনো বাউল একটা একতারা নিয়ে একটা গান না লিখে ফেলতো। সারা পৃথিবীতে এই ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শিল্প সাহিত্যের ভাণ্ডার যদি না থাকতো। তাহলে তোমার আমার ধর্ম থাকতো না।”

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!