ভবঘুরেকথা
শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

রাজরোগ যক্ষ্মা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এটাই ছিল সেই সময়কার সবথেকে সহজ পন্থা। কিন্তু মৃত্যু যাঁর পদানত দাস, আজ্ঞাবহ ভৃত্য, তাঁকে মরণ স্পর্শ করবে কীভাবে! একমাত্র উপায় স্বেচ্ছামৃত্যু। সেই পথেই হাঁটলেন শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী।

মাঝেমাঝেই ভক্তদের কাছে তিনি তাঁর জীর্ণ শরীরের কথা বলতেন। তখন তাঁর কাছে শরীরটা হয়ে উঠেছিল বোঝার মতো। জীর্ণবস্ত্রের মতো তিনিও তাঁর দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত শরীরটাকে পরিত্যাগের চিন্তভাবনা শুরু করলেন। প্রথমদিকে কেউই তাঁর এই ইচ্ছার কথা বুঝতে পারেননি।

কিন্তু তিনিই একদিন আশ্রমের গোয়ালিনী মাকে বললেন, মা, আমি চলে যাওয়ার পর তোর কাজের দায়িত্ব আরও বেড়ে যাবে। ‘আমি চলে যাওয়ার পর’ কথাটি শুনেই জ্ঞান হারালেন গোয়ালিনী মা। লোকনাথজি তখন প্রবল অসুস্থ। প্রত্যেকবার কাশির সঙ্গে রক্তপাত হচ্ছে।

ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছেন ভক্তের ভগবান লোকনাথ বাবা। এইরকম অবস্থায় তিনি তাঁর বিদায়ের তারিখটিও জানিয়ে দিলেন ভক্তদের। কিন্তু যাব বললেই তো যাওয়া যায় না! আশ্রমের ভার তো যোগ্য মানুষের হাতে অর্পণ করে যেতে হবে।

অসুস্থ লোকনাথবাবার প্রথম যে নামটি মনে পরেছিল তিনি হলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। তিনি গোঁসাইজিকে জীবনকৃষ্ণ নামে ডাকতেন। চন্দ্রনাথে দাবানলের গ্রাসে প্রাণ যেতে বসেছিল বিজয়কৃষ্ণের। সেইসময় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন লোকনাথজি। তাঁরই কৃপায় সেইবার প্রাণ ফিরে পান গোঁসাইজি।

বায়ু বেগে পাহাড় থেকে নেমে এসে তিনি গোঁসাইজিকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে রেখে আসেন। পরবর্তীকালে দ্বারভাঙায় যখন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রবল অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, সেইসময়ও বারদী থেকে শূন্যমার্গে দ্বারভাঙায় উড়ে গিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একবার বারদীতে গিয়েছিলেন। সেইসময় লোকনাথজির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছিল। শ্রীশ্রীব্রহ্মচারীবাবা তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার পিতামহের কাকা।’ এরপর তিনি পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে একজোড়া খড়ম ও একখানি কম্বল গোঁসাইজিকে দিয়েছিলেন।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন বিজয়কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন সেইসময় গোঁসাইজি রয়েছেন বৃন্দাবনে। ড. প্রাণগোপাল ভট্টাচার্য তাঁর পূর্ণব্রহ্ম বারদীর শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী গ্রন্থে লিখছেন- ‘গোঁসাইজি সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর আসনে সমাসীন। হঠাৎ এক পরিচিত কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন- ‘ বিজয়কৃষ্ণ আমি তোর কাছে এসেছি সূক্ষ্মদেহে।’ গোঁসাইজী চমকে উঠলেন। একী! স্বয়ং ব্রহ্মচারী বাবার প্রতিমূর্তি যে!…’

সূক্ষ্মদেহধারী বাবা লোকনাথ বললেন, ‘বিজয়কৃষ্ণ! আমি অচিরে এ দেহ ত্যাগ করব। তুই আমার বারদীর আসনে গিয়ে বস। ঐ আসনে বসবার মতো তোকে ছাড়া আর কারোকে দেখছি না।’ তা শুনে গোঁসাইজি বললেন, ‘আমার এখন বৃন্দাবন ধাম ছেড়ে যাবার জো নেই। এখানে এক বছর থাকব বলে সংকল্প করে আসন পেতেছি।’ বাবা বললেন, ‘তা হলে দেহ ছেড়েই দিই।’

গোঁসাইজি বললেন, ‘ আপনার যা ইচ্ছে করুন। আপনার দেহের প্রতি আমার এতটুকুও মায়া নেই।’

বাবা বললেন, ‘একথা বলছিস কেন রে?’

বাবার এই প্রশ্নের উত্তরে গোঁসাইজি বললেন, ‘আপনি ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি করেছেন। অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দিয়ে অনেককেই ‘অদৃষ্ট’ ‘প্রারব্ধ’ বলে তাদের মন বিগড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের সংশোধন করা কষ্টসাপেক্ষ। তাছাড়া আপনার কথা লোক বুঝতে পারে না, তাই তারা অনেক সময়েই ভুলপথে যাচ্ছে।’

বাবা গোঁসাইজিকে বললেন, ‘বিজয়কৃষ্ণ! জানিস যার যেমন সংসার সে আমার কথা তেমনই বোঝে।… যাদের জন্যে থাকা তারই যখন আমাকে চিনল না। আমার দ্বারা যখন তাদের কোনো উপকারই আর হবে না, তখন আর থেকে কী লাভ? আমি দেহ ছেড়ে দিচ্ছি।’

বাবার কথা শুনে গোঁসাইজি বললেন, ‘আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। আমার কিছু বলার নেই।’ মুহূর্ত মধ্যে সেখানে এক দমকা হাওয়া বয়ে গেল। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী অদৃশ্য হলেন।

কিন্তু গোঁসাইজি তাঁর বংশের অতি বৃদ্ধ পুরুষের উপর কেন অত রেগে ছিলেন! কেন তিনি লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে দেহ ছাড়তে নিষেধ করলেন না। এ ব্যাপারে তিনি নিজে আমাদের কোনও কিছু না জানালেও শ্রীমৎকুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর লেখা পড়ে অনেক কিছুই জানা যায়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর দেহাশ্রিত অবস্থার কতক সময়ের দৈনন্দিন বৃত্তান্তের সংকলন ‘শ্রীশ্রী সদ্‌গুরু সঙ্গ’। এটি লিখেছিলেন তাঁরই কৃপাধন্য কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী। তিনি লিখছেন, ‘শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী আমাকে ডাকিয়া বলিলেন,ওরে তোর কিছু বলবার থাকলে এখন বল।’

সেইসময় তাঁর সঙ্গে কুলদানন্দের অনেক কথা হল। একসময় লোকনাথ ব্রহ্মচারী গোঁসাইয়ের কথা তুলে বললেন, ‘গোঁসাই দেশবিদেশে আমাকে মহাপুরুষ বলে প্রচার করে আমার সর্বনাশ করলে। পঁচিশ বৎসরকাল আমি এখানে বেশ ছিলাম, এখন রোগীর চিৎকার আর মামলা মোকদ্দমার কথা উদয়াস্ত আমি শুনি।

এই জন্যই কি আমি এখানে আছি। শালা! অন্ধ, মুরুক্ষু। কঁচি কঁচি ছেলেগুলোকে যোগশিক্ষা দিচ্ছে আর বলে পরমহংসজী পরমহংসজী।’ এই প্রকার নানা কথা গোঁসাইকে বলিয়া, আমাদের সাধনের কুৎসাও করিতে লাগিলেন। আমি সেসব কথা শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম।’

কুলদানন্দ গেণ্ডারিয়ায় ফিরে এসে গোঁসাইজিকে লোকনাথজির সব কথা বললেন। সব শুনে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, ‘এখন তোমাদের যে কেহ ব্রহ্মচারীর নিকটে যাবেন, তাঁকেই তিনি একবার ‘নাড়া-চাড়া’ করবেন। আমাকে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “মুনি ঋষিদের ‘কলজে’ তুই শেয়াল কুকুরগুলোকে বিলাচ্ছিস।”

আমি বললাম, যেমন পরমহংসজী আদেশ করেন তেমনি আমি করছি। তিনি বললেন- ‘আচ্ছা আমি একবার বেশ করে দেখব।’ তাই এখন তিনি আরম্ভ করেছেন। এতে তোমাদের আর কী? আমাকেই পরীক্ষা করছেন। তিনি বলেছিলেন- তোর ‘নাড়ি ভুঁড়ি’ আমি টেনে বের করব। এখন তিনি তাই করছেন। যত পারেন করুন! তবে, তোমরা এখন কেহ সেখানে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একথা সকলকেই বলে দেওয়া ভালো।’

মনে হয় সেইজন্যেই শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এইরকম ব্যবহার করেছিলেন। লোকনাথজি ফিরে এলেন বারদীতে। শুরু হল বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি। আর ক’দিন বাদেই তিনি লীন হবেন ব্রহ্মে। তারিখটা হল ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৯ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার।

…………………………………………
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ফিরিয়ে দিলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে : অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়; বর্তমান পত্রিকা থেকে।

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ভিজিট করুণ: বাংলার সাধক-সাধিকা

পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Amit Roy , বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০১৯ @ ১১:২৯ অপরাহ্ণ

    Your content n presentation both are unique. Wish your you tube channel all success n prosperity. Wonderful your ideas are. Stay blessed n take care.

    • ভবঘুরে , শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০১৯ @ ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

      Thanks Amit Roy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!