ভবঘুরেকথা

তীর্থ ভ্রমণ ও মানব লীলা সম্বরণ
একদিন সে অশ্বিনী ভাবে মনে মনে।
সংসার বন্ধন আমি এড়াব কখন।।
এ সংসারে পুত্র কন্যা কেহ কারো নয়।
মায়ামহ ধুলা খেলা শুধু অভিনয়।।
অসার ভেবেছি সব হরি নাম সার।
যাহা দ্বারা হতে হবে ভবসিন্ধু পার।।
তাই ভবে সে অশ্বিনী করেছে চিন্তন।
হেনকালে তার নারী দিল দরশন।।
মালঞ্চ বলেছে তার স্বামীর নিকটে।
ছল ছল আখি দু’টি কহে করপুটে।।
দিবানিশি হরিগুণ গাহিয়া বেড়াও।
আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।।
রিতুবতী হইয়াছি রতি কর দান।
যদি কথা না রাখিবে তেজিব পরাণ।।
এক কন্যা জন্মিয়াছে তোমার ঔরসে।
এক পুত্র চাই আমি তোমার সকাশে।।
হেন বাক্য যখনেতে অশ্বিনী শুনিল।
মনে মেন সে অশ্বিনী ভাবিতে লাগিল।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
সে নিশি বঞ্চিল সেই নারীর কারণ।।
মনে ছিল পিতৃধন করিব যতন।
তাহা না হইল আমি নারীর কারণ।।
বিরহেতে দহিতেছে সাকরে হিয়া।
হরি হরি বলে সদা বেড়ায় কাঁদিয়া্।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ, করিয়া স্মরণ।
গৃহ হতে সে অশ্বিনী করিল গমন।।
মহানন্দ ছবিখানি রাখিয়া মনেতে।
ছল ছল আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।।
অনাহারে থাকি সদা হরি গুণ গায়।
এইভাবে হরিভক্ত পথ চলি যায়।।
ঘোর অন্ধকার হল নদীর কিনারে।
জনহীন নদীতটে ভাসে আখি নীরে।।
আঠার বাকি নদীতে খরস্রোত বয়।
রাত্রিবেলা বসে কাঁদে তার কিনারায়।।
পার হয়ে যাবে নদী ভাবে মনে মন।
নৌকা নাই পারে যেতে কি করি এখন।।
হরি বলে কাঁদিতেছে প্রেমিক অশ্বিনী।
নাম শুনে ভেসে ওঠে এক কুম্ভিরীনী।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী ঝাপ দিয়া পল।
হরি ভক্ত কাছে পেয়ে পৃষ্ঠেতে করিল।।
কুম্ভিরীনী হরিভক্ত পৃষ্ঠেতে করিয়া।
আখি জলে ভাসিতেছে জলেতে ভাসিয়া।।
ধীরে ধীরে কুম্ভিরীনী চলিতে লাগিল।
পৃষ্ঠে বসে সে অশ্বিনী মনেতে ভাবিল।।
এমন বন্ধন মোর আছে এ জগতে।
জলের কুম্ভির পার করেছে নদীতে।।
হরি বলে সে অশ্বিনী কাঁদিতে লাগিল।
মহাভাবে মহারত্ন জ্ঞান হারাইল।।
কুম্ভিরীনী আনন্দেতে ওপারেতে গেল।
অশ্বিনীকে কুলে রেখে জলেতে লুকাল।।
এইভাবে সে অশ্বিনী অচৈতন্য হয়ে।
সারানিশি নদীকুলে রহিলেন শুয়ে।।
যখনেতে হরিভক্ত উদয় হইল।
তখনেতে হরিভক্ত চৈতন্য পাইল।।
হরি বলে মহারত্ন করিল গমন।
প্রেমে গদগদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
পশ্চিম দিকেতে চলে বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত গিয়ে এক বাড়ী।।
জঙ্গলের মধ্যে সেই বাড়ীখানি হয়।
লোকজন কিছু নাই কি হবে উপায়।।
সেই ঘরে উঠিলেন অশ্বিনী গোঁসাই।
বসিবার স্থান আছে দেখিলেন তাই।।
সেই খানে বসিলেন হরি হরি বলে।
প্রেমেতে মাতিয়া রত্ন ভাসে আখি জলে।।
ক্ষুধায় কাতর হয়ে চারিদিকে চায়।
খাদ্য নিয়ে এক মেয়ে আসিল তথায়।।
খাদ্য বস্তু রেখে তথা সেই মেয়ে কয়।
তুমি বাবা হরিভক্ত বলি যে তোমায়।।
এই বনমাঝে মোরা থাকি দুইজন।
হরিভক্ত পেলে হই আনন্দিত মন।।
খাও বাবা হরিভক্ত এখানে থাকিয়া।
মম স্বামী কাছে যাই সেবার লাগিয়া।।
এত বলি সেই মেয়ে করিল গমন।
অশ্বিনী বসিয়া তথা করিল ভোজন।।
ভোজনান্তে সে অশ্বিনী শয়ন করিল।
ঘুমে অচেতন হয়ে তথায় বঞ্চিল।।
ভোরবেলা জেগে দেখে অশ্বিনী গোঁসাই।
সেইখানে ঘরবাড়ী কিছুইত নাই।।
মনে মেন সে অশ্বিনী কহিতে লাগিল।
তব লীলা গুরুচাঁদ বোঝে কেবা বল।।
ভকত হৃদিরঞ্জন করুনা নিদান।
তব লীলা বুঝিবারে নাহি মোর জ্ঞান।।
আমি বড় অভাজন এই দুনিয়ায়।
অপরাধ ক্ষমা করে রেখ রাঙ্গা পায়।।
ভক্তের পিছনে তুমি বেড়াও ঘুরিয়া।
আহার যোগায়ে ফের ভক্তের লাগিয়া।।
হরি বলে সে অশ্বিনী লাগিল কাঁদিতে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।।
এইভাবে পদব্রজে করিল গমন।
কাশি কাঞ্চি বৃন্দাবন করেছে ভ্রমণ।।
বহুদিন ঘুরে ঘুরে চলিতে লাগিল।
তারপর সে অশ্বিনী হরিদ্বার গেল।।
হরিদ্বারে বসে তার পিপাসা জাগিল।
তামাক খাইতে ইচ্ছা তখন হইল।।
মনে তার ইচ্ছা হল হুকা খাইবার।
বৃক্ষ তলে বসে বসে চিন্তা করে তার।।
হেনকালে এক ছেলে কোথা হতে এল।
তামাক সাজিয়া হুকা অশ্বিনীকে দিল।।
হুকা ধরি প্রাণ ভরি তামাক খাইল।
কিছু পরে সে বালক অদৃশ্য হইল।।
তাই জেনে হরিভক্ত কাঁদিয়া কহিল।
নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।।
তুমি প্রভু হরিচাঁদ কাঁদিয়া কহিল।
নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।।
তুমি প্রভু হরিচাঁদ বড় দয়াময়।
জানিয়া ভক্তের মন আসিলে হেথায়।।
জেনে মন ভগবান হুকটি সাজিয়া।
বালকের রূপে প্রভু গেলে হাতে দিয়া।।
চাকরেতে হেন কাজ করেনা কথন।
মনে জেনে তাই প্রভু দিলে দরশন।।
ভকত হৃদিরঞ্জন দয়াময় হরি।
ভক্তের হইয়া ভৃত্য কর্ম্ম যাও করি।।
কি দিব তুলনা তব ওগো দয়াময়।
দয়া করি অধমেরে রেখ রাঙ্গা পায়।।
মহাভাবে আত্মভোলা অশ্বিনী গোঁসাই।
হরি বলে দিবা নিশি ছাড়িতেন হাই।।
উদাসীন হরি ভক্ত হাটিতে লাগিল।
পায়েতে আঘাত লেগে মাটিতে পড়িল।।
আঘাত লাগিয়া পায় ক্ষত হয়ে গেল।
অতি কষ্টে হেটে হেটে নবদ্বীপে এল।।
মন্দিরেতে যে ঘটনা হইল সেথায়।
সেই সব লেখা আছে চরিত্র সুধায়।।
তারপর সে অশ্বিনী দেশে ফিরে এল।
শুড়িগাতী বালাবাড়ী উদয় হইল।।
পূর্ণচন্দ্র বালা অশ্বিনীর ভক্ত।
সেই বাড়ী গিয়ে তিনি হল উপনীত।।
দেখিয়া সে পূর্নচন্দ্র কাদিয়া উঠিল।
বহুদিন পরে গুরু দরশন হল।।
অশ্বিনীর দেহখানি অতি কৃশকায়।
তাই দেখে পূর্ণচন্দ্র কেঁদে কেঁদে কয়।।
শুন বাবা বলি তোমা ধরি তব পায়।
আমাদের ছেড়ে তুমি যেও না কোথায়।।
যত্ন করি অশ্বিনীকে ভোজন করাল।
তিন চারদিন সেই বালা বাড়ী রল।।
একদিন কহিলেন অশ্বিনী গোঁসাই।
শুন তুমি পূর্ণচন্দ্র বলি তব ঠাই।।
বহুদিন হেরিনাক মায়ের চরণ।
মম সঙ্গে চল তুমি করি দরশন।।
তাই শুনি পূর্ণচন্দ্র তরণী সাজাল।
নৌকাযোগে গঙ্গাচন্না উদয় হইল।।
নৌকা মধ্যে বসে আছে অশ্বিনী গোঁসাই।
তাই শুনে আসিলেন বাড়ীর সবাই।।
পুলিন বিপিন তারা বিমাতা নন্দন।
অশ্বিনীর মাতা এর করিয়া ক্রন্দন।।
মায়ের কোলেতে আছে অশ্বিনীর ছেলে।
অমূল্যকে কোলে করে ভাসে আখিজলে।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী কুলেতে নামিল।
মায়ের চরণ ধরি কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই।
বিদায় করহে মাগো শ্রীধামেতে যাই।।
পুলিন বিপিন এসে প্রণাম করিল।
হরি বলে সে অশ্বিনী আশীর্বাদ দিল।।
সকলেতে সুখে রও গৃহেতে থাকিয়া।
আমি ভাই চলে যাই বিদায় হইয়া।।
নয়নে হেরিয়া সেই আপন নন্দন।
মনবাঞ্ছা পুর্ণ হলে ঝরে দু’নয়ন।।
কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি নৌকায় উঠিল।
অমনি সে পূর্নচন্দ্র তরনী ভাসাল।।
পুনরায় শুড়িগাতী আসিলেন বেয়ে।
নৌকা হতে বালা বাড়ী উঠিলেন গিয়ে।।
ক্রমেই ঘায়ের ব্যাথা বাড়িতে লাগিল।
কাতরে অশ্বিন বলে ওড়াকান্দি চল।।
তাই শুনি পূর্নচন্দ্র অশ্বিনীকে নিয়ে।
নৌকাযোগে উতরিল আমড়িয়া গিয়ে।।
আমড়িয়া বাস করে শ্রীনীলরতন।
অশ্বিনীর প্রিয় শিষ্য জানে সর্ব্বজন।।
দেখে সে নীলরতন লাগিল কাঁদিতে।
অশ্বিনীকে কোলে করে লইল ঘরেতে।।
যত্ন করি তার নারী ধোয়াল চরণ।
ছলছল আখি দু’টি ঝরে দু’নয়ন।।
এইভাবে কয়দিন তথায় রহিল।
তাই দেখে পূর্ণচন্দ্র ঘরে ফিরে এল।।
সেই গ্রামে অশ্বিনীর যত ভক্ত ছিল।
একে একে সবে মিলে দেখিতে আসিল।।
দেখিলেন অশ্বিনীর অতি কৃশকায়।
সবে মিলে ভাবিলেন কি হবে উপায়।।
ক্রমেই ঘায়ের ব্যাথা বাড়িতে লাগিল।
অশ্বিনী বলেছে ওড়াকান্দি লয়ে চল।।
সে নীলরতন তাহা শুনিতে পাইয়া।
বড় এক নৌকা আনে জোগাড় করিয়া।।
নৌকায় ছাওনী বেঁধে আসন পাতিল।
অশ্বিনীকে কোলে করে নৌকায় শোয়াল।।
অশ্বিনীর কাছে বসে সে নীলরতন।
নৌকা বেয়ে চলে তারা আর তিনজন।।
নব গোঁসাই কার্ত্তিক আর বাবুরাম।
অশ্বিনীর প্রিয় ভক্ত সবে গুণধাম।।
হরি হরি বলে সবে তরণী বাহিল।
ওড়াকান্দি ঘাটে গিয়ে তরী ভিড়াইল।।
অন্তরেতে গুরুচাঁদ জানিয়া তখন।
নিজে তাই ঘাটে এসে দিলে দরশন।।
তখনি অশ্বিনী এসে চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
আমি এবে কি করিব বল প্রাণধন।।
গুরুচাঁদ বলে বাপ শুনরে অশ্বিনী।
এ জগতে চিরদিন বাঁচে কোন প্রাণী।।
এ সংসারে সব মিছে হরিনাম সার।
হরিনামে হয়ে যাবে ভবসিন্ধু পার।।
মিছে কেন চিন্তা কর ওহে বাছাধন।
তোমা সম হরিভক্ত আছে কোন জন।।
সঙ্গে যারা এসেছিল তাহাদের বলে।
অশ্বিনীকে নিয়ে যাও চাঁদসীতে চলে।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞামতে তাহাই করিল।
নৌকা বেয়ে কয়জনে সেখানে চলিল।।
সারারাত বেয়ে বেয়ে চাঁদসী পৌছাল।
ভোরবেলা ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াইল।।
সেই রাত্রে ডাকতার স্বপনে দেখেছে।
মোর কাছে এক মহামানব এসেছে।।
তার ঘরে পুত্র কন্যা কিছু হয় নাই।
পুত্র হবে তোর ঘরে বলিল গোঁসাই।।
ভোরবেলা ঘাটে এসে দেখিতে পাইল।
স্বপ্নে দেখা সে মানুষ ঘাটেতে আসিল।।
যত্ন করি অশ্বিনীকে ঘরেতে আনিল।
চরণ ধরিয়া শেষ কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই।
তব কাছে আসি আজ পুত্র বর চাই।।
স্বপনেতে তোমাকেই দেখিয়াছি আমি।
তব মুখে পুত্র বর দাও আজি তুমি।।
কান্না দেখে বলেছেন অশ্বিনী গোঁসাই।
তব ঘরে পুত্র হবে বলিলাম তাই।।
সঙ্গে যারা এসেছিল অবাক হইল।
পায়ের ঘায়ের কথা তাহাকে বলিল।।
তাই শুনি ডাকতার কহিল তখন।
মহারত্ন গুণনিধি সাধু শিরোমণি।।
ইচ্ছাতে করেছে রোগ আমি ভাল জানি।
তাই শুনে সে অশ্বিনী কহিল তখন।।
মোরে লয়ে চল সবে গুরুর ভবন।
তাই শুনে সবে মিলে নৌকায় তুলিল।।
হরি হরি বলে সবে নৌকা ছেড়ে দিল।
অর্ধপথে গিয়ে সেই অশ্বিনী গোঁসাই।
সে নীলরতন ধরে ছাড়িলেন হাই।।
হরি বলে সে অশ্বিনী কহিতে লাগিল।
মৃদুস্বরে কহে বাণী আখি ছলছল।।
আমি যদি চলে যাই পৃথিবী ছাড়িয়া।
গুরুপাশে রেখ মোরে যতন করিয়া।।
এত বলি মহারত্ন হরি হরি বলে।
হরিনাম করে আর ভাসে আখি জলে।।
হরি হরি হরি বলে ত্যাজীব জীবন।
বিদ্যুতের মত জ্যোতি উঠিল তখন।।
তাই দেখে সবে মিলে করে হায় হায়।
ব্রহ্মরন্ধ ফেটে গেছে দেখিবারে পায়।।
কেদে কেদে সবে মিলে ছাড়িতেছে হাই।
হেন রত্ন আর মোরা কোথা গিয়ে পাই।।
চলে গেলে ওগো বাবা মোদের ছাড়িয়া।
কেমনে থাকিব মোরা শোক পাসরিয়া।।
এইভাবে কেদে কেদে কাতর হইয়া।
ধীরে ধীরে চলিলেন তরনী বাহিয়া।।
শোক সম্বরিয়া সবে তরণী বাহিল।
নারিকেল বাড়ী এসে উপনীত হল।।
গ্রামবাসী সবে এসে কেদে ছাড়ে হাই।
হেন রত্ন ছেড়ে যাবে মনে ভাবি নাই।।
শোক নিবারণ করি সমাধি করিল।
তারপর গঙ্গাচন্না সংবাদ জানাল।।
সংবাদ পাইয়া সবে কাদিতে লাগিল।
পরিবারসহ কেদে আকুল হইল।।
তারপর সবে মিলে শোক পাসরিয়া।
সৎকাজ করিলেন সকলে মিলিয়া।।
সোনার মানুষ গেল জগৎ ছাড়িয়া।
হরিভক্ত কাঁদে সবে বিরলে বসিয়া।।
তেরশ তেত্রিশ সাল তিশরা আষাঢ়।
বুধবারে মহারত্ন ত্যাজিল সংসার।।
কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
সমাপ্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!