ভবঘুরেকথা
কথামালা বাউল ফকির সাধু

মোহন চাঁন বাউল

-শ্রী শঙ্কর পাল

শতাধিক বা তার কিছুবর্ষ পূর্বেকার কথা। তৎকালীন ইদিরপুর পরগনার অন্তর্গত বাখরগঞ্জের জমিদারীর অধীন আগা মেহেদী খাঁনের জমিদারী অঞ্চলে তারই নাম অনুসারে নামকরণ করা মেহেন্দিগঞ্জ নামে খ্যাত একটি বিশাল গ্রাম ছিল।

যা বর্তমানে বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নামে প্রসিদ্ধ। নদী বেষ্টিত এই ভূখণ্ডে ইলিসা নদীর পশ্চিম তীর ও মাসকাটা নদীর উত্তর তীর ঘেঁষা সে বিশাল গঞ্জটি এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তখনকার দিনে এ সমৃদ্ধ গ্রামে এক ঘর জমিদার(কাজী বাড়ি) সহ বেশকিছু অবস্থাসম্পন্ন ভদ্রলোক বাস করতেন।

সে সময় মাসকাটা নদীর কুল থেকে খানিকটা ভিতরে মোহন চাঁন বাউল নামে একজন বাকসিদ্ধ বৈষ্ণব, মহান যোগী ও অনেক অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন বাউল সন্ন্যাসী আখড়া বানিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতেন। তার আগমন কাল ও পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে কোন তথ্য ও কোন ধরনের ছবি সংরক্ষিত নেই।

থাকলেও উদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব। বাউল অযাচক বৃত্তি অবলম্বন করে আশ্রমে থাকতেন ও একখানি কাঁচা টিনের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরাধা-গোবিন্দ বিগ্রহের সেবা পুজা করতেন। এলাকায় মানুষ তাকে অনেক শ্রদ্ধা ভক্তি করত এবং মন্দিরে সেবার জন্য প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মানত ও ফল মূল ভোগ সামগ্রী দিয়ে যেতেন।

এছাড়া মন্দির বাড়িতে বেশ কয়েক একর জমি ছিল যা বিভিন্ন ফল-ফুল ও ফসলে পরিপূর্ণ থাকত। এ যেন পঞ্চবটী বন, ঠিক মুনি-ঋষির আশ্রম। প্রতি সন্ধ্যায় গঞ্জের বাসিন্দারা প্রার্থনা ও আরতির জন্য মন্দিরে আসতেন। বউলজী অনেক রাত পর্যন্ত তাদের শাস্ত্রকথা ও ধর্মোপদেশ দিতেন। নিজ যোগ বিভুতি কখনো প্রকাশ করতেন না।

চৈত্র-বৈশাখ মাসে আমাদের এ অঞ্চলে এখনকার মত সে সময়েও ভারতের জৈনপুর হতে গৌড়ের মৌলানা সাহেবগণ বজরায় (আবাসিক নৌকা) করে আসতেন। তারা ওয়াজ মাহফিল করতেন এবং গ্রামের বালা মসিবত দূর করার জন্য দোয়া দরুদ পাঠ করতেন।

এর পরে মৌলানা সময় করে আখড়ায় আসতেন আবার বাউলও বজরায় যেয়ে দেখা করতেন। মোহন চাঁন বাউলের এক শিষ্য রামানন্দ চাঁদপুরের পুরান বাজারে বাস করতেন। সে তার বাড়িতে সবরিকলার গাছ লাগিয়েছেন। মানত ছিল কলা পাঁকলে গুরুকে নেমন্তন্ন করে এনে সেবা করাবেন।

গঞ্জবাসী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাদের জন্য নজরানা হিসেবে ফল-মূল টাকা-পয়সা নিয়ে দেখা করে যেত ও দোয়া তদবির আনত। এখনো তারা আসেন মানুষ তাদেরকে সে একইভাবে সম্মান দেয়।

সে সময়ে একদা একজন মৌলানা মেহেন্দিগঞ্জ এসে বাউলের আখড়া বাড়ির দক্ষিণ দিকে নদীর ঘাটে বজরা লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। স্থানটি অতিশয় মনোরম দেখে বেশ ক’দিন এখানেই আছেন। তখন ছিল শুক্লপক্ষ। এক রাতে নদী আর বনের কিনারে জোৎস্না উপচে পরছিল।

দক্ষিণের মৃদু বাতাস গ্রীষ্মের রাতে শীতলতায় ভরে দিচ্ছিল। মৌলানা সাহেব বজরার ভেতরে আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিলেন। বজরার নাবিক ও লস্কর আর বাবুর্চি বজরার ছাদের উপরে শুয়ে বসে গালগল্প করতেছিল। এমন সময় তারা কাছেই নদীতে বেশ দুর্গন্ধ পেয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখতে পেল একটি মৃত লাশ এসে বজরার নোঙ্গরের দড়ির সাথে লেগে আছে।

তারা লগি বাঁশের সাহায্যে উহা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলে তা আবার উজানে ভেসে এসে আগের মতই দড়িতে লেগে যাচ্ছে। লস্করেরা আশ্চর্য হয়ে মওলানার নিকটে যেয়ে বিষয়টি তাকে জানাল। মৌলানা সাহেব খানিকটা চোঁখ বন্ধ করে থেকে হেসে দিয়ে উঠে এলেন।

লস্করদের বললেন, ওরে তোমরা বাউলকে ধরে বজরায় তুলে আন। এবার বাউল লাশ থেকে এক দীব্য মানুষ হয়ে উঠে বজরায় এসে মৌলানার কাছে এলেন। দু’জনে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন, কুশল বিনিময় করলেন। লস্করগণ সেসব কথার ভাষা আমল করতে পারছিল না।

এর পরে মৌলানা সময় করে আখড়ায় আসতেন আবার বাউলও বজরায় যেয়ে দেখা করতেন। মোহন চাঁন বাউলের এক শিষ্য রামানন্দ চাঁদপুরের পুরান বাজারে বাস করতেন। সে তার বাড়িতে সবরিকলার গাছ লাগিয়েছেন। মানত ছিল কলা পাঁকলে গুরুকে নেমন্তন্ন করে এনে সেবা করাবেন।

আঠারো শতাব্দীর শেষ ভাগে এই মহান যোগী বাউল যিনি বাঁচা ও মরার নিয়মকে অতিক্রম করে পরমাত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন একদা তিনি সকল ভক্ত শিষ্যের সামনে পরমাত্মার সাথে মিশে গেলেন।

গাছে বেশ পুষ্ট ক’ কাঁদি কলা ধরেছে। পাঁকার সময় হলে রামানন্দ বাউলকে ষ্টীমারে লোকের মারফত তারিখ দিয়ে নেমন্তন্ন পাঠাল। কিন্তু বাউল গেল না। রামানন্দ রাগান্বিত হয়ে ঐ কলা একটি একটি করে বসে গুরুনামে নিবেদন করে খেতে শুরু করল এবং সব কলা খেয়ে ফেললো।

তখন আষাঢ় মাসে কি যেন একটা অনুষ্ঠানে আখড়া বাড়িতে বেশ লোকের উপস্থিতি। সন্ধ্যার পরে বাউল হঠাৎ করে বমব করতে শুরু করে দিল। সেবক দর্শনার্থী দৌড়ে গিয়ে দেখল বাউল কলা বমন করছেন আর বলছেন ওরে রামা এবার থামা। আর খাসনে শালা থাম নইলে বাঁচবো না।

আর দু’ একটি ঘটনা বলে শেষ করব। একবার পার্শ্ববর্তী কাজী সাহেবের কিছু অনুচর আখড়ার সিমানার কাছাকাছি রাতের বেলায় গরু এনে জবেহ করে। বাউল সব দেখতে পেয়েও কোন প্রতিবাদ করেনি। ভোরে গ্রামের কেহ তাকে জানালে উত্তরে বলেন, ওরা পাগলের বংশধর ওদের কি বলব।

দেখা গেল তাদের সব ক’জনই পাগল হয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে গেল। আজ পর্যন্ত সেই বংশে দু’ একজন পাগল সবাই দেখে আসছে। আর একটি ঘটনা বলে কাহিনীর সমাপ্তি টানব।

একবার কিছু চোর বাউলের বাগানে কাঁঠাল চুরি করতে গেল। যে যেই কাঁঠাল হাতে স্পর্শ করেছে সে সেই কাঁঠালের সাথেই আটকে রয়েছে। পরে রাত পোহাতে লোকজন দেখে বাউলের নিকটে যেয়ে ক্ষমা চাইলে তাদের মুক্ত করে সকলকেই একটা দুটা কাঁঠাল দিয়ে দেন।

আঠারো শতাব্দীর শেষ ভাগে এই মহান যোগী বাউল যিনি বাঁচা ও মরার নিয়মকে অতিক্রম করে পরমাত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন একদা তিনি সকল ভক্ত শিষ্যের সামনে পরমাত্মার সাথে মিশে গেলেন।

বরিশাল শহরের রূপালী বাসস্ট্যান্ডের পার্শে তার একটি আশ্রম আজো বর্তমান রয়েছে।

………………………………….
-শ্রী শঙ্কর পাল
মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১

জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!