ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮১, ৩রা ডিসেম্বর
শ্রীরামকৃষ্ণ মনোমোহন-মন্দিরে
কেশব সেন, রাম, সুরেন্দ্র, রাজেন্দ্র মিত্র, ত্রৈলোক্য প্রভৃতি সঙ্গে

শ্রীযুক্ত মনোমোহনের বাটী; ২৩নং সিমুলিয়া স্ট্রীট; সুরেন্দ্রের বাটীর নিকট। আজ ৩রা ডিসেম্বর; শনিবার, ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ (১৯শে অগ্রহায়ণ, ১২৮৮)।

শ্রীরামকৃষ্ণ বেলা আন্দাজ ৪টা সময় শুভাগমন করিয়াছেন। বাটীটি ছোট – দ্বিতল – ছোট উঠান। ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে উপবিষ্ট। একতলা ঘর – গলির উপরেই ঘরটি।

ভবানীপুরের ঈশান মুখুয্যের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন।

ঈশান – আপনি সংসারত্যাগ করিয়াছেন কেন? শাস্ত্রে সংসার আশ্রমকে শ্রেষ্ঠ বলেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি ভাল কি মন্দ অত জানি না; তিনি যা করান তাই করি, যা বলান তাই বলি।

ঈশান – সবাই যদি সংসারত্যাগ করে, তাহলে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করা হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সব্বাই ত্যাগ করবে কেন? আর তাঁর কি ইচ্ছা যে, সকলেই শিয়াল-কুকুরের মতো কামিনী-কাঞ্চনে মুখ জুবরে থাকে? আর কি কিছু ইচ্ছা তাঁর নয়? কোন্‌টা তাঁর ইচ্ছা, কোন্‌টা অনিচ্ছা কি সব জেনেছ?

“তাঁর ইচ্ছা সংসার করা তুমি বলছ। যখন স্ত্রী পুত্র মরে তখন ভগবানের ইচ্ছা দেখতে পাও না কেন? যখন খেতে পাওনা – দারিদ্র – তখন ভগবানের ইচ্ছা দেখতে পাও না কেন?

“তাঁর কি ইচ্ছা মায়াতে জানতে দেয় না। তাঁর মায়াতে অনিত্যকে নিত্য বোধ হয়, আবার নিত্যকে অনিত্য বোধ হয়। সংসার অনিত্য – এই আছে এই নাই কিন্তু তাঁর মায়াতে বোধ হয়, এই ঠিক। তাঁর মায়াতেই আমি কর্তা বোধ হয়; আর আমার এই সব স্ত্রী-পুত্র, ভাই-ভগিনী, বাপ-মা, বাড়ি-ঘর – এই সব আমার বোধ হয়।

“মায়াতে বিদ্যা অবিদ্যা দুই আছে। অবিদ্যার সংসার ভুলিয়ে দেয় আর বিদ্যামায়া – জ্ঞান, ভক্তি, সাধুসঙ্গ – ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়।

“তাঁর কৃপায় যিনি মায়ার অতীত, তাঁর পক্ষে সব সমান – বিদ্যা অবিদ্যা সব সমান।

“সংসার আশ্রম ভোগের আশ্রম। আর কামিনী-কাঞ্চন ভোগ কি আর করবে? সন্দেশ গলা থেকে নেমে গেলে টক কি মিষ্টি মনে থাকে না।

“তবে সকলে কেন ত্যাগ করবে? সময় না হলে কি ত্যাগ হয়? ভোগান্ত হয়ে গেলে তবে ত্যাগের সময় হয়। জোর করে কেউ ত্যাগ করতে পারে?

“একরকম বৈরাগ্য আছে, তাকে বলে মর্কট বৈরাগ্য, হীনবুদ্ধি লোকের ওই বৈরাগ্য হয়। রাঁড়ীপুতি (বিধবার ছেলে), মা সুতা কেটে খায় – ছেলের একটু কাজ ছিল, সে কাজ গেছে – তখন বৈরাগ্য হল, গেরুয়া পরলে, কাশী চলে গেল। আবার কিছুদিন পরে পত্র লিখছে – আমার একটি কর্ম হইয়াছে, দশ টাকা মাহিনা; ওরই ভিতর সোনার আংটি আর জামা-জোড়া কেনবার চেষ্টা করছে। ভোগের ইচ্ছা যাবে কোথায়?”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!