ভবঘুরেকথা

অশ্বিনীর সংসার জীবন
কবিগান ছেড়ে দিয়ে হরিগুণ গায়।
সংসারের অনটন কষ্টে দিন যায়।।
মা বাপের দুঃখ দেখে আনন্দ মনেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
এইভাবে সংসারের চলিতে লাগিল।
হরি সংগীতের গান লিখিয়া চলিল।।
নিজের হাতের লেখা মোটে ভাল নয়।
পাঠশালে শিখেছিলেন বর্ণ পরিচয়।।
ভদ্রকান্ত নামে ছিল খুড়তাত ছেলে।
অশ্বিনীকে ডাকিতেন দাদা দাদা বলে।।
তাহার হাতের লেখা অতীব সুন্দর।
তারে দিয়ে লেখাইত পাণ্ডুলিপি তার।।
এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
হরি লীলাগান সদা লিখিতে লাগিল।।
একদিন বলে তারে তার পিসিমাতা।
বিবাহ করিতে হবে শুন মোর কথা।।
পাড়া প্রতিবেশী সবে আত্মীয় স্বজন।
সকলের ইচ্ছা তুমি কর হে পূরণ।।
অশ্বিনী বলেছে আমি বিয়া না করিব।
বিবাহ করিলে আমি পাশ বব্ধ হ’ব।
মায়াজালে বন্দী হয়ে সংসারেতে র’ব।।
মধুমাখা হরিনাম ভুলিয়া যাইব।
তাই শুনি তার পিতা বলেছে বচন।।
সার কথা আমি তোমা বলিব এখন।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ এ ভব সংসারে।।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।
বুঝেও বোঝনা কেন হয়েছ দুর্বল।।
আমার কথায় তুমি বিবাহ করিলে।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি যাই বলে।।
পিতার আদেশ শুনি অশ্বিনী তখন।
বিবাহ করিতে তার হইলেন মন।।
কাননচক নিবাসী সঞ্জয় মন্ডল।
সত্যবাদী জ্ঞানীগুণী হৃদয় সরল।।
তার জ্যেষ্ঠা কন্যা হয় মালঞ্চ নামেতে।
অশ্বিনীর পরিণয় হল তার সাথে।।
এইভাবে সংসারের দিন কেটে যায়।
সংসারের কর্ম করে হরিগুণ গায়।।
কিছুদিন পরে সেই শুভ লগনেতে।
এক কন্যা জনমিল তাহার গর্ভেতে।।
তাই দেখে তার পিতা আনন্দ হৃদয়।
কোলে করে সেই কন্যা হরিগুণ গায়।।
বিমলা রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।
সন্তষ্ট হইল সবে সে নাম শুনিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী খাটে সংসারেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
অশ্বিনীর কাকা হয় নিজ বংশধর।।
অশ্বিনীকে ভালবাসে সেই মহাশয়।
তাহার জমিতে নিয়ে মজুরী খাটায়।।
বাল্যকালে সে অশ্বিনী পোদ্দার বাটিতে।
গরু চরাইত সদা বিশুদ্ধ মনেতে।।
অশ্বিনীর গুণ কথা মনেতে জানিয়া।
তাই তারে ভালবাসে নিকটে পাইয়া।।
অশ্বিনীকে বলিতেন শুন বাছাধন।
আমার জমিতে বসে করিও কীর্ত্তন।।
হরিনাম করিবারে মোর নাই মানা।
কিষাণের দাম আমি দিব ষোল আনা।।
কর্ম না করিলে আমি মূল্য তোমা দিব।
তোমার মুখেতে আমি ঐ নাম শুনিব।।
এক বন্দে দুই বিঘা জমি পরিমাণ।
সে জমিতে বসে করে হরি গুণগান।।
প্রতিদিন সে জমিতে অশ্বিনীকে নিয়ে।
হরি গুণগান করে জমিতে বসিয়ে।।
এইভাবে দুই মাস গত হয়ে গেল।
এক গাছ বল কভু মারা নাহি হল।।
আর যত জমি ছিল কিষাণ লইয়া।
আগাছার বল যত দিল নিড়াইয়া।।
সবে বলে কি দেখেছে পোদ্দার মশায়।
অই জমি ফাল যাবে জানিও নিশ্চয়।।
কর্ম না করিয়া যদি ফসল পাইবে।
তবে কেন মানুষেতে না খেয়ে খাটিবে।।
এইভাবে কত জনে কত কি বলিল।
যে যেমন বোঝে তাই কহিতে লাগিল।।
জলে মগ্ন হয়ে জমি বন পচে গেল।
তাহাতেই সেই ধান সতেজ হইল।।
শেষকালে দেখা গেল অন্য জমি হতে।
দ্বিগুণ ফলিল ধান নামের গুণেতে।।
হরিভক্ত মুখে শুনে হরি গুণগান।
দ্বিগুণ ফসল ফলে জগতে প্রমাণ।।
যারা যারা অশ্বিনীকে ঠাট্টা করেছিল।
তারা এসে অশ্বিনীর চরণে পড়িল।।
কেঁদে কেঁদে তারা সবে কহিছেন বাণী।
তুমি আজি ক্ষমা কর ওহে গুণমণি।।
অশ্বিনী বলেছে আমি কিছুই না জানি।
যার কাজ সেই করে হরি গুণমণি।।
পতিত তারিতে হরি এল এ জগতে।
হরিনামে পাপ তাপ সকলে নাশিতে।।
তাই শুনি তারা সবে হরি হরি বলে।
সেই দিন হতে তারা হরিভক্ত হলে।।
এইভাবে কেটে যায় সংসার জীবন।
সংসার করিতে তার নাহি লয় মন।।
দাম্পত্য জীবনে তার মোটে শান্তি নাই।
দুই ভাবে দু’টি প্রাণ মিলিয়াছে তাই।।
সংসার বিরাগী হয়ে ঘুরিয়ে বেড়ায়।
হরিচান্দ গুণগান গাহিত সদায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
জ্বর হয়ে তার পিতা ভূগিতে লাগিল।।
একদিন অশ্বিনীকে ডেকে এনে কয়।
শুন শুন রে অশ্বিনী বলি যে তোমায়।।
আনারস খেতে ইচ্ছা মনে জাগিতেছে।
এনে দাও আনারস বলি তব কাছে।।
পিতৃ বাক্য শুনি কানে অশ্বিনী তখন।
ভক্তি গদগদ চিত্ত ঝর দু’নয়ন।।
পিতৃভক্ত সে অশ্বিনী করিল গমন।
কোথা পাবে আনারস ভাবে মনে মন।।
অকালেতে আনারস কোথা গিয়ে পাই।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতেছে তাই।।
কভু যদি আনারস মিলাতে না পারি।
জীবন ত্যাজিব আমি বলে হরি হরি।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ রাখিয়া অন্তরে।
পথ বেয়ে চলে রত্ন আখি দু’টি ঝরে।।
অন্তরে জানিয়া তাহা হরি দয়াময়।
আনারস বাগানেতে তখনে জন্মায়।।
বড় বেড়ে রাস্তা গিয়া অশ্বিনী হাটিছে।
পাকা আনারস ঘ্রাণ নাকেতে লেগেছে।।
যেই দিকে ঘ্রাণ আসে সেই দিকে যায়।
গিয়ে সেই বাগানেতে দেখিবারে পায়।।
বড় এক আনারস গাছে পাকিয়াছে।
তাই দেখে সে অশ্বিনী মনেতে ভেবেছে।।
মালিকের কাছে গিয়ে কহিল তখন।।
শুন শুন মহাশয় আমার বচন।।
কয়দিন মোর পিতা জ্বরে ভূগিতেছে।
মোর কাছে আনারস খেতে চাহিয়াছে।।
কোনখানে আনারস খুঁজিয়া না পাই।
তোমার বাগানে গিয়ে দেখিলাম তাই।।
বড় এক আনারস পেকে রহিয়াছে।
এই আনারস আমি চাই তব কাছে।।
কত মূল্য দিব আমি বল হে আমায়।
এই আনারস আমি খাওয়াব পিতায়।।
মালিক বলেছে আমি ভাবিয়া নাই পাই।
মোর গাছে আনারস কভু দেখি নাই।।
রোজ রোজ আমি সেই বাগানেতে যাই।
পাকা ফল গাছে আছে দেখিতে না পাই।।
ফল যদি গাছে থাকে তোমা আমি দিব।
আনারস মূল্য আমি কিছু নাহি লব।।
তখনেতে দুই জনে বাগানেতে যায়।
বড় এক আনারস দেখিাবরে পায়।।
মালিক বলেছে সেই অশ্বিনীর ঠাই।
ফল নিয়ে চল বাবা তব সঙ্গে যাই।।
আনারস সঙ্গে নিয়ে চলে দুইজন।
অশ্বিনীর বাড়ী গিয়ে দিল দরশন।।
অশ্বিনীর পিতা সেই আনারস খেয়ে।
আর্শীবাদ দেয় তারে দু’বাহু তুলিয়ে।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
জীবের কল্যাণ যেন তোমা দ্বারা হয়।।
সকলেরে বলে কয়ে কার্ত্তিক সুজন।
হরি হরি হরি বলি ত্যাজিল জীবন।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী কেঁদে ছাড়ে হাই।
পরিবার সহ তারা কান্দিছে সবাই।।
পাড়া প্রতি সবে এসে সান্তনা করিয়া।
শব দাহ করিলেন সকলে মিলিয়া।।
একাদশ দিনে করে শ্রাদ্ধাদি অর্পন।
ভিক্ষা করি করালেন স্বজাতি ভোজন।।
সংসারে থাকিয়া সদা হরি হরি বলে।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখ জলে।।
মাঝে মাঝে সে অশ্বিনী ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচান্দ পোষা পাখি হরিগুণ গায়।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচান্দ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!