ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮১, ১০ই ডিসেম্বর
রাজেন্দ্রের বাড়ি

অনেকগুলি ব্রাহ্মভক্ত আসিয়াছেন দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন –

“ব্রাহ্মসভা না শোভা? ব্রাহ্মসমাজে নিয়মিত উপাসনা হয়, সে খুব ভাল; কিন্তু ডুব দিতে হয়। শুধু উপাসনা, লেকচারে হয় না। তাঁকে প্রার্থনা করতে হয়, যাতে ভোগাসক্তি চলে গিয়ে তাঁর পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়।

“হাতির বাহিরের দাঁত আছে আবার ভিতরের দাঁতও আছে। বাহিরের দাঁতে শোভা, কিন্তু ভিতরের দাঁতে খায়। তেমনি ভিতরে কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করলে ভক্তির হানি হয়।

“বাহিরে লেকচার ইত্যাদি দিলে কি হবে? শকুনি উপরে উঠে কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। হাওয়াই হুস করে প্রথমে আকাশে উঠে যায় কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে যায়।

“ভোগাসক্তি ত্যাগ হলে শরীর যাবার সময় ঈশ্বরকেই মনে পড়বে। তা না হলে এই সংসারের জিনিসই মনে পড়বে – স্ত্রী, পুত্র, গৃহ, ধন, মানসম্ভ্রম ইত্যাদি। পাখি অভ্যাস করে রাধাকৃষ্ণ বোল বলে। কিন্তু বেড়ালে ধরলে ক্যাঁ ক্যাঁ করে।

“তাই সর্বদা অভ্যাস করা দরকার। তাঁর নামগুণকীর্তন, তাঁর ধ্যান, চিন্তা, আর প্রার্থনা – যেন ভোগাসক্তি যায় আর তোমার পাদপদ্মে মন হয়।

“এরূপ সংসারী লোক, সংসারে দাসীর মতো থাকে, সব কর্ম কাজ করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপর মন রেখে কর্মগুলি করে। সংসার করতে গেলেই গায়ে পাঁক লাগে। ঠিক ভক্ত সংসারী পাঁকাল মাছের মতো, পাঁকে থেকেও গা পাঁকশূন্য।

“ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। তাঁকে মা বলে ডাকলে শীঘ্র ভক্তি হয়, ভালবাসা হয়।”

এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ গান ধরিলেন:

শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়িখানা উড়িতেছিল।
কলুষের কুবাতাস খেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।।

গান – যশোদা নাচাতো গো মা বলে নীলমণি
সে বেশ লুকালি কোথা করালবদনি।।

ঠাকুর উঠিয়া নৃত্য করিতেছেন ও গান গাহিতেছেন। ভক্তেরাও উঠিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ মুহুর্মুহু সমাধিস্থ হইতেছেন। সকলেই একদৃষ্টে দেখিতেছেন আর চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়াইয়া আছেন।

ডাক্তার দুকড়ি সমাধি কিরূপ পরীক্ষা করিবার জন্য চক্ষে আঙুল দিতেছেন। তাহা দেখিয়া ভক্তেরা অতিশয় বিরক্ত হইলেন।

এ অদ্ভুত সংকীর্তন ও নৃত্যের পর সকলে আসন গ্রহণ করিলেন। এমন সময় কেশব আরও কয়েকটি ব্রাহ্মভক্ত লইয়া আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

রাজেন্দ্র (কেশবের প্রতি) – চমৎকার নৃত্যগীত হল।

এই কথা বলিয়া শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যকে আবার গান গাহিতে অনুরোধ করিলেন।

কেশব (রাজেন্দ্রের প্রতি) – যখন পরমহংস মশায় বসেছেন, তখন কোনমতে কীর্তন জমবে না।

গান হইতে লাগিল। ত্রৈলোক্য ও ব্রাহ্মভক্তেরা গান গাহিতে লাগিলেন:

মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
হরি হরি হরি বলে ভবসিন্ধু পারে চল।।
জলে হরি, স্থলে হরি, চন্দ্রে হরি, সূর্যে হরি,
অনলে অনিলে হরি, হরিময় এ ভূমণ্ডল।।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তদের খাওয়ার জন্য দ্বিতলে উদ্যোগ হইতেছে। এখনও তিনি প্রাঙ্গনে বসিয়া কেশবের সহিত কথা বলিতেছেন। রাধাবাজারের ফটোগ্রাফারদের ওখানে গিয়াছিলেন – সেই সব কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি সহাস্যে) – আজ বেশ কলে ছবি তোলা দেখে এলুম। একটি দেখলুম যে শুধু কাচের উপর ছবি থাকে না। কাচের পিঠে একটা কালি মাখিয়ে দেয়, তবে ছবি থাকে। তেমনি ঈশ্বরীয় কথা শুধু শুনে যাচ্ছি; তাতে কিছু হয় না, আবার তৎক্ষণাৎ ভুলে খায়; যদি ভিতরে অনুরাগ ভক্তিরূপ কালি মাখান থাকে তবে সে কথাগুলি ধারণা হয়। নচেৎ শুনে আর ভুলে যায়।

এইবার ঠাকুর দ্বিতলায় আসিয়াছেন। সুন্দর কার্পেটের আসনে তাঁহাকে বসান হইল।

মনোমোহনের মাতাঠাকুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবী পরিবেশন করিতেছেন। মনোমোহন বলিয়াছেন – “আমার স্নেহময়ী জননী সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন ও ঠাকুরকে খাওয়াইলেন।” রাম প্রভৃতি খাবার সময় উপস্থিত ছিলেন।

যে ঘরে ঠাকুর খাইতেছেন, সেই ঘরের সম্মুখের দালানে কেশব প্রভৃতি ভক্তরা খাইতে বসিয়াছেন।

ওই দিবসে বেচু চাটুজ্যের স্ট্রীটের ৺শ্যামসুন্দর বিগ্রহের সেবক শ্রীশৈলজাচরণ চাটুজ্যে উপস্থিত ছিলেন। ইনি কয়েকমাস হইল পরলোকগত হইয়াছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!