ভবঘুরেকথা
গণেশ পাগলের কুম্ভ মেলা

১৩ জৈষ্ঠ্য ১৪২৬ বঙ্গাব্দ
২৮ মে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ

শ্রী শ্রী তারকব্রহ্ম মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান
বার্ষিকী মহানাম যজ্ঞ
দিঘীরপাড়, কদমবাড়ি, মাদারিপুর
স্থান: মহামানব গণেশ পাগল সেবাশ্রম [গোবিন্দ মন্দির]

মাদারীপুর রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী দীঘিরপাড় মহামানব শ্রী শ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘে শুরু হয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম কুম্ভমেলা। প্রতি বছরের মতো এবারও ১৩ জ্যৈষ্ঠ রাতে মূল আনুষ্ঠানিকতা হবে।

১৬৭ একর জমিতে একরাতের জন্য উপমহাদেশের অন্যতম দেড়শ’ বছরের ঐতিহাসিক কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, সত্য যুগে দেবতা ও অসুরদের সমুদ্র মন্থনে যে অমৃতসুধা উঠেছিল তা চারটি কুম্ভ পাত্রে- হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিক -এ চারটি স্থানে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনার পর থেকে সাধুরা কুম্ভ মেলার আয়োজন করে আসছেন। ১৩৩ বছর পূর্বে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখে ১৩ জন সাধু ১৩ কেজি চাল ও ১৩ টাকা নিয়ে রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীর দীঘিরপাড়ে ভারতের কুম্ভমেলাকে অনুসরণ করে এ মেলার আয়োজন করা হয়। সেই থেকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীর দীঘিরপাড় শ্রী শ্রী গনেশ পাগল সেবাশ্রমে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

এক রাতের মেলা হলেও চলে সকাল থেকে পরদিন ভোর রাত পর্যন্ত। প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে পুরো একটি এলাকার বাড়ি-ঘর, মাঠ-ঘাট ও ক্ষেত-খামারে কোন জায়গা খালি থাকে না মানুষের পদচারনায়। সমাগম ঘটে প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষের।

………………………………….
স্থান:
মহামানব গনেশ পাগল সেবাশ্রম
গ্রাম: দিঘীরপাড়
ইউনিয়ন: কদমবাড়ী
উপজেলা: রাজৈর
জেলা: মাদারীপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ
………………………………….

………………………………….
: যাতায়াত :
ঢাকার গুলিস্তান, গাবতলি, যাত্রাবাড়ি যে কোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে মাওয়া ঘাট। সেখানে থেকে লঞ্চ, স্প্রিডবোর্ড বা ফেরীতে করে পদ্মা পারি দিতে হবে। সেখানে থেকে বাসে বা মাইক্রবাসে করে বরিশাল মহাসড়কে ভাংগা হয়ে টেকেরহাট নামতে হবে। টেকেরহাট থেকে মাহিন্দ্র/ইজি বাইকে কদমবাড়ি বাজার। কদমবাড়ি বাজার থেকে মহামানব গনেশ পাগল সেবাশ্রম।………………………………….

প্রায় ৯কিমি জায়গা জুড়ে পুরো একটি এলাকার বাড়ি ঘর, মাঠ-ঘাট, ক্ষেতখামারসহ কোন জায়গাই খালি থাকে না মানুষের পদচারণায়। সমাগম হয় আনুমানিক ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষের। এ যেন এক মহাযজ্ঞ। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী ইউনিয়নের কদমবাড়ি গ্রামে এ আয়োজন করা হয়। এ গ্রামের গনেশ পাগলের মন্দির প্রাঙ্গনে প্রতি বছরের জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলা চলে সকাল থেকে ভোর রাত পর্যন্ত। সকাল থেকে দলে দলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচ-গান করতে করতে মানুষ আসতে থাকে। এক এক একটি দলে একই ধরনের পোশাক পরে আসা ভক্তদের হাতে থানে জয়ডংকা, বিভিন্ন রঙিন কাপড়ের নিশান। এসব ভক্ত বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্তের তালে তালে ‘জয় হরিবোল’ ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে পুরো এলাকা। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছাড়াও বৃহওর ফরিদপুরসহ দক্ষিনাঞ্চলের অনেক জেলা থেকে দলে দলে মানুষ আসে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ও বহু লোকের সমাগম ঘটে। মেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আসে পুন্য আর্জনের জন্য। এক একটি দলের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার হাতেই লাঠির ওপর লাল নিশান, ঢাকঢোল, কাসার তৈরি ঘন্টি, বাজাতে বাজাতে নাচতে নাচতে আসে তারা। প্রায় প্রতিটি দলই এমন বড় বড় ঢোল নিয়ে আসে, যা দুই বা চারজনকে কাঁধে বহন করে বাজাতে হয়। প্রথমে গনেশ পাগলের মন্দিরের সামনে নাচতে থাকে তারা। এ সময় মন্দির প্রাঙ্গনে রাখা থাকে ধানের আঁটি যেগুলো নাচের তালে তালে মাড়াই হয়ে যায়। এ সময় প্রতিটি দলের লোকজনই মিষ্টি বাতাসা ছুড়ে মারতে থাকে। এরপর একে একে ঢোকে মূল মেলা প্রাঙ্গনে ।

যেখানে কি নেই? অগনিত দোকান, মাঠের পর মাঠ লাখ লাখ মানুষ বসে আছে। এভাবে তারা সারা রাত বসে থাকে। কোথাও চলে পুতুলনাচ, কোথাও সারি সারি খাবারের দোকান, কোথাও সারি সারি কাঠের আসবাবপত্র, চুড়ি-ফিতাসহ বাচ্চাদের খেলনার দোকান, আবার কোথাও বেঁধে নাচ-গান চলছে। কোথাওবা চলছে সাধু-সন্ন্যাসীদের অসর। এ মেলায় ভারতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার নেংটা সাধু আসে, যারা শুধু কৌপিন পরা থাকে। মেলায় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের যে মিলনমেলা দেখা যায় তা আর কোথাও দেখা যায় বলে মনে হয় না। এতো ভিড়ের মধ্যে একবার হারালে আর রক্ষা নেই সন্ধ্যায় হারালে মাইকিং করে খুঁজে পেতেও মধ্যরাত পার হয়ে যাবে। মেলায় প্রায় ১০টি স্থানে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা আছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের খুঁজে পেতে। প্রচন্ড গরমে পানির পিপাসা থেকে বাঁচাতে অনেক স্থানে সেচ্ছাসেবকরা জগ-বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনটি স্থানে শতাধিক তরুণ-তরুণী রয়েছে শুধু পানি পান করানোর দায়িত্বে; দুটি স্থানে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা জন্য। মেলায় ঘুরতে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়াদের সেখানে চিকিৎসা চলে। সেখানে বিনা মূল্যে তাৎক্ষনিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষের জন্য অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে। সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত দ্রুত বেগে ঘুরলেও চার ভাগের এক ভাগ মেলা দেখা যাবে না। গতবারের মেলায় প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি ছোট বড় দোকান পসরা সাজিয়ে বসেছিল। অন্য সাধারণ মেলার মতো এ মেলার একাংশে নাগরদোলা, সাকার্স, পুতুলনাচসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকে। আয়োজন কমিটির সংশ্লিষ্টদেও সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সত্য যুগে দেবতা ও অসুরদের সমুদ্র মন্থন যে অমৃত সুধা উঠেছিল তা দেবতারা চারটি কুম্ভুপত্রে ভারতের হরিদ্রার প্রোয়াক উজ্জয়িনী নাসিকা নামক চারটি স্থানরেখে ছিল প্রতি ১২বছর পরপর অমৃত যোগে একেক স্থানে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হতো ।

প্রায় ১৩১বছর আগে কদমবাড়িতে ১৩জন সাধু ও ১৩সের চাল ১৩টাকা নিয়ে ১৩জ্যৈষ্ঠ এ মেলার আয়োজন করা হতো। সেই অনুযায়ীই এখানে প্রতি বছর কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয়। মহাসাধক গনেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘে উপ মহাদেশের অন্যতম এবং দেশের বৃহৎ কুম্ভ মেলা। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার বসে গনেশ পাগলের মেলা এ মেলায় কর্মসূচীর মধ্যে থাকে শ্রীমদ্ভগবদ গীতা পাঠ, আলোচনাসভা ১৩টি মন্দির গেটে দেব-দেবীর পূজা, গনেশ পাগলের পূজা, কালী পূজা, আরতি, প্রার্থনা, প্রতিমা ও মন্দির দর্শন, ভজন সংগীত, পদাবলী কীর্ত, বাউল সংগীত, যঞ্জানুষ্ঠান, প্রসাদ বিতরণ, পবিত্রস্নান ও নর নারায়ণ সেবা। এখানে রয়েছে গোবিন্দ মন্দির, নন্দনকানন, তুলসীধাম, নিকুঞ্জ-নিধুবন, রাধাকুন্ডু-শ্যাম কুন্ডু, দূর্গামন্দিও, শীতলা মন্দির, শ্মশানকালী-শিব মন্দির, মনসা মন্দির, বীরহনুমান মন্দির, গুরু আগার মঠ মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণমন্দির, রাম সীতা মন্দির, রাধাকৃষ মন্দির, প্রভু গৌর নিতাই মন্দির, স্বর্গধাম (শ্মশান) ইত্যাদি দর্শনীয় মন্দির।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!