ভবঘুরেকথা
আফালে গাগলাজোড়

-মূর্শেদূল মেরাজ

১৩৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বাজারের নাম লিপসা কেন হলো তা আর জানা হলো না। কেউ সঠিক করে কিছু বলতেই পারলো না। বিশাল এই বাজারে হাট বসে প্রতি শনিবার। বিশা্ল সেই যৌলুশ দেখতে পেলাম না। তার উপর বৃষ্টি ও শুক্রবার জুম্মার জন্য প্রায় বন্ধ বাজার। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক গ্রামে বাজার ঘুড়ে দেখবার মজাই আলাদা। কিন্তু এখানেও বিধিবাম… শাহীন ভাই আমাদেরকে চোখের আড়াল হতে দেবেন না কিছুতেই।

কি আর করা বাজার ঘোরা বাদ দিতে হলো। তিনি ডুবো তেলে সিলভার কার্প আর বড় বড় চিংড়ি ভাজিয়ে রেডি করছেন ; দুপুরের খাবার হবে গলা ডুবিয়ে। কিন্তু ডুবো তেলের তেল দিয়ে প্লেট ভেসে যাওয়ায় খুব যুইত করে খেতে পারলাম না। অন্যদের তেল খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। তারা খেয়ে চললো। আসলে ক্ষিদেটাও লেগেছিল জমিয়ে।

খাবার পরে চা পান এই বৃষ্টিতে বিলাশিতা নয় প্রয়োজন। তারপরও সবাই অবশ্য আগ্রহি নয় চা পানে। অন্যরা ট্রলারে ফিরে গেলেও আমি শাহীন ভাই, বাবু ভাই আর মাঝি গেলাম চায়ের দোকানে।

কিন্তু মানুষের ক্লান্তি নেই। চায়ের দোকানের এক মুরব্বী আমাদের কথা স্ববিস্তারে শুনে ভারিক্কি গলায় বললো মা দূর্গা এবার নৌকায় আসতেছেন তাই এই বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আর কমবে না। সব ভাসায়া দিবে।

পথেঘাটে সকল মানুষের একই প্রশ্ন আমরা কোথা থেকে আসছি আর কোথায় যাচ্ছি। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই এই অঞ্চলে। সকলেই বেশ আগ্রহী। অনেকে ইংরেজিতেও আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে। কিন্তু শেষ রাতের কিছু অভিজ্ঞতার ফলে উত্তর দিতে বেশি উৎসাহ বোধ করছি না আমরা কেউ। কিন্তু মানুষের ক্লান্তি নেই। চায়ের দোকানের এক মুরব্বী আমাদের কথা স্ববিস্তারে শুনে ভারিক্কি গলায় বললো মা দূর্গা এবার নৌকায় আসতেছেন তাই এই বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আর কমবে না। সব ভাসায়া দিবে।

এতোক্ষণে বৃষ্টি কিছুটা ধরে আসলেও আকাশের অন্ধকার কাটেনি এক ফোটা। এই উত্তাল ঢেউ-এর মধ্যেই সকলে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে, কেবল আমি আর এগুতে চাই না, আমি ফিরে যেতে চাই। আমি চাইছিলাম আমাকে এমন কোথাও নামিয়ে দেয়া হোক যেখানে থেকে আমি সড়ক পথে ফিরতে পারবো। যাতে অন্যদের ট্রিপটা নষ্ট না হয়। যারা যেতে চায় তারা যাক।

সকলের মন খারাপ হয়ে গেলো। মাঝিরাও খুব বেশি উৎসাহী নয় এগিয়ে যেতে। কারণ সামনে কূল কিনারা হারা হাওর। সেখানে বিপদে পরলে কিচ্ছু করার থাকবে না। এখন না যাওয়াই উত্তম ; তবে আমরা বললে তারা যাবে। শাহীন ভাই সকলের সিদ্ধান্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন। তখন নিজেকে বেশ অপরাধী লাগছিল কারণ সকলেই চাইছে এগিয়ে চলতে… আমার জন্য অন্যদের আনন্দ নষ্ট হবে সেটা ভাবতেও বেশ খারাপ লাগছিল।

কিন্তু আমার যাওয়ার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না এই আবহাওয়ায়। নিজেকে অসহায় করে দিয়ে ভ্রমণে কি মজা? সকলের জন্য কি এটুকু আমার করা উচিৎ? কিন্তু মন কিছুতেই স্বায় দিচ্ছিল না। অগত্যা সকলের বিপরীতে আমিই একমাত্র বললাম এগিয়ে আমি যাচ্ছি না। সকলের মুখ কালো হয়ে গেলো। শাহীন ভাইয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় সবাই। শেষে শাহীন ভাই আমার কথা বিবেচনা করে মাঝীদের বললো এমন একটা গ্রামে আমাদের নিয়ে যাও যেখানে আমরা আজ রাতে থাকতে পারবো।

খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে রাতের। আর জায়গাটা যেনো সুন্দর হয়। অন্য কেউ আর উচ্চবাচ্চ করলো না। মোজাম্মেল মাঝি বিজ্ঞের মতো ভেবে উত্তর দিলো তবে তার গ্রাম গাগলাজোড়াতে যাওয়াই উত্তম। সেখান থেকে মোহনগঞ্জ প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ। গাগলাজোড় যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই, ফিরতি পথ ধরতে হচ্ছে আমাদের। তারমানে আমাকে এই ঢেউই দিয়ে আরো ঘণ্টা দেড় বা দুই যেতে হবে।

আমার আর এক মিনিটের পথও যাওয়ার ইচ্ছে নেই এই ঢেউ দিয়ে ; কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন আমার উপর সব সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। একদল মানুষ যারা অকূল হাওরে ঘুরতে এসেছে তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সিনেমার নায়ক হলে হয়তো হাওরের এই আফাল দেখেও বলে দিতাম সামনে এগিয়ে চলো যা হবার হবে। কিন্তু আমি তো সিনেমার নায়ক না। তাই মাঝির গ্রামে ফিরে যাওয়াটাই মেনে নিলাম। শুরু হলো যাত্রা আফালে গাগলাজোড় যাত্রা।

তিনিও আর দশটা বাঙালীর মতোই নিজেকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু না, সকলে তো আর আমাদের মতো স্বার্থপর হতে পারে না। মজিদ মাস্টার তেমনি একজন মানুষ। তিনি গ্রামে বসে এই বয়সেও স্বপ্ন দেখছেন ;

শাহীন ভাই শান্তনা দিতে লাগলো। বৃষ্টির শুরুতে বাতাস হয় তাই এতো ঢেউ। বৃষ্টির পর আর ঢেউ হবে না। আকাশ পরিস্কার হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না। আমি সকলের সান্তনা নিয়া ছৈয়ের ভেতরে যেয়ে ঘুমের আয়োজন করলাম। বাবু ভাই, ভাগ্নে মোহাম্মদ, ফরিদী ভাই, শরিফ, শাহীন ভাই ট্রিপ নষ্ট হওয়ায় নির্বাক। কারো মুখ আর দেখা যাচ্ছিল না। কি আর করা এই ভাবতে ভাবতে ঘুমের অভিনয় করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ঢেউ সত্য সত্যই আগের চেয়ে একটু কম এবার।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঝলমলে দিন। ট্রলার থেমে আছে কোন এক ঘাটে। ট্রলার থেকে বেড়িয়ে দেখলাম গাগলাজোড় গ্রাম। পানির উপর যেন ভাসছে এক খণ্ড লোকালয়… উচ্ছল সবুজ… উদ্বিপ্ত কিছু মানুষ… এই গ্রামের সাথে সড়কপথে যোগাযোগ থাকলেও তা মূলত শীতকালে, এখন গ্রাম আর বাজারটা শুধু জেগে আছে। রাস্তা হাওরের নিচে লুকিয়ে আছে কোথাও।

ইতিমধ্যে বাবু ভাই খুঁজে বের করেছে মজিদ মাস্টারকে। আমরাও গেলাম তার সাথে আলাপ করতে। ৭৪ বছর বয়সী মজিদ মাস্টার ‘ভাটি বাংলা’ নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এই গ্রামে। তিনিই এই স্কুলের প্রধানশিক্ষক। দীর্ঘদিন বিভিন্ন স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে ২০০৫ সালে চলে আসেন এই গ্রামে। প্রতিষ্ঠা করেন এই স্কুল। স্ত্রী গত হয়েছেন। পুত্ররা সকলেই প্রতিষ্ঠিত।

তিনিও আর দশটা বাঙালীর মতোই নিজেকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু না, সকলে তো আর আমাদের মতো স্বার্থপর হতে পারে না। মজিদ মাস্টার তেমনি একজন মানুষ। তিনি গ্রামে বসে এই বয়সেও স্বপ্ন দেখছেন ; নয়বছর যাবৎ যে সকল শিক্ষকরা বিনা বেতনে শুধু এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট খেয়ে স্কুলে ছাত্রদের শিক্ষাদান করছেন তাদের একদিন পূর্ণাঙ্গ বেতন দেবেন।

স্কুল এমপিও ভুক্ত হবে। স্কুলের নতুন নতুন ভবন হবে। গ্রামের শিশুরা সুশিক্ষা পাবে। আসলেই যেন উপন্যাস থেকে উঠে আসা এক চরিত্র মজিদ মাস্টার। মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতে শুনতে গ্রামের বাজার… বাজার থেকে চায়ের দোকান… ঘুরে ফিরে সময় কাটতে লাগলাম।

(চলবে…)

<<ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক ।। আফালে গাগলাজোড় : তিন>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
আফালে গাগলাজোড় : এক
আফালে গাগলাজোড় : দুই
আফালে গাগলাজোড় : তিন

………………………..
আরও পড়ুন-

ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!