ভবঘুরেকথা
ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : চৌদ্দ

সেবার এক সাধুসঙ্গে গেছি। হঠাৎই চলে গেছি বলা যায়। পরিচিত কয়েকজন কথা দিয়েছিল সাধুসঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি। প্রায় ভিজতে ভিজতে যখন যেয়ে উপস্থিত হয়েছি। ততক্ষণে অধিবাস শুরু হয়ে গেছে। এমনিতেই ছোট সাধুসঙ্গ, তার উপর বৃষ্টিতে লোকজন খুব একটা হয়নি।

তবে দিনের শুরুতেই সাধুগুরুরা চলে এসেছেন বলে আখড়াটা আলোময় হয়ে আছে তাদের উপস্থিতিতে। সাধুসঙ্গে অবাঞ্চিত লোকজন যত কম হয় ততই ভালো লাগে। তার উপর মেলাও বসেনি বৃষ্টির কারণে। কেবল সাধুগুরু আর ভক্তরা আছেন। এরকম সাধুসঙ্গ কপালগুণে মেলে বলা যায়।

তবে যত ছোট আয়োজন শুনেছিলাম যেয়ে দেখলাম বিষয়টা তেমন না। বিশাল দুই মহলা বাড়ির সামনের অংশে আখড়া বাড়ি। তার পেছনে উঠান পেরিয়ে বিশাল মাটির ঘর। একপাশে সদ্য নির্মিত গোটা কয়েক পাকা ঘরও আছে। আর বাড়ির পেছনের দিকে অনেকটা খোলা জায়গা পেরিয়ে পুকুর। তবে সেসবই পরদিন দেখেছি।

দেখলাম মোটামুটি পরিচিত কেউ নেই। এটা সাধুসঙ্গে কোনো সমস্যা নয়। একজন দৌঁড়ে এসে একটা গামছা দিলেন গা মুঝে নেয়ার জন্য। প্রায় সত্তর পেরুনো এক তরুণ সাধু নিজেই আমার দেহ থেকে পানি মুঝে তরতাজা করে তুললেন।

ঠাণ্ডায় ততক্ষণে আমি প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। অটোতে পর্দা টেনে বসেও বৃষ্টির তেজে আমি চুপচুপে ভিজে একাকার। এক মগ চা’ও পাওয়া গেলো। পোশাক পাল্টে এক পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পরলাম।

ক্ষাণিকবাদেই যাকে ঘিরে সাধুসঙ্গ হচ্ছে তিনি ইশারায় কাছে ডাকলেন। ঢাকা থেকে গেছি শুনে বেশ অবাক হলেন প্রথমটায়। এতো পথ পাড়ে দিয়ে এই বৃষ্টি-কাঁদার মধ্যে সেখানে গেছি শুনে তার আনন্দের শেষ নাই। বারবার বললেন সে কথা। বললেন, বাপ আগে সেবা নেও তারপর বসো। একটু পরেই ভাব শুরু হবে।

সেবা নিতে নিতেই দূর থেকে শুনতে লাগলাম দৈন্য শুরু হয়ে গেছে। সেবা শেষে হাত ধুয়ে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি ততক্ষণে বৃষ্টিটা আবার বেশ বেড়েছে। সাথে বেশ তীব্র বাতাস। এই বৃষ্টিতে আর আখড়ার দিকটায় যাওয়ার উপায় নাই। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। সাধুকেও ধারে কাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

সেই তরুণ সাধুটি আমাকে কাঁদা বাঁচিয়ে নিয়ে গেলেন ভেতর বাড়িতে। বিশাল উঠানে পানি জমে একাকার অবস্থা। তবে পাশের যে অংশটায় সেবা রান্না হচ্ছে সে অংশটা ত্রিপল থাকায় তখনো অনেকটা শুকনো আছে। অন্য পাশের বিশাল টানা ঘরটার সামনের উঁচু বারান্দাও শুকনোই দেখা যাচ্ছে; সামনে ঢালু করে ত্রিপল টানানোর কারণে। সেখানে এক মা হ্যারিকেনের আলোতে কয়েকজনকে সেবা দিচ্ছেন।

সঙ্গী সাধুর কাছ থেকে জানা গেল, ঝড়-বৃষ্টির শুরুতেই বিদ্যুৎ চলে গেছে। অনেকটা সময় হয়েছে। তবে কথা হয়েছে। রাস্তায় কাজ চলছে। কিছু সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে আসবে।

আমিও বারান্দায় উঠে তাদের পাশাপাশি বসে পরলাম। পরম মমতায় মা সেবা দিতে লাগলেন। সেবা নিতে বসে মনে পরলো সারাদিনে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। মা দিতে লাগলেন আমিও গো-গ্রাসে খেয়েই চললাম। বৃষ্টিটা কিছুটা ধরে আসলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। মাঝে মাঝেই টুপটাপ শব্দটা বাড়ছে। সাথে একটা শীতল বাতাস।

সেবা নিতে নিতেই দূর থেকে শুনতে লাগলাম দৈন্য শুরু হয়ে গেছে। সেবা শেষে হাত ধুয়ে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি ততক্ষণে বৃষ্টিটা আবার বেশ বেড়েছে। সাথে বেশ তীব্র বাতাস। এই বৃষ্টিতে আর আখড়ার দিকটায় যাওয়ার উপায় নাই। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। সাধুকেও ধারে কাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

অন্য যারা সেবা নিচ্ছিল তারা আগেই সেবা সেরে চলে গেছে। মা বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। দূর থেকে ভেসে আসা গানের সাথে তাল ঠুকছেন হাতে হাতে। পানির ছাট এসে লাগছে গায়ে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে টানা বারান্দার একপাশে পাতা চকির দিকে দৃষ্টি গেলো। সেদিকটায় বারান্দায় বাইরের পাশটা বেড়া দিয়ে ঘেরা।

গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর এতো খেয়ে নিয়েছি যে, একটু গা এলাতে পারলে মন্দ হয় না। সে কথা ভাবতে ভাবতে সেদিকে হাঁটা দিলাম। চকির উপরে ধবধবে সাদা পরিস্কার চাদরের উপর গা এলিয়ে দিয়ে পা ঝুলিয়েই চোখ মুদলাম।

বৃষ্টির তেজে গানের সুর মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। আবার বাতাসের তেজ কমে আসলে গানের কথা-সুর কানে আসছে।

এভাবে কতটা সময় কেটে গেছে বলতে পারবো না। হয়তো ক্লান্ত দেহ তন্দ্রায় চলে গিয়েছিল। কোন সময় বিদ্যুৎ চলে আসছে তাও খেয়াল করিনি। চোখ মেলে দেখি মাথার উপর খুব কাছে একটা মুখ। কিছুটা চমকে উঠে ভালো করে তাকিয়ে দেখি বেশ বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সাধু অনেকটা ঝুঁকে আমাকে চেনার চেষ্টা করছেন।

ডেকোরেটরের বাতিগুলো জ্বলে উঠায় বারান্দা-উঠান সব জায়গা দিনের মতো ঝলমলে আলো। উঠে বসলাম। দু’হাত উঠিয়ে ভক্তি দিলাম সাধুকে। সাধু ভক্তি নিলেন। তারপর পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কে, বাপ?’

সাধুর মুখে কথাটা শোনামাত্র কেন যেন সব শূন্য হয়ে গেলো। সাধারণ মানুষ জিজ্ঞেস করলে, এর উত্তরে হয়তো কিছু একটা বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু সাধুগুরু যদি জানতে চান, তুমি কে? তাহলে কি আসলেই কিছু বলার থাকে? আসলেই তো… ‘আমি কে’?

ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। তরুণ সাধুটি এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো। আমিও তার পিছু পিছু আখড়ার দিকে চললাম। সেই সাধুটি ঠায় চেয়ে আছেন তখনো আমার দিকে। সাধুর সেই প্রশ্নটা আজো আমাকে ফালাফালা করে দেয়।

সেই চিনে নেবার দৃষ্টি আজও মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ধরা দেয় মনের দৃষ্টিতে। কি করে বোঝাই সাধুকে ‘আমি কে’? এটা জানতে পারলে তো হয়েই যেত। তাহলে কি আর মনে এতো দামামা বাজে?

এরকম আরেকটা ধাক্কা খেয়ে গভীর অতলে পরেছিলাম আবু সাধুর বাড়িতে। সকল কিছু প্রস্তুত, উঠানে সেবা নিতে বসবো। কিন্তু মাছির উৎপাত শুরু হয়ে গেলো। মা বললেন, বাপ যাতো বাগান থেকে কয়েকটা পাতাসহ নিমের ডাল ভাইঙ্গা নিয়া আয়।

যা কিছু ব্রহ্মাণ্ডের পক্ষে নয়, তা কি আসলিই কখনো মানুষের পক্ষে? জীবের পক্ষে?? কৃত্রিম সকল কিছুই শেষ পরিণতিতে মিথ্যা। সবই পুঁজিপতিদের ব্যবসার নবনব ধান্ধা মাত্র। যাক… এসব কঠিন কথা বলে কি হবে। এসব বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা আমার মতো মূর্খের কর্ম্ম নয়।

সেবার থালায় হাত দিতে যাচ্ছিলাম সকলে। সেবা থেমে গেলো। সে অবস্থায়ই মায়ের আদেশ মতো বাগানের দিকে রওনা দিলাম। সকলে সেবা সামনে নিয়ে বসে আছে, আমি দ্রুত বাগানের সবচেয়ে কাছের নিমগাছ থেকে বেশ কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে এনে মায়ের হাতে দিয়ে; সেবায় বসলাম।

মা বললেন, ‘গাছের কাছে অনুমতি নিয়া ডাল ভাঙছস তো?’ আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেলো। আসলেই তো এভাবে তো ভাবিনি। সেবায় হাত দিবো এমন সময় মা আবার বললো, যা আগে গাছের কাছে মাপ চায়া আয়। তারপর সেবায় বসবি।

মাথা নিচু করে গাছের সামনে যেতে যেতে চোখে ক্রমশ জমে যাওয়া পানি থামাতে পারছিলাম না। না সেবা থেকে উঠতে হলো বলে না। আমার জন্য সবার সেবা বন্ধ হয়ে রইল। তার জন্যও চূড়ান্ত কষ্ট হচ্ছিল বললে মিথ্যা হবে। যদিও সেটাও একটা গর্হিত অপরাধের মধ্যেই পরে।

আসলে আমার ভাবনা-চিন্তা কতটা নিচুস্তরের তা ভেবেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। সত্যিই তো গাছের ডালগুলো ভেঙ্গে নিয়ে চলে এলাম। একবারও তার কাছে অনুমতি নেয়ার কথা ভাবলাম না? বা সারাজীবন কি কখনো ভেবেছি এভাবে? সভ্যতা থেকে কতদূরে থেকেও আমার ‘রিক্তা মা’ কি গভীর থেকে ভাবতে পারে! কি তার আকুতি!

সাধুদের সেবা বন্ধ করে দিয়ে তিনি আগে পাঠিয়েছেন গাছের কাছে ক্ষমা চাইতে? অথচ সারাজীবন কত মানুষের কত জীবের-কত বৃক্ষের কাছ থেকে সেবা নিয়েছি কিন্তু কখনো অনুমতি নেয়া হয়নি। চাওয়া হয়নি ক্ষমা। ঋণস্বীকার করা হয়নি কখনো। ঋণশোধ তো অনেক দূরের পথ।

তাহলে এতো এতো বই… এতো এতো শিক্ষক… আমাকে কি শিক্ষা দিলো সারাজীবন ধরে? যাদেরকে সারাজীবন শিক্ষিত মানুষ বলে জেনেছি তারা আমাকে তাহলে কি শিক্ষা দিলো? আমিই বা জীবন থেকে কি শিখলাম? নাকি সবাই এভাবেই ভাবে? আমিই কেবল ভুল বই পড়েছি… ভুল মানুষকে শিক্ষক ভেবেছি?

আমি এ কথা মাত্র সেদিন জানলাম! সেদিন বুঝলাম!! সংস্কারের নামে যা আমাদের শেখানো হচ্ছে মোটা মোটা বইপত্রে, তা কেবলই এই পেন্সিলে আঁকা সভ্যতার দাসত্যের পরওয়ানা মাত্র? যারা প্রথা ভাঙার-বিপ্লবের-অধিকার আদায়ের কথা লিখেছেন-লিখে চলেছেন তারাও আদৌতে সেই সভ্যতার জন্যই দাস তৈরিতে মত্ত্ব তবে?

যা কিছু ব্রহ্মাণ্ডের পক্ষে নয়, তা কি আসলিই কখনো মানুষের পক্ষে? জীবের পক্ষে?? কৃত্রিম সকল কিছুই শেষ পরিণতিতে মিথ্যা। সবই পুঁজিপতিদের ব্যবসার নবনব ধান্ধা মাত্র। যাক… এসব কঠিন কথা বলে কি হবে। এসব বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা আমার মতো মূর্খের কর্ম্ম নয়।

সহজ ভাষায় কি আর আমি বোঝাতে পারবো? বিপ্লব করতে যেয়ে শেষ বিচারে আদৌতে তারা নিজেরাই পুঁজিবাদির অস্ত্রের ব্যবসাকেই জাগিয়ে রেখেছে; বিচ্ছিন্নবাদী চিন্তা-চেতনায়?? মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে মানুষকেই ঘৃণার বস্তু বানিয়ে চলেছে… মানুষকে ভালোবাসার বদলে???

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বুঝতে গিয়ে বিশাল তার্কিক হওয়া সহজ। কিন্তু সমগ্র মানুষকে… বিশ্বকে… জগতকে ভালোবাসা মোটেও সহজ নয়। কি করে বোঝাবো তাদের আমার এই সামান্য জ্ঞান নিয়ে? মনে বিন্দু পরিমাণ ঘৃণা পুষে রাখলে প্রেমের বিকাশ হয় না। যা প্রকাশ হয় তা হলো কাম। মানে কামনা। যা অন্যের তা নিজের করে নেয়ার এই খেলায় জগৎ ডুবে আছে। সে জগতে বসে ফকির লালন নিজেই বলছেন-

অবোধ মন তোরে আর কী বলি।
পেয়ে ধন সে ধন সব হারালি।।

মহাজনের ধন এনে
ছিটালি রে উলুবনে,
কী হবে নিকাশের দিনে
সে ভাবনা কই ভাবলি।।

সই করিয়ে পুঁজি তখন
আনলি রে তিন রতি এক মণ,
ব্যাপার করা যেমন তেমন
আসলে খাদ মিশালি।।

করলি ভালো বেচাকেনা
চিনলি না মন রাং কি সোনা,
লালন বলে মন রসনা
কেন সাধুর হাটে এলি।।

যাক সেসব অহেতুক আলাপন। তারচেয়ে নিজের পাপাচারের কথাই বলি- প্রায় ঘণ্টাখানেক সাইন্সল্যাবের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। রোদে দরদর করে ঘামছি। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কোনো বাসেই উঠতে পারছি না। বাস না পেয়ে সেই ধানমণ্ডি থেকে হাঁটতে হাঁটতে এ পর্যন্ত এসেছি। আর এক পাও চলছে না।

তীব্র গরমে একখণ্ড ছায়া ভাগাভাগি করে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছি। বাকিরা দৌঁড়ে চলছে বাস থেকে বাসে। যদি উঠে পরতে পারে সেই প্রতিযোগীতায়। অবশেষে আমাদের সময়ও আসলো। পর পর বেশ কয়েকটা বাস আসায় ভিড় একটু পাতলা হলো। একটা বাসে আমিও উঠে পরলাম। উঠে দেখি বিশাল বাসের শেষ দিকে সিটও খালি আছে। উঠেই হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে রওনা করলাম।

দুই সিটের মাঝের সরু পথটা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পরতে পরতে শেষটায় সামনে নিলাম। বিলাশ লম্বা এক ভদ্রলোক গা এলিয়ে সিটে বসে আছে। তার পা মাঝের পথটার উপর এমনভাবে রেখেছে যে আরেকটু হলে তাতে ধাক্কা খেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতাম। কারণ ততক্ষণে বাস জোড়ে টান দিয়েছে।

কারো সাথে খারাপ আচরণ বা কাউকে মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলার পর্বটা ততদিনে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু সেদিন কি জানি হলো। একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে পেছনে না তাকিয়েই ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলেই বসলাম, ‘একটা নূন্যতম ভদ্রতা বোধ থাকা দরকার বাসে উঠলে।’

অন্য কেউ সেই কাঙ্খিত সিটে বসে না পরে, তাই বলতে বলতে আরো অনেকটা এগিয়ে সিটখানায় বসে পরলাম। বসে খেয়াল করলাম সেই বিশাল উচ্চতার ভদ্রলোকের হাতে সাদা ছড়ি। চোখে কালো চশমা। সাথে একটা অল্প বয়সী মেয়ে।

সে তার বাবার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে। আজো যদি কেউ আমাকে বলে জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ আমি কি করেছি তখনি গুটিকয়েক যে কয়টা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে এটা সেই একটা ঘটনা। ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চাইবার তীব্র ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে বাসে যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। ভিড়ের ফাঁকে কোথায় তিনি নেমে গেছেন সেটা আর খেয়াল রাখতে পারি নি।

কিন্তু শিক্ষাগুরুর ঋণ শোধ কইরা দিতে হয়। দীক্ষাগুরুর সাথে তো জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। সে চাইলে ক্ষমা কইরা দিতে পারে। কিন্তু শিক্ষাগুরুর ঋণশোধ না করলে যদি গুরু বিরূপ হয়। তাহলে তুই তা জানতে পারবি না। আর এই ঋণ শোধ না করলে মুক্তি মেলে না। সাধন-ভজনে মন বসে না।’

জীবনে হয়তো এরচেয়েও অনেক পাপাচার করেছি। কিন্তু অপরাধবোধ এতো তীব্র পল্টনমোড়ে যাত্রীকে চাপা দিয়ে যে ড্রাইভার পালাচ্ছিল তাকে ধরে আনাবার পর জনতা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যে গণধোলাই দিয়েছিল; সেই ধরে আনবার অপরাধবোধ। আর তার পরেই এই ভদ্রলোকের কথা মনে পরে। মনে পরে তার অল্প বয়সী মেয়ের শক্ত করে বাবার হাত ধরে রাখবার কথাটা।

একজন দৃষ্টিহীন মানুষের সাথে এমন আচরণকে কেনো যেন মানতে পরিনি আজো। হয়তো সেই ভদ্রলোক অনেকের কাছ থেকেই এমন আচরণ পায়। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের সাথে এমন আচরণ করা কি আমাদের সাজে? আমার সাজে? এসব ঘটনা যখন মনে পড়ে নিজেকে ঠিক মানুষের কাতারে ভাবতে পারি না। একটা গভীর অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে।

এক সাধু বলেছিল, ‘যে কাজে মনে অপরাধবোধ জাগে তাই পাপ। তাই পাপাচার।’ মাথার ভেতর এমন সব পাপাচার নিয়ে কি করে শান্ত হয়ে সাধন করি? সাধু বলেছিল, ‘দানে সব কাটে বাপ। দান করো।’ আমি হেসে বললাম, বাজান আমার তো কিছুই নাই দান-দক্ষিণা কি করবো?

সাধু উল্টো হেসে বললো, ‘আরে যার কিছু থাকে না তারই তো দান করতে হয়, যার আছে সে তো দান করে না। সে করে দয়া। দয়ায় লাভ নাই। লোক দেখানো সেই সব দয়ায় কাজ হবে না। তুমি দান করো-দয়া কইরো না।’

আরেক পাগল-মস্তান একবার বলেছিল, ‘শোন! ঋণ পরিশোধ করবি। যার কাছে ব্রহ্মাণ্ডে এক কলম জ্ঞানও পাইছিস। যার কাছে থেইক্ক্যা, নিজেরে চিনোনের.. ব্রহ্মাণ্ডরে চিনোনের.. এক রত্তি জ্ঞান পাবি তার ঋণ শোধ কইরা দিবি। নইলে সেই জ্ঞান বিকাশ হইবো না। বিপদে পরবি। দীক্ষাগুরুর ঋণ জীবন দিয়া শোধ দেওন যায় না বাপ।

কিন্তু শিক্ষাগুরুর ঋণ শোধ কইরা দিতে হয়। দীক্ষাগুরুর সাথে তো জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। সে চাইলে ক্ষমা কইরা দিতে পারে। কিন্তু শিক্ষাগুরুর ঋণশোধ না করলে যদি গুরু বিরূপ হয়। তাহলে তুই তা জানতে পারবি না। আর এই ঋণ শোধ না করলে মুক্তি মেলে না। সাধন-ভজনে মন বসে না।’

বুঝবো কি করে, তিনি সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট হলেন?

‘আরে পাগল, গুরু সে শিক্ষাগুরু হোক… আর দীক্ষাগুরুই হোক… তারে বোঝার সাধ্য তোর নাই। তুই কেবল ফাঁকি দিস না। কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবি না। তোর যা সামর্থ্য তা যদি তুই না করিস। যদি কৃপণতা করিস। যদি সত্য আড়াল করিস। তাহলে গুরু বিরূপ হইব। কারণ গুরু সবই জানে। তার সাথে ফাঁকিঝুঁকি চলে না।’

পাগলের কথা শুনেই গেলাম ঋণ আর শোধ করতে পারলাম কই। সাধুগুরুদের ভালোবাসাই নিয়ে গেলাম জনমভর। যা নিলাম তার কণামাত্রও শোধ দিতে পারলাম কই? ঋণ শোধ করার সেই অপরূপ মন’ই বা তৈরি করতে পারলাম কই? ভালোবাসার সেই ঋণ কাঁধে নিয়েই ঘুরছি জগৎ ঘুর্ণির তালে তালে। যদি সেই চরণ পাই…

বর্ষাকাল বৃষ্টি হচ্ছে যখন-তখন। গভীর অরণ্যের সর্বত্র জল জমে থৈ থৈ। তার সাথে নানারূপ বিষধর জলজ ও সরীসৃপের আনাগোনা। বৃষ্টিতে আগুন জ্বালানো যাচ্ছে না। মাথা গুজবার জন্য অস্থায়ী আবাস যা করা হয়েছিল বৃষ্টির তেজে তা ভেঙ্গে পরেছে। তবে সবচেয়ে যন্ত্রণার নাম হলো জোঁক। এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকা যাচ্ছে না তার অনাগত আগমনে।

এক খণ্ড পলেথিন বা ঘটিবাটি কিছুরই ব্যবস্থা করা যায় নি। আদিমবেশে যুগলদ্বয় যখন আর পেরে উঠছিল না এই পরিবেশে, তখন তারা জল পেরিয়েই সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে সত্য কিন্তু যদি একখণ্ড ভূমি পাওয়া যায়।

একটু আমারে ঘুম দেয়ার জায়গা পাওয়া যায়। যদি একটু আগুন জ্বালানোর শুকনো কাঠ পাওয়া যায়। বা মাথায় দেয়ার জন্য একটু পলেথিন জাতীয় কিছু জোগার যায়। যাই হোক এর থেকে মুক্তি প্রয়োজন।

ক্লান্ত দেহে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবিষ্কার করলো তারা পৌঁছে গেছে সমুদ্রের তীরে। সমুদ্রের এই অংশে ছোট্ট একটা বুলকা বুনো সৈকত। সমু্দ্রের ঢেউ সমস্ত আবর্জনা এনে জড়ো করেছে যেনো সৈকতের পারে। তাতে কাঠ-লতাপাতা-হাড়গোড়ের সাথে মানুষের ব্যবহৃত নানা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান জায়গায়।

যুবকটি আনন্দে বিজয়ীর বেশে চিৎকার করতে লাগলো। ছুটে ছুটে এটা সেটা দেখতে লাগলো কাজে লাগানো যায় এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই আশায়। হঠাৎ তার সঙ্গীটির কথা স্মরণ আসতেই তাকিয়ে দেখে নারীটিও এদিক সেদিক দৌঁড়ে মানুষের ফেলে দেয়া ক্ষয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্লাস্টিক-পলেথিনের পণ্য-তার ছেড়া অংশ দেখছে আর কেঁদে কেঁদে উঠছে।

যুবকটি তার আবেগ বুঝতে পেরে পাশে এসে বললো, দেখেছো আমাদের ব্যবহারের জন্য অনেক কিছুই এখান থেকে পাওয়া যাবে। যদিও এসব খুবই নোংরা এবং ভাঙ্গা-নষ্ট অবস্থায় আছে। নারীটির কান্না থামছেই না। সে হাতের ইশারায় সেসব দেখাচ্ছে আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে তো কাঁদছেই।

যদি তাও হয় তাহলে সেই স্ক্রিপ্ট রাইটারকে কুর্ণিশ। যিনি এভাবে ভাবতে পেরেছেন। যদি সেই কথাগুলো নেই নারীর হয় তাহলে জয় হোক তার। যদি স্ক্রিপ্ট রাইটারের হয় তাহলে তার জয় হোক।

যুবকটি বললো আমরা জলা থেকে একটা মুক্ত জায়গায় আসতে পেরেছি। এখানে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু মিলবে বলেও মনে হচ্ছে। আগুন জ্বালানোর জন্য শুকনো কাঠও পাওয়া যেতে পারে। থাকার একটা ছাপড়া ঘরও বানিয়ে ফেলা যাবে কোথাও।

সবচেয়ে বড় কথা হলো এখনে জোঁক দেখা যাচ্ছে না। তুমি কাঁদছো কেনো? হাসো-হাসো… উল্লাস করো। এখন তো আনন্দের সময় আমাদের।

নারীটি কাঁদতে কাদতেই বলে উঠলো, দেখো মানুষ কত খারাপ। তাদের ব্যবহৃত পলিথিন-প্লাস্টিক এই বুনো সৈকতে পর্যন্ত এসে পরেছে। এখানে তো সভ্য মানুষের আনাগোনে নেই। তাহলে বলো এসব নিশ্চয়ই জাহাজ থেকে ফেলেছে বা অন্য কোনো জায়গা থেকে ভেসে ভেসে এসেছে।

মানুষ কবে মানুষ হবে বলতে পারো? তুমি জানো এই পলেথিন-প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যেত কত শত বছর লাগবে? আর আমাদের এসব অসচেতনার জন্য পরিবেশে কি মারাত্মক ক্ষতি আমরা করছি? তুমি ভাবতে পারো?? মানুষ হিসেবে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে…।

দিন চল্লিশের জন্য আদিমবেশে দুর্গম অরণ্যে টিকে থাকার প্রতিযোগীতামূলক এক টিভি রিয়েলিটি শো-এর এটি একটি দৃশ্য। যা আমাকে বেশ ভাবিয়েছিল। ভাবিয়েছিল বলছি কেনো এখনো ভাবায়। রিয়েলিটি শো মানেই স্ক্রীপটেড। এটাও যদি ভেবে নেই।

যদি তাও হয় তাহলে সেই স্ক্রিপ্ট রাইটারকে কুর্ণিশ। যিনি এভাবে ভাবতে পেরেছেন। যদি সেই কথাগুলো নেই নারীর হয় তাহলে জয় হোক তার। যদি স্ক্রিপ্ট রাইটারের হয় তাহলে তার জয় হোক।

সাধারণভাবে এমন অবস্থায় পরলে আমদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ মানুষই হয়তো যুবকটির মতোই আনন্দে ভেবে উঠবে। কিন্তু কয়জন সেই নারীর মতো ভাবতে পারবে? নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বনকে তুচ্ছজ্ঞান করে যে সকলের কল্যাণের জন্য নিবেদিত হতে পারে সেই তো প্রকৃত সাধু মন লালন করে। তাদেরই হয়তো শাব্দিক অর্থে ফকির লালন ‘মানুষ রতন’ বলেছেন।

সেই মানুষ রতনই তো প্রকৃত শিক্ষক। তাকেই তো নম নম করা যায়। তার কাছ থেকেই তো খুব গোপনে শিখে নিতে হয় মানুষ হয়ে ওঠার গোপন মন্ত্র। জেনে নিতে হয় কি করে ভালোবাসতে হয় অকাতরে। সকলের প্রতি ভালোবাসা উজার করে দিতে না পারলে; ভালবাসি বলা কি সত্যি যায়!

জীবনের পথচলায় প্রতিনিয়ত সেই সব মানুষ রতনই তো খুঁজে বেড়াই। তাদের কাছ থেকে যদি কি করে ভালোবাসতে হয় সেই বিদ্যা শিখে নেয়া যায়; এই বাসনায়। কিন্তু অবিদ্যায় অন্ধ আমি তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারি না-চিনে উঠতে পারি না সকল সময়। যে অবিদ্যা জন্মান্তর ধরে মাথায় নিয়ে ঘুরছি তার জন্যই হয়তো নিজেকে নিবেদন করতে পারি না।

প্রকৃত বিবেচনায় আমি আসলে গুরুর সন্ধানে কখনো কোথাও ঘুরি নাই। শুনতে একটু খটকা লাগলেও কথা সত্য। আমি কেবল লালন ফকিরের সন্ধানেই ঘুরেছি-ঘুরছি-বেঁচে থাকলে আগামীতেও ঘুরবো। ফকিরকে খুঁজতে গিয়ে জেনেছি সেই ফকিরকে খুঁজতে গেলে আরেকজন ফকিরকে ধরতে হবে; তিনিই দিবেন তাঁর সন্ধান।

কিন্তু মনের মতো ফকির আর পেলাম কই? তার আগে অবশ্য পরিস্কার করা প্রয়োজন মন’কে কি বুঝতে পেরেছি? নিজের মনকেই ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি আর সেই মন কেমন ফকির খোঁজে সেটাই বা বুঝবো কেমন করে? সে এক আজব ভুলভুলাইয়্যা। যার প্রবেশপথ খুঁজে পাওয়া গেলেও ভেতরে ঢুকলেই সব তালগোলা পাকিয়ে যায়।

আর এই খোঁজাখুঁজিতে কতই না বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হলো। সেসবের সকলই যে সুখকর তা তো নয়। হতাশার গল্পও কম নয়। হতাশার গল্প-কাহিনী লিখতে-বলতে বা শুনতে ইচ্ছা করে না। তারপরও আশার সাথে হতাশাও তো জীবনেরই অঙ্গ। তাকেও তো অস্বীকার করা যায় না।

গবেষকরা যখন লালন ফকিরকে হিন্দু বা মুসলমান বানাতে চায় তখন বিষয়টা হাস্যকর লাগলেও। হতাশ লাগে যখন কোন কোন সাধকদের মাঝেও এই বিষয়টা লক্ষ করি। যখন দেখি সাধকরাও লালন সাধনে নিজ নিজ ধর্মমতকে প্রতিষ্ঠায় রত হয়।

কৌশলে লালন ফকিরের মতাদর্শে নিজ নিজ শব্দ-ভাষার প্রয়োগ, আচার-নিয়মে নিজ নিজ বিশ্বাসের চর্চা যুক্ত করার বিষয়টি প্রথমিকভাবে মনে হতো নদীর স্রোতের মতোই স্বাভাবিক পরিবর্তন। কিন্তু যৎসামান্য শিকড় ছুঁতে গিয়ে মনে হলো বিষয়টা অযতনে হয়নি। সুচতুর ভাবেই ঘটেছে।

অন্ধকার নামতে শুরু করলে চালক নিজেই বললো, ভাইজান এই রাস্তায় আজ আর গাড়ি আসবো বইলা তো মনে হয় না। তার উপর সন্ধ্যা লাইগা গেছে। আমার বাড়ি এই পথে তাই আসছিলাম। আপনেরা কতক্ষণ দাঁড়ায়া থাকবেন।

আর যে সময়কালে এই পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছে তাও বেশি আগের কথা না। সেই সময়কালটা খেয়াল করলে ধারণাটিকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। তবে ফকির লালন সাঁইজি, যিনি প্রথাগত ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি কোনো ধর্মের মোড়কে নিজ মতাদর্শকে আবদ্ধ করবেন সেটা ভাবতে একটু খটকা লাগেই, কি আর করা।

আবার কোনো কোনো সাধকের ভক্তদের চোখে কামের তীব্রতাও তাদের সাধন-ভজন নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন দাঁড় করায়। প্রেমিক হতে গিয়ে কি তারা কামুক হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ডানা মেলে। তাদের সাথে কথা বলতেও গা গুলিয়ে উঠে বেশিরভাগ সময়।

আবার কোথাও নেশাকেই নেয়া হয়েছে মূল সাধন হিসেবে। দিবারাত্রিই তারা সিদ্ধিতেই মজে থাকে। তবে একথা অস্বীকার করবো না সিদ্ধিসেবীদের মাঝে প্রেমভাব সবচেয়ে বেশি। আমার চলাচল কম হতে পারে। হতে পারে আমি খুব কম ঘরেই গিয়ে উঠতে পেরেছি।

সেই বিবেচনায় অনেকেই হয়তো আমার সাথে এ বিষয়ে একমত হবেন না। তবে সে যাই হোক আমি এখন পর্যন্ত তাদের মাঝেই সবচেয়ে বেশি উজার করা প্রেম পেয়েছি।

কিন্তু জ্ঞানচর্চার আখড়া আজও পেলাম না। শুদ্ধজ্ঞান চর্চার বড় অভাব বলেই মনে হয় মাঝে মাঝে। আবার এও মনে হয়, মনে প্রকৃত প্রেম ভাবের উদয় না হলে হয়তো সেই জ্ঞানের আসরের আমন্ত্রণই মিলে না। কি জানি বুঝি নাগো তোমার লীলাখেলা সাঁইজি।

একবার এক আখড়ায় গেলাম। সে আখড়ার সাধু কারো সাথেই কথা বলেন না। উদাস দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ-বিটাৎ এক আধটা কথা বললে বলেন, না বললে নাই। আলো-আধারিতে বেশ কয়েকজন লোক গোঁসাইকে ঘিরে বসে আছেন। এক কোণে আমিও বসে পরলাম।

কেউ কোনো কথা বলছে না সবাই চুপচাপ বসে আছে। নিবেদন সংগীত শেষে সন্ধ্যা আরতির পর প্রসাদ নিয়ে লোকজন চলে গেলো। যন্ত্রী আর আখড়ার লোকজন গেলো রাতের সেবার আয়োজন করতে।

ফাঁকা পেয়ে একটু এগিয়ে বসলাম। আলো আধারিতে সাধু আমার দিকে অর্ন্তভেদি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছিল। চোখ ফিরিয়ে নেবো, তখন আর সে সুযোগ নেই। চোখে চোখ পরে গেছে। তবে সাধক আসলেই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নাকি তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন অন্তহীন কোনো জগতে সেটা বোঝা গেল না।

আমরা যাচ্ছিলাম এক সাধুর বাড়ি। কিন্তু টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জল বেড়ে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় বিপত্তি বেঁধেছে। বেবীট্যাক্সীর ইঞ্জিনে জল ঢুকে বন্ধ হয়ে গেছে মাঝপথে। বাকিরা আশপাশের বাসিন্দা হওয়ায় তারা হাঁটা দিয়েছে। আমরা বেবীট্যাক্সী ঠিক হওয়ার আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় রইলাম। কারণ আমাদের যেতে হবে অনেকটা পথ।

অন্ধকার নামতে শুরু করলে চালক নিজেই বললো, ভাইজান এই রাস্তায় আজ আর গাড়ি আসবো বইলা তো মনে হয় না। তার উপর সন্ধ্যা লাইগা গেছে। আমার বাড়ি এই পথে তাই আসছিলাম। আপনেরা কতক্ষণ দাঁড়ায়া থাকবেন।

যদি আপনাগো সমস্যা না হয় তাইলে ঐ সামনের মোড়ের রাস্তা দিয়ে একটু আগায়া যান ওখানে গোঁসাইয়ের আখড়া আছে। সেখানে গিয়া বসেন। গাড়ি ঠিক হইলে ডাক দিবনে। সঙ্গীটি সেখানেই রয়ে গেলো। আমি পায়ে পায়ে গোঁসাইয়ের আখড়ায়।

মূর্তির মতো বসে আছি গোঁসাইয়ের সামনে। কখন জানি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে আখড়ার প্রধান সেবক তা খেয়াল করতে উঠতে পারি নি। গোঁসাই যখন হাত দিয়ে আমাকে দেখিয়ে তাকে কিছু ইশারা করলেন। তখন মাথা ঘুরিয়ে তাকে আবিষ্কার করলাম।

তিনি আমাকে নমস্কার করে বললেন দাদা আসেন চোখে-মুখে জল দিয়ে নিন। গোঁসাই আবার উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি সেবকের পিছু পিছু যেতে তিনি বললেন, গোঁসাই আপনার রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে বলছে। আপনার সাথে কেউ থাকলে ডেকে আনতে বলেছে। চোখে-মুখে জল দিল। একটু পরে সেবা দেয়া হবে।

ছইয়ের ভেতরে শুয়ে শুয়ে কীর্তন শুনতে শুনতে আমাদের যাত্রা চলছিল শান্ত বিলের উপর দিয়ে। কোথা থেকে আসছি আর কোথায়ই বা চলছি কে জানে। এই জটিল হিসেব কে কবে মেলাতে পেরেছে তাও বা কে জানে।

আদৌতেই বেবীট্যাক্সী ঠিক হলো না। চালক ঠেলতে ঠেলতে সেটা আখড়ায় এনে এক পাশে রেখে শহরের দিকে চলে গেলো। রাতে না হলেও সকালে মিস্ত্রী সাথে নিয়ে ফিরবে। আমরা পরিস্কার ধবধবে চাদর পাতা নরম তোষকে সেবা শেষে শুয়ে পরেছি। বাইরে থেকে বৃষ্টির শব্দ আসছে।

সঙ্গীটি বললো, দাদা! কিছু না বলতেই সাধু সবকিছু বুঝে কেমনে? আমি তো সেবা নেয়ার সময় অবাক হয়ে গেলাম তার কাণ্ডকীর্তি দেখে। ক্ষীরটা আরেকটু খাওয়ার বেশ ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারতেছিলাম না।

আমি খেয়াল করেছি গোঁসাই একবারও আমার দিকে তাকায় নি। তারপরও হাতের ইশারায় আমাকেই আবার ক্ষীর দিতে বললো। আমি তো তাজ্জব। সঙ্গীটি গোঁসাইয়ের একের পর এক কীর্তির কথা বলে যেতে লাগলো।

পরদিন বৃষ্টি আরো বাড়লো। সেদিনও আখড়াতেই থেকে গেলাম তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে। গোঁসাই মন্দিরের বারান্দায় বসে সারাদিন বৃষ্টি পড়া দেখে কাটিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘মন দিয়া দেখবা… চোখ দিয়া না…’।

তারপর উঠে মন্দিরে ঢুকে গেলেন। আমরা একে অন্যের দিকে তাকালাম। সঙ্গীটি নিচু স্বরে বলেই বসলো, দাদা দেখছেন সাধু ঠিকই বুঝতে পারছে আমরা কি ভাবতেছিলাম।

বৃষ্টি মাথায় নিয়েও এলাকার বেশকিছু মানুষ জড়ো হলো সন্ধ্যা আরতিতে। গোঁসাই কথা বলেছেন, এ জন্য রাতে বহু পদ দিয়ে সেবা হলো। পরদিন ঝরঝর রোদে বিদায় নেয়ার সময়, ইশারায় গোঁসাই কাছে ডাকলো।

একটা থলেতে বিভিন্ন ঘটিবাটি খুলে মুড়ি-মুড়কি, খৈ, নাড়ু, বিস্কুট, আপেল, কমলা, কলা, আঙ্গুর, পঞ্চাশ টাকার দুটি নোটের উপরে পুজার থালি থেকে তুলে গাদা-জবা ফুল দিয়ে আমার হাতে দিলেন। মাথায় হাত দিয়ে সেই দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বিদায় দিলেন।

আমরা গোঁসাইয়ের ঠিক করে দেয়া নৌকায় চেপে সাধুর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বেবিট্যাক্সি ঠিক হয় নাই। সেটা গ্যারেজে রেখে তার চালকও আমাদের সাথে নৌকায় চেপেছে। দুইদিন বাড়ি যায় নাই আজ যেতেই হবে।

সে নিজেও কীর্তন করে। গোঁসাইয়ের ভক্ত। কথা বলতে বলতে সাথের পুটলি থেকে মন্দিরাটা বের করে টুকটুক করে আমাদের গান গেয়ে শোনাতে লাগলো।

ছইয়ের ভেতরে শুয়ে শুয়ে কীর্তন শুনতে শুনতে আমাদের যাত্রা চলছিল শান্ত বিলের উপর দিয়ে। কোথা থেকে আসছি আর কোথায়ই বা চলছি কে জানে। এই জটিল হিসেব কে কবে মেলাতে পেরেছে তাও বা কে জানে।

কতশত মানুষের ভালোবাসা নিয়েও প্রেমিক না হয়ে উঠতে পারার যন্ত্রণা-বেদনা নিয়ে এই যে পথ চলা তাকে কি নাম দেয়া যায়? জানি না… বেশিদূর এসব ভাবতে পারি না… বিপন্ন মনে হয় নিজেকে…

কবে তাঁর সন্ধান পাব? যাঁর সন্ধানে এই ছুটে চলা… এই বয়ে চলা…। নাকি আমি গোঁসাইয়ের ভাষায় চোখ দিয়েই দেখছি সব… মন দিয়ে দেখতে পারছি না আদৌ…। গোঁসাই ভাবনায় নতুন তরঙ্গ যুক্ত করে সেই উদাস চোখে তাকিয়ে কি বলতে চেয়েছিল? কি বলতে চাইছে?? আর কি কি বলবে?

আর সেই সাধুর চোখ… যিনি আমাকে বার বার প্রশ্ন করে… আমি কে….। আর কিছুই ভাবতে পারি না। সব ভাবনাতেই জট পাকিয়ে একই বিন্দুতে মিলিত হয়। সেই বিন্দু… যে বিন্দুতে ভাবনার শুরু হয়েছিল…। ভাবনা আমাকে কোথাও পৌঁছাবে না জানি। তাই নিবেদিত হয়ে বলি-

জগৎ মুক্তিতে ভুলালেন সাঁই।
ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই।।

রাঙ্গাচরণ দেখব বলে
বাঞ্ছা সদায় হৃদকমলে,
তোমার নামের মিঠায় মন মজালে
রূপ কেমন তাই দেখতে চাই।।

ভক্তিপদ বঞ্চিত করে
মুক্তিপদ দিচ্ছো সবারে,
যাতে জীব ব্রহ্মাণ্ডে ঘোরে
কাণ্ড তোমার দেখতে পাই।।

চরণের যোগ্য মন নয়
তথাপি মন ওই চরণ চাই,
অধীন লালন বলে হে দয়াময়
দয়া কর আজ আমায়।।

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!