ভবঘুরেকথা
রবিউল শাহ্ ফকির জাফর মস্তান

গুরু পদে মতি আমার কই হল

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : চার

তখন পুরান ঢাকার যে বাসায় আমরা থাকতে শুরু করেছি সেটি মূল সড়ক থেকে কিছুটা ভেতরে। গলিটার বিভিন্ন অংশ থেকে বেশকিছু সরু পথ জালের মতো পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে ছিল। এই আঁকাবাঁকা গলিগুলো কোথাও কোথাও এতোটাই সুরু ছিল যে রিকশাও চলতো না।

সেকারণে গলিগুলো যেমন তুলনামূলক নিরাপদ ছিল তেমনি কম সময়ে দূরের পথ পারি দেয়ার জন্য ছিল আদর্শ। এই পথগুলোই আমাদের ছোটদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। এরমধ্যে যে সরু গলিটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহারের প্রয়োজন পরতো সেটার ঠিক মাঝামাঝিতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে কোমরে গামছা জড়িয়ে এ্যালুমিনিয়ামের থালা হাতে ঝড়-বৃষ্টি-শীত-গ্রীষ্মে দাঁড়িয়ে থাকতো ‘মতি মিয়া’। সবাই তাকে ডাকতো ‘মতি পাগলা’ নামে।

ঐ মহল্লায় যাবার কিছুদিন পরে এক মধ্যদুপুরে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে একা একা যাচ্ছিলাম লাটিম কিনতে। ল্যাম্পপোস্টের পাশ থেকে মতি পাগলা হঠাৎ বেড়িয়ে পিলে চমকে দিয়ে বলে উঠলো, ‘কই যাস’? সেদিন এই আকস্মিক দৃশ্যমান হওয়া মতি পাগলা ও তার প্রশ্ন শুনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম ছোট্ট আমি।

এই ঘটনার পর থেকে সেই গলি দিয়ে যেতে ভীষণ ভয় করতো। কিন্তু উপায় ছিল না। ঐ গলিটা ব্যবহার করা প্রায় প্রতিদিনই প্রয়োজন হতো। তাই নিরুপায় হয়ে মাঝে মধ্যে যেতেই হতো। তখন খুব সাবধানে দূর থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখতাম মতি পাগলা দাঁড়িয়ে আছে কিনা।

যদি তাকে দেখা না যেত তাহলে হাফ ছেড়ে বাঁচতাম; দৌড়ে ঐটুকু পথ পাড়ি দিতাম। আর যদি দেখা যেত তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাহলে আর সাহস করতাম না, উল্টো পথ ধরতাম।

পরবর্তীতে দেখে-জেনে-শুনে বুঝেছি মতি পাগলা মোটেও ভয়ঙ্কর কেউ না। তিনি ছিলেন নিতান্তই গোবেচারা মানুষ, তার অন্যতম কর্ম হলো সরাক্ষণ ফিক্ ফিক্ করে হাসা আর সামনে দিয়ে যেই যাবে তাকে জিজ্ঞাসা করা ‘কই যাস’? মাঝারি গড়নের মতি পাগলার থুতনির কাছে একগুচ্ছ দাড়ি, লম্বা লম্বা গোঁফ, বড় বড় দাঁতগুলি একটু সামনের দিকে বের করা, যথারীতি চুল উস্কোখুস্কো আর মাথাটা দেহের তুলনায় খানিকটা বড়।

সিগারেটে সুখ টান দেয়া ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়, সেই দৃশ্য দেখবার মতো, আয়েশ করে দুই চোখ বন্ধ করে সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে মতি টান দিতো সিগারেটের সর্বশেষ অংশখানা; সেই অংশটুকু পাওয়ার আশায় ধুমপায়ীদের পেছন পেছন ঘুরতো মতি।

বড় হতে হতে মতি পাগলার সাথে আমারও একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ঐ পথ দিয়ে গেলেই মাথা চুলকাতে চুলকাতে পেছন পেছন হাঁটা দিতো। তারমানে তাকে ২টাকা দিতে হবে। অবশ্য চাইতো না কখনো। ২টাকা দিলে চলে যেত। নইলে যতটা পথই যাওয়া যাক না কেনো সে পিছু পিছু আসবেই।

ভয়টা ততদিনে কেটে গেলেও মতি পাগলা কিন্তু তার প্রশ্ন করা থেকে কখনো পিছপা হয়নি। সেই বাড়িতে যতদিন ছিলাম; সেই গলি দিয়ে যতদিন গিয়েছি; মতি পাগলা যতবার সামনে পরেছে; যতবার মতি পাগলা আমাকে দেখেছে; কখনোই এমন হয়নি যে মতি পাগলা জিজ্ঞাসা করেনি ‘কই যাস’?

এখনো ভাবনা’রা যখন ঘাড়ে ভর করে মাথায় উঠতে থাকে তখন মনে পরে যায় মতি পাগলার প্রশ্নটা ‘কই যাস’? মনে হয় মতি পাগলা প্রশ্ন করতে করতে পেছন পেছন আসছে। এতোদিনে আমি জেনে গেছি ২টাকা দিয়ে আর এই মতি পাগলাকে ফেরানো যাবে না। এতো সহজে সে পিছু ছাড়বে না।

সে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় কই যাস কই যাস ধ্বনিতে। কি করে মতি পাগলাকে বোঝাই আমি কি আসলেই জানি আমি কই যাই? আমরা কেউ কি জানি আমরা কোথায় যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করেছি? আসলে আমরা কোথায় যেতে চাই? জীবনের এই যাত্রার প্রকৃত গন্তব্য কোথায়? প্রশ্নটা কানের কাছে বেজেই চলে। কই যাস্… কই যাস্… কই যাস্…

সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আজো তৈরি করে উঠতে পারিনি। তোমার কাছে আছে কিনা জানি না। প্রশ্নের উত্তর তুমি কিভাবে খোঁজো সেটাও আমি জানি না। আমি কিন্তু সারাজীবন প্রমাণ-যুক্তি-বিজ্ঞান দিয়েই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। কিন্তু অনেক অনেক পরে জেনেছি সভ্যতার কষ্টি পাথরে নিয়মের স্বর্ণ ঘষে ঘষে সত্য মিথ্যা নির্ণয় করাই একমাত্র পথ না মতও না। শাস্ত্র দিয়ে নির্ণয় করাও শেষ সমাধান নয়।

এর বাইরেও আরেকটা পথ রয়েছে। দৃশ্যমান সত্য, প্রমাণের সত্যের পরে আরেকটা সত্য রয়ে গেছে তা হলো ‘উপলব্ধির সত্য’। সারাজীবন আমি ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতাকে একই পেয়ালার চা বলে পান করে এসেছি। আর প্রচলিত বিজ্ঞানকে ভেবেছি বিবেচনার একমাত্র পথ। কিন্তু প্রমাণের সত্য ছাড়াও উপলব্ধির সত্য বলে আরেকটা বিজ্ঞান থাকতে পারে তা সাধু-গুরু-পাগল-গোঁসাইদের সন্ধান না পেলে, সান্নিধ্য না পেলে হয়তো জানাই হতো না। আর বিশ্বাস তো কখনোই নয়।

এই যে তুমি পড়তে পড়তে হাসছো আর ভাবছো আমার মাথা গেছে। নইলে কেনো এমন কথা বলছি তাই না? গবেষণাগারের বিজ্ঞানের বিপরীতে কেনো উপলদ্ধির বিজ্ঞান নিয়ে এতো কথা বলছি তাই তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই প্রিয়। আমি পাল্টে যাইনি; না পাল্টেছে আমার বিশ্বাস। না ধ্যান-ধারণা। আমি কেবল আরো একটু গভীর থেকে দেখতে শিখছি বা দেখার চেষ্টা করছি মাত্র।

মজার বিষয় হলো এখানে অন্ধ বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। উপলব্ধির সত্য হলো এমনি সত্য যা নিজে অনুধাবন করেই বুঝতে হয়। কেউ তোমার হয়ে তা করে দিতে পারবে না। তাই এই জটিল সত্যে যাত্রীর সংখ্যা নিতান্ত হাতে গোনা। সাধক মাত্রই এই জ্ঞানের দর্শন পায়। তুমিও এ পথের যাত্রী কিনা জানি না।

প্রশ্নটা বহুজনকেই করেছিলাম আগেপরে; তারা প্রায় সকলেই নিজ নিজ গুরুর কাছে যাবার আহ্বান করেছেন। বা নিজেরা গুরু হলে তার কাছেই দীক্ষা নেয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। অনেকে তো পারলে তৎক্ষণাৎ দীক্ষা দিয়ে দেন। কেউ কেউ আশ্বাস দেন অমুক মাসে আসবেন দাদা তুমুক মাসে আসবেন তখন গুরুর কাছে নিয়া যাবো।

সব বুঝি-সব জানি-সব পারি এমন ভাবনা থাকলে এ জ্ঞান তোমার জন্য নয় প্রিয়। এ জ্ঞানের যাত্রা মানে শুদ্ধতার যাত্রা। তবে এ জ্ঞান সংরক্ষিত জ্ঞান। সকলের জন্য নয়। যে শুদ্ধ মনে চায় সে পায়। মনে কিঞ্চিৎ দুর্বুদ্ধি থাকলে এ জ্ঞান সাগরে ডুবে যাবে – ভেসে উঠবে না। আর এই জ্ঞান প্রাপ্তি পথ হলো গুরু।

গুরু-শিষ্য পরম্পরাতেই এই জ্ঞান সংরক্ষিত হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে। কিন্তু যথাযথ গুরুর সন্ধান পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সাধকপুরুষরা বলেন এক জনমের কর্ম্ম নয় বাপ। বহু জন্মের সুর্কীতি লাগে সঠিক গুরুর দর্শন পেতে হলে।

গুরু সন্ধানের কথা মনে পরলেই মনে পরে যায় রবিউল সাধুর কথা। সাঁইজির রওজার পাশে ত্রিশূল লাগিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে সাজ সাজ রব করে মোমের আলোতে বসে থাকতেন জাফর সাঁইজি। সেইভাবে কথাবার্তা না হলেও কুশলাদি বিনিময় হতো চোখাচোখি হলেই।

উনিও বেশ প্রেম প্রেম চোখে তাকিয়ে থাকতেন। পাশ দিয়ে গিলেই পুন্যসেবা নেয়ার নিমন্ত্রণ দিতেন। বসাতেন পাশে।

জাফর সাঁইজি দেহ রাখবার পর সেইস্থানে রবিউল সাধু স্থলাভিষিক্ত হলেন। এরপর থেকেই রবিউল সাধুর সাথে পরিচয়। হাত তুলে ভক্তি জানতেই রবিউল সাধু জায়গা করে দিলেন পাশে বসবার জন্য। প্রথমদর্শনেই সাধুর সাথে কথাবার্তা বেশ গভীরে পৌঁছালো; অল্পসময়েই। আসলে মনের মানুষের সাথে তো শত-সহস্র জনমের সম্পর্ক, কেবল দর্শনে যতটা দেরি, বাকিটা ইতিহাস।

স্বল্প ভাষী রবিউল সাধুর পরনে উনার গুরুর মতোই লাল বসন। গুরুর আসনে বসে তিনি গুরুকর্ম করে যান। গুরুধর্মই পরমধর্ম। গভীররাতে যখন দোলের চাঁদ রাত্রিশেষের বার্তা দিচ্ছে সেই সময় রবিউল সাধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আচ্ছা সাধু দেখে শুনে যা বুঝলাম সকলেই বলে গুরু ছাড়া এই সাধনপথে এগুনোর কোনো পথ নাই। কিন্তু মনে ধরে এমন গুরু কই পাই বলেন তো?

যাকে দেখলেই মনে বিউগল বেজে উঠবে বা বলা যায় প্রথম দর্শনে শত জনমের ভক্তিভাব উদয় হবে; শত শত ঘণ্টা বাজতে শুরু করবে; অপার্থিব সৌরভ ছড়িয়ে পরবে সর্বত্র; পরমের স্বাদ সারা দেহে শিহরণ জাগাবে; পুলকিত হয়ে উঠবে হৃদয়, নিজেকে সমর্পন করার জন্য চিত্ত আকুপাকু আকুপাকু করবে।

প্রশ্নটা বহুজনকেই করেছিলাম আগেপরে; তারা প্রায় সকলেই নিজ নিজ গুরুর কাছে যাবার আহ্বান করেছেন। বা নিজেরা গুরু হলে তার কাছেই দীক্ষা নেয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। অনেকে তো পারলে তৎক্ষণাৎ দীক্ষা দিয়ে দেন। কেউ কেউ আশ্বাস দেন অমুক মাসে আসবেন দাদা তুমুক মাসে আসবেন তখন গুরুর কাছে নিয়া যাবো।

কেউ বলে দাদা আরো কয়েকটা দিন থেকে যান গুরুর বাড়ি নিয়ে যাব। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে তা হয়নি কখনো। অবশ্য চূড়ান্ত ইচ্ছে যে ছিল তাদের পিঁছু পিঁছু যাই এমনো কিন্তু না।

প্রথমদিকে বিষয়টায় কৌতুহল তৈরি করলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম এদের মধ্যে যারা অতি উৎসাহী পারলে পাকড়াও করে গুরুর কাছে নিয়ে যেত চায়; তারা প্রায় সকলেই একঅর্থে এজেন্ট। গুরুর কাছে নতুন শিষ্য ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চান। অভিজ্ঞতা বরাবর এরকই ছিল।

ঠিক তেমনি কে যে কার শিষ্য হবে আর কে যে কার গুরু হবে তাইবা কে বলতে পারে। আসলেই তো তাই। হিসেব নিকেশ করে কি আর প্রেমে পরা যায়? প্রেম হয়ে যায় ব্যাস। জীবনের প্রথম প্রেম প্রথম প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করে তা প্রত্যেকেই জানে খুব গোপনে।

কিন্তু সে রাতে রবিউল সাধু যে কথা বলেছিল তাতে প্রথাগত বিশ্বাসে ছোটখাটো একটা ধাক্কা লেগেছিল। আজো পরিস্কার মনে পরে, প্রশ্নটা করবার পর রবিউল সাধু তার স্বচ্ছ চোখে আমার দিকে অনেকটা সময় পলকশূন্য নয়নে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, সবই তাঁর ইচ্ছা। তিনি যখন কাছে টেনে নিয়া আসছেন, তিনিই পথ দেখাবেন।

আপনি হাজার ঘুরে মরলেও হাজার সাধনা করলেও দেখা কি পাবেন গুরুর? যদি তিনি না চান? তিনিই ঠিক করে দিবেন সব কিছু। সেদিন আপনি নিজেই বুঝবেন। কাউকে বলে দিতে হবে না। কাউকে দেখিয়েও দিতে হবে না। গুরুপ্রাপ্তি নিয়া চিন্তার কিছু নাই।

কার সাথে কখন প্রেম হয় তা যেমন বলা যায় না তেমন গুরুর দর্শনও বলে কয়ে হয় না। যখন হওয়ার হয়ে যায়। এটা মানুষের হাতে না। সবই তার ইচ্ছা। আর পূর্বজন্মে কর্ম করা থাকলে আলাদা কথা।”

আসলে রবিউল সাধুকে এই প্রশ্ন আমার করাই উচিত হয়নি। কারণ সাধুর উত্তর শুনে ততক্ষণে মনে দ্বিতীয় প্রশ্নটা প্রসব যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। এক প্রশ্ন থেকে বাঁচতে যেয়ে নতুন প্রশ্ন নিয়ে ফিরলাম। মন খুঁজতে লেগে গেলো নতুন জবাবের- “কে কাকে খোঁজে? শিষ্য গুরুকে খোঁজে? নাকি গুরু শিষ্যকে খোঁজে?”

রবিউল সাধু আমাকে গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়ার অবস্থায় রেখে গুরুকর্মে নিযুক্ত হয়ে গেলেন। আমি বেকার মানুষ কি আর করি মাথায় প্রশ্নমালা নিয়ে ঘুরে বেড়াই এপথ ওপথ। নিজের কাছেই প্রশ্ন করি, নিজের কাছেই উত্তর খুঁজি। কখনোবা সাধুগুরুদের দর্শন পেলে জানার চেষ্টা করি।

রবিউল সাধুর গুরুপ্রাপ্তির উত্তরের লৌকিক-অলৌকিক দ্বন্দ্ব নিয়ে তার্কিক ব্যাখা না খুঁজে সহজ অর্থে যতটা বুঝতে পেরেছি তা হলো গুরুর দর্শন পাওয়া প্রেমিকা দর্শন পাওয়ার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। কার সাথে কখন প্রেম হবে তা যেমন হিসেব নিকেশ করে বলা যায় না।

ঠিক তেমনি কে যে কার শিষ্য হবে আর কে যে কার গুরু হবে তাইবা কে বলতে পারে। আসলেই তো তাই। হিসেব নিকেশ করে কি আর প্রেমে পরা যায়? প্রেম হয়ে যায় ব্যাস। জীবনের প্রথম প্রেম প্রথম প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করে তা প্রত্যেকেই জানে খুব গোপনে।

এ আসলে লিখে বা বলে প্রকাশ করা আমার মতো মূর্খের কর্ম না। ফুলের গন্ধকে যেমন লিখে প্রকাশ করা যায় না প্রথম প্রেম ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার; চাইলে পাতার পর পাতা তুমি হয়তো লিখে যেতে পারবে কিন্তু মূলভাব প্রকাশ হয় এমন একটা শব্দও তুমি খুঁজে পাবে না।

তেমনি গুরুও কি খুঁজলে পাওয়া যায়? আমার জ্ঞান তাই বলে, শিষ্য নিজে তৈরি হলে গুরু প্রাপ্তি ঘটে। নয়তো রব ফকিরের কথাই বলতে কয়েক জনমের সুর্কীতির ফলে সাধুঘরে জন্ম হয়। এই কথাগুলো মাথায় ঘুরতে শুরু করলেই সাঁইজির এই পদটা খুব মনে পরে-

কে কথা কয় রে দেখা দেয় না।
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম ভর মেলে না।।

খুঁজি তারে আসমান জমিন
আমারে চিনি না আমি,
এ বিষম ভুলে ভ্রমি
আমি কোন জন সে কোন জনা।।

রাম রহিম বলতে সেই জন
ক্ষিতি পবন জল কি হুতাশন,
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মূর্খ দেখে কেউ বলে না।।

হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর
সদাই মনের ভ্রম যায় না।।

রবিউল সাধু তো বলেই খালাস। কিন্তু আসলেই কি চিন্তার কিছু নাই? আসলেই কি পথ পাওয়া যায়! না খুঁজেও? সংশয় নিয়ে কি সাধনার পথে এগিয়ে যাওয়া যায়! আর আসক্তি না থাকলে কি আসলেই সাধনার পথে হাঁটা যায়? ভেতর থেকে প্রেরণা পাওয়া যায়? এইসব অমূলক প্রশ্ন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে বটে কিন্তু মনে জাগলে তো কিছু করার থাকে না।

নো দাইসেলফ : ভিডিও

প্রেমিকার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে মনের কথা বলতে পারার ইচ্ছে কি সকলের পূর্ণ হয়? কত শত প্রেমিক যে এই কষ্ট বুকে নিয়ে হারিয়ে গেলো তার খোঁজ কে রাখে। তেমনি প্রেমিকের মতো শিষ্যও ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর পথে পথে গুরুর খোঁজে। অন্যদিকে গুরুও আসন গেড়ে বসে থাকেন শিষ্যের সান্নিধ্যের আশায়।

কে কাকে খুঁজে পায়? গুরু শিষ্যকে নাকি শিষ্য গুরুকে প্রশ্নটা থেকেই যায়। আর যখন দুজন দুজনকে পায় তখন যে মহাযোগের সৃষ্টি হয় তাতে কি পুষ্পবৃষ্টি ঘটে? জমিন নেচে উঠে? আসমান কেঁপে উঠে? কখন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ? সকল সাধক কি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ নির্দিষ্ট করতে পারে এক জনমে?

কারো কারো তো মনে হয় খুঁজে খুঁজেই জীবনের বেশিভাগ সময় কেটে যায়। তারপরও কি থামে এই খোঁজার যাত্রা? হয়তো জীবনের কোনো কোনো বাঁকে কখনো এ যাত্রা থমকে দাঁড়ায় মাত্র।

প্রেমিক তার প্রেমের সন্ধানে ছুটবে। রশিক ছুটবে রসের সন্ধানে। এই তো নিয়তি। তাই না? কেউ তাকে আটকাতে পারে না, এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। সভ্যতার কোনো নিয়মকানুন দিয়ে তাকে বিরত রাখা যায় না। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই পুরানো কথা প্রশ্নই থেকে যায়- ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়, “গুরু শিষ্যকে খোঁজে না শিষ্য গুরুকে খোঁজে”?

কে আগে? গুরু না শিষ্য? শিষ্য না হলে কি গুরু হওয়া যায়? আর গুরু না হলে কি শিষ্যর গতি হয়? এই সত্যের সন্ধানে প্রেমিক ঘুরে বেড়ায় জগৎময়। আসলে যতক্ষণ সাধক স্থির না হয় ততক্ষণ কোনো উত্তরই মনে উপলব্ধ হয় না। সাঁইজি বলেছেন-

গুরুপদে নিষ্ঠা মন যার হবে।
যাবে তার সব অসুসার
অমূল্য ধন হাতে সেই পাবে।।

গুরু যার হয় কাণ্ডারী
চলে তার অচল তরী,
ভবে তুফান বলে ভয় কি তারি
নেচে গেয়ে ভবপারে যাবে।।

আগমে নিগমে এই কয়
গুরুরূপ দ্বীন দয়াময়,
অসময়ে সখা সে হয়
অধীন হয়ে যে তারে ভজিবে।।

গুরুকে মনুষ্য জ্ঞান যার
অধঃপতে গতি হয় তার,
লালন বলে তাই আজ আমার
ঘুটলো বুঝি মনের কু-স্বভাবে ।।

প্রতিদিন প্রশ্নের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলে। মজার বিষয় হলো আজো মতি পাগলার প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে পেলাম না। তার উপর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সব প্রশ্ন। আসলে আমরা যারা শহরে থেকে ছুটির দিনে অবসর সময়ে ধোয়া উঠা চা-কফি পান করতে করতে লালন সাঁইজিকে… লালন সাঁইজির সাধনাকে বুঝতে চাই – জানতে চাই। তারা অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থায় থাকি।

তাই মাছও ধরা হয় না জলও ছোঁয়া হয় না। তাই তেষ্টাটা আজন্ম থেকে যায়। আসলে উপলদ্ধির সত্য অনুধাবন করতে হলে প্রত্যেককেই শুরু থেকে শুরু করতে হয়। কেউ কারো জন্য সাধনা এগিয়ে দিতে পারে না। কেবল নিজ অভিজ্ঞতার কথা যতটা সম্ভব বলার চেষ্টা করতে পারে মাত্র।

সাধনা করতে হয় প্রত্যেককে স্বয়ং। এখানে ফাঁকিঝুকি দেয়ার কোনো উপায় নেই। যে সাধন-ভজন করবে সে উপলদ্ধি করতে পারবে। আর যে করবে না ফাঁকি দেবে সেই ফাঁকিতে পারবে। এই আধ্যাত্ম বিজ্ঞান গবেষণাগারের মতো নয় পরিমিত পরিমাণে মেশালেই কোনো মিশ্রণ তৈরি হয়ে যাবে। এখানে সাধককে তপস্যা করে করে এগুতে হয়। কিন্তু আমরা তো কেবল স্মৃতিতেই বাস করে জীবন কাটিয়ে দেই। সাধন ভজন হবে কবে?

বেশ আগের কথা, তখন আমাদের মহল্লায় প্রথম ও একমাত্র সাততলা বাড়িটা ঠিকঠাক মত বসতি গড়ে তুলেছে। সেই বিশাল বাড়ি নিয়ে আমাদের নানান কৌতুহল। কিন্তু সে বাড়িতে কঠিন পাহারা, নিচে কুকুর। বাইরের কারো প্রবেশাধীকার নাই। ঐ বাড়ির ছাদে উঠে ঘুঁড়ি উড়ানোর স্বপ্ন দেখে কেউ কেউ। কেউ সেই ছাদ উঠে প্রেমিকার বাড়ির ছাদ দেখতে চায়। আর কত স্বপ্ন কত কল্পনা।

কিন্তু বাড়ির মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তা বাস্তবায়নে কেউ ভূমিকা নিতে পারে না। বাড়ি আর বাড়ির মালিক নিয়ে মহল্লার মহলে মহলে কেবলই রূপকথার ছোট বড় গল্পকল্প। এই গল্পকথায় আরো তেল-মশলার জোগান দিতেন সোলায়মান ভাই। তিনিই ছিলেন মহল্লারবাসীর সাথে সাততলা বাড়ির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। বাংলা সিনেমার কমেডিয়ানের মতো আমাদের সোলায়মান ভাই ছিল সাততলা বাড়ির কেয়ারটেকার কাম ড্রাইভারসহ আরো অনেক কিছু। মোটামুটি তাকে সেই বাড়ির সর্বেসর্বা বলা যায়।

সন্ধ্যার পর কিংবা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা তপ্ত দুপুরে এলাকার আড্ডাখানা ইউসুফের পুরির দোকানে সোলায়মান ভাই অতি উৎসাহী মহল্লাবাসীর টাকায় চা-পুরি খেয়ে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সেই বাড়ির মালিকের রঙিন জীবনের কল্পকাহিনী বলে যেত।

বয়োজেষ্ঠ্যারা তা শুনে আহ্ উহ্ করতো। সেই গল্প মহল্লার মহলে মহলে ঘুরে বড়দের হয়ে গেলে সেটা আমাদের; মানে ছোটদের কানেও চলে আসতো। কান লাল করা সেই সব গল্প শুনে আমরা কল্পনায় ভাবতাম সেই রাজার কথা। অবশ্য তখনো তাকে আমরা কেউ চোখে দেখিনি। তিনি গাড়ির কালো কাচের জানালা বন্ধ করে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতেন আর কখন বের হতেন কে জানে।

তাকে দেখতে অনেকটা বাংলা সিনেমার একসময়কার কমেডিয়ান খান জনির মতো ছিল। অবশ্য তিনি নিজেকে ভারতের নায়ক দেবানন্দ ভাবতেন। তার মতো বাঁকা করে টুপি পরতেন। মাঝে মধ্যে সংলাপ বলেও শুনাতেন। সংলাপ বলার আগে তিনি একটা গভীর নি:শ্বাস নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের পস দিতেন।

সোলায়মান ভাই ছিল আমাদের ছোট্টবেলার সুপার হিরো নাম্বার টু। সুপার হিরো নাম্বার ওয়ান ছিল ইদ্রিস কাকা। ঘটনা প্রসঙ্গে ইদ্রিস কাকার কথাও বলতে হবে কোনো এক সময়; যাক সে কথা। ফিরে আসি সোলায়মান ভাইয়ের কথায়। ছুটির দুপুরে বা সন্ধ্যা নামার আগে হঠাৎ হঠাৎ সোলায়মান ভাই তার মালিকের প্রাইভেট কার নিয়ে আমাদের খেলার জায়গার পাশে এসে দাপটে হর্ণ বাজাতেন।

আমরা বুঝে যেতাম আজ আমাদের দিন। আমরা গাড়িতে উঠে বসলেই গাড়ি ঘুরে বেড়াত মহল্লা টু মহল্লা। আমরা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করতে করতে যেতাম। সোলায়মান ভাই যতই বলতো মাথা ভেতরে নিতে; কিন্তু কে শোনে কার কথা।

মাঝে মধ্যে মহল্লার কারো বিশেষ প্রয়োজন হলে বা বড়দের কোনো এ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে হলে সোলায়মান ভাইকে ধরতো। সোলায়মান ভাই গভীররাতে গোপনে গাড়ি নিয়ে বের হতো। মালিক প্রতিদিন বাসা থেকে বের হতেন না। সেই সুযোগটা নিতেন সোলায়মান ভাই। অবশ্য তিনি ধরা পরে যেতেন। এই রকম অপরাধ বেশ কয়েকটা জমা হলে মালিকের নির্দেশে তার পাণ্ডা বাহিনী গ্যারেজে বেঁধে সোলায়মান ভাইকে কঠিন বাঁশডলা দিতো।

মাইর খাওয়ার পরদিন সকাল থেকে সোলায়মান ভাই ইউসুফের পুরির দোকানের সামনের টুলটায় পাথরের মতো বসে থাকতেন। মহল্লার সকলেই তাকে একএক করে দেখতে আসতো। মা খালারা মাথায় বড় ঘোমটা টেনে দেখতে আসতো, সাথে থাকতো কত কি খাবার-দাবার।

কেউ গরম দুধ, কেউ গরম ভাত ঘি, কেউ দুধে হলুদ দিয়ে আনতেন। আরো কত কি। ছোট বড় সকলেই তার মালিককে অভিশাপ দিয়ে নানা কথা বলতেন। তারপর শুরু হতো চিকিৎসা পরামর্শ। তখন সকলেই চিকিৎসক হয়ে উঠতেন। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা উপদেশ।

অবশ্য ২/১দিন সোলায়মান ভাই কোনো কথা বলতো না কারো সাথে। পাথরের মতো বসে থাকতেন শুধু অপলক দৃষ্টিতে। সে সময় সোলায়মান ভাইকে আমরা খুব ভয় পেতাম। বড়দের আড়ালে থেকে উঁকি দিয়ে দেখে আসতাম। তার কয়েকদিন পর সোলায়মান ভাই আবার আগের চরিত্রে ফিরে আসতেন।

তাকে দেখতে অনেকটা বাংলা সিনেমার একসময়কার কমেডিয়ান খান জনির মতো ছিল। অবশ্য তিনি নিজেকে ভারতের নায়ক দেবানন্দ ভাবতেন। তার মতো বাঁকা করে টুপি পরতেন। মাঝে মধ্যে সংলাপ বলেও শুনাতেন। সংলাপ বলার আগে তিনি একটা গভীর নি:শ্বাস নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের পস দিতেন।

তারপর তিড়িংবিড়িং করে অভিনয় আর সংলাপ একসাথে চালাতেন। প্রায় পুরো মহল্লা জড়ো হয়ে যখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো তখন তিনি থামতেন। আসলে আমরা কেউ তার অভিনয় দক্ষতা দেখে নয়। বরং তার অদ্ভুদ শারীরিক কসরৎ দেখে হেসে লুটোপুটি খেতাম। সে দৃশ্য মনে পরলে এখনো হাসি থামানো মুশকিল হয়ে যায়।

সোলায়মান ভাইয়ের আরেকটা গুণের মধ্যে ছিল নিপুর চোর্যবিত্ত। মালিকের ঘর থেকে এটা সেটা এনে বিক্রি করে দিতেন মহল্লার মানুষজনের কাছে। এমনকি গাড়ির পাটর্স বিশেষ করে ক্যাসেট প্লেয়ার পর্যন্ত চুরি করে বিক্রি করে দিতেন। নিজ মালিক ভিন্ন অন্য কোনো জায়গা থেকে অন্য কার কাছ থেকে সোলায়মান ভাই চুরি করেছেন এ কথা নিন্দুকেও বিশ্বাস করবে না।

এসব অবশ্য করতেন মাইর খাওয়ার পর সুস্থ হয়েই। একে তিনি প্রতিশোধ নেয়া মনে করতেন হয়তো। এলাকার মানুষও এই কাজে তাকে বাহাবা দিতো। অনেকে তো তালিকা করে দিতো কি কি জিনিস চুরি করতে হবে। কোন জিনিসটা চুরি করলে কাকে দেয়া হবে সেটাও সবাই জানতো।

আমাদের ছোট্টবেলার এই সুপারহিরো একদিন হারিয়ে গিয়েছিল; আমরা আর তার কোনো সন্ধান পাইনি কোনোদিন। সেই বাড়িতে নতুন কেয়ারটেকার এসেছিল তাকে আমরা কেউ পছন্দ করতাম না। যদিও তিনিও বেশ ভালো ছিলেন।

আকাশে বাতাসে খবর উড়তো তার মালিক নাকি তাকে মেরে বুড়িগঙ্গার ঐপারে ফেলে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গায় লাশ ভেসে উঠলেই মহল্লার কেউ না কেউ যেয়ে খোঁজ নিয়ে আসতো সোলায়মান কিনা। সোলায়মান ভাইকে আসলেই মেরে ফেলা হয়েছিল কিনা; নাকি এসব গাল গল্প, আমরা এসব জানতাম না।

কিন্তু পুরো মহল্লাবাসী সোলায়মান ভাইকে এতো ভালোবাসতো যে তার প্রতি ভালোবাসায় প্রদর্শনের জন্যই হয়তো নতুন কেয়ারটেকারকে কেউ মেনে নেয়নি। যেমন সৎ মা শত ভালো হলেও সন্তান মন থেকে পুরোপুরি তাকে মানতে পারে না।

একবার মালিকের ছেলের প্রচণ্ড মাইর খেয়ে হজম করতে না পেরে সোলায়মান ভাই চাকরি ছেড়ে দিলেন। অবশ্য এটি আগেও কয়েকবার করেছিলেন। আবার চাকরি ফিরেও পেয়েছিলেন। এবার অবশ্য তা হলো না। তার জায়গায় নতুন নিয়োগ হলো। সোলায়মান ভাই পাগলের মতো হয়ে গেলো।

নতুন ড্রাইভারের নাম ছিল সম্ভবত লাবলু। হেব্বি ডাট-ফাট। কিন্তু সোলায়মান ভাইও কম যান না। সে ঠিকই কব্জা করে ফেললো লাবলু মিঞাকে। তারপর লাবলু বাড়ি থেকে এটা সেটা চুরি করে এনে দিতো। সোলায়মান ভাই সেগুলো এলাকায় বিক্রি করে দিতো।

অল্পদিনে তারা দু’জনে দুর্দান্ত চোরে পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু জীবনতো বাংলা সিনেমা না। তাই একদিন গাড়ি চুরি করে লাবলু পালালো। ধরা পড়লো সোলায়মান। কঠিন মাইর চলতে লাগলো। থানায় দেয়া হয়েছে এমন একটা গুঞ্জন শোনা গেলেও থানায় গিয়ে এমন কোনো খবর সংগ্রহ করতে পারলো না পাড়ার লোকজন।

আমরা এভাবেই বেড়ে উঠছিলাম বর্তমান দক্ষিণ ঢাকার ছোট্ট একটা মহল্লায়। যেখান থেকে সোলায়মানরা হারিয়ে গেলে উত্তেজিত উল্লাসিত অতি উৎসাহি বা টেনিদা ঘনাদা’র মতো দুর্দান্ত সব গুলবাজ যারা হাতি ঘোড়া কথায় কথায় মারেন তারা সকলে মিলেও শক্তি যোগার করতে পারে না, সেই বাড়িতে গিয়ে জানতে চাইতে সোলায়মান কোথায় গেলো?

এ ঘটনার পর থেকে মহল্লার নিয়মিত আসা ভিক্ষুকরা অধিক টাকা পেতে শুরু করলো প্রায় সকল বাড়ি থেকেই। সকলেরই এক কথা, ছেলেটা যাতে ফিরা আসে দোয়া কইরো। ভিক্ষুকরাও দুই হাত তুলে আসমানের দিকে তাকিয়ে দোয়া করে টাকা পয়সা নিয়ে দুয়ার টু দুয়ার ঘুরে বেড়াতো।

আকাশে বাতাসে খবর উড়তো তার মালিক নাকি তাকে মেরে বুড়িগঙ্গার ঐপারে ফেলে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গায় লাশ ভেসে উঠলেই মহল্লার কেউ না কেউ যেয়ে খোঁজ নিয়ে আসতো সোলায়মান কিনা। সোলায়মান ভাইকে আসলেই মেরে ফেলা হয়েছিল কিনা; নাকি এসব গাল গল্প, আমরা এসব জানতাম না।

আমরা মিস করতাম গাড়িতে করে ঘুঁড়ে বেড়ানো। সোলায়মান ভাইয়ের সেই সব অভিনয় তার সংলাপ। মিস করতাম সোলায়মান ভাইকে আমাদের সুপার হিরোকে। এখনো মিস করি সোলায়মান ভাইকে… মিস করি সেই সব প্রতিবেশিদের… সেই সব হেরে যাওয়া মানুষগুলোকে।

আসলে হেরে যাওয়া মানুষেরাই হেরে যাওয়া মানুষের খবর রাখে হয়তো… হয়তো না… কে জানে… ঘুরে ফিরে সকল কথাই সাঁইজির বাণীতেই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে সোলায়মান ভাইয়ের সেই দীর্ঘ নি:শ্বাসের পর পস হয়ে-

কোথায় রইলে হে দয়াল কাণ্ডারি।
এ ভবতরঙ্গে আমায় দাও এসে চরণতরী।।

পাপীকে করিতে তারণ
নাম ধরেছ পতিত পাবন,
সেই ভরসায় আছি যেমন
চাতক মেঘ নিহারি।।

যতই করি অপরাধ
তথাপি হে তুমি নাথ,
মারিলে মরি নিতান্ত
বাঁচালে বাঁচতে পারি।।

সকলরে নিলে পারে
আমারে না চাইলে ফিরে,
লালন বলে এ সংসারে
আমি কি তোর এতই ভারি।।

সোলায়মান ভাইয়ের মতো প্রতিদিন কত কিছুই তো হারায়। এটা সেটা হারায়, বই-খাতা-পেন্সিল হারায়, মা হারায়, বাবা হারায়, সন্তান হারায়, সম্পর্ক হারায়, বন্ধু হারায়, মতি পাগলা হারায়, প্রেমিক হারায়, প্রেমিকা হারায়, স্মৃতি হারায়, এরকম কত কিছু হারায় তার কি হিসেব থাকে? ঠিক তেমনি কত কিছু তো আবার থেকেও যায়।

এই যে এতোশত ঘটনা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াই; সবই তো স্মৃতি হিসেবে থেকেই যায় তাই না? তখন মাঝে মধ্যে ভাবি আসলেই কি কিছু হারায়? নাকি থেকে যায় ঠিকই কেবল আমরা তা দেখতে পাই না? বটতলায় বসে যেমন গাছটাকে দেখা যায় না; দেখতে গেলে দূরে যেতে হয়। তেমনই কি?

যা হারায় তা কি আসলেই হারায় নাকি আমরা তাকে দেখবার জন্য দূরে চলে আসি? নাকি জীবন আমাদেরকে আরেকটা সুযোগ দেয় একই ঘটনা দূর থেকে দেখার। মমতাজের জনপ্রিয় একটা গান ছিল- “বন্ধু যখন যায় চইলা আমার বাড়ির সামনে দিয়া ফাইটা যায় বুকটা ফাইটা যায়”।

গানটা শুনলে আমাদের মতো সভ্যসমাজের দাবীদাররা প্রথমেই একপ্রস্থ হেসে কুটিকুটি হয়ে নেই। তা ঠিক আছে। তবে বিষয়টা এরকমই দূর থেকে দেখলে বন্ধুর আরেক রূপ দেখতে পাওয়া যায়; কাছে থাকতে যেভাবে দেখেছি সেভাবে নয়। কাছে থাকতে তো মনে হয়েছিল সে সুখি হলেই আমি সুখি।

কিন্তু বন্ধু দূরে গিয়ে সুখে থাকলে আমাদের অনুভূতি পাল্টে যায় কেনো? আসলেই প্রেম ছিল ভালবাসা ছিল? নাকি অন্যকিছু? এসবই দূর থেকে দেখবার সুযোগ দেয় প্রকৃতি। আবেগে বা বুদ্ধিতে নয় উপলব্ধি থেকে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে ব্রহ্মান্ডে; আমরা কেবল জটিল করে তুলি।

ভুলে যাই যে গুরু প্রাপ্তির জন্য এতো আয়োজন তাকেও একপর্যায়ে ছাড়তে হবে। কারণ সাধনার জন্য তুমি ঘরের আসক্তি ছেড়ে যদি গুরুতে বা গুরুর আশ্রমে আসক্তি গড়ে তুলো তাহলেও শূন্য হাতেই ফিরবে। সাধনায় জ্ঞানীর জায়গা আছে আসক্তি-মোহ-লোভে আসক্ত অজ্ঞানী কোন স্থান নেই। দূর থেকে যদি বন্ধুর আনন্দ দেখেও তোমার পূর্ণ আনন্দ হয় তবেই বুঝতে তুমি সঠিক পথেই আছো। নতুবা লবডঙ্কা। সাঁইজি বলেছেন-

কোন পথে যাবি মন ঠিক হলো না।
কর লাফালাফি সার কাজে শূন্যকার
টাকশালে পড়লে যাবে জানা।।

যেতে চাও মক্কা
যদি পাও ধাক্কা
ফিরে দাঁড়াও তৎক্ষণা;
বল তাতে কার্য নাই কাশীধামে যাই
করে সহজ বিবেচনা।।

ক্ষণেক হও উদাসী
ক্ষণেক গৃহবাসী
ক্ষণেক হও মন হতভাগা;
বাজাও তিলকে তিনতাল বাজায় হামেহাল
মালের ঘরে তা না না না।।

এক নিরিখ যার
যেতে ভবপার
সে তরি কখনও টাল খাবে না;
হারে পাঁচ পীরে চলন চলরে লালন
চুরাশি করে আনাগোনা।।

সে অনেকদিন আগের কথা কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুরে এক সাধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি দুপুরের পরপরই। কিন্তু পথে গাড়ি নষ্টসহ নানাকারণে আমাদের মেহেরপুরের একটা মফস্বল শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই রাত হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সাধুর বাড়িতে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা গেল না।

এতো রাতে কোনো গাড়ি নেই। কি করা। সঙ্গীটি বললো, চলেন ভাই হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দেই। কিন্তু আমার মন ভীষণ খারাপ। মেজাজও খিটখিটে হয়ে গেছে ততক্ষণে। সাধুরবাড়ি যাব বলে বের হয়েছি কিন্তু যেতে পারছি না। চলছিল আমাদের কথাবার্তা।

আমাদের কথা শুনতে শুনতে চালানো থামিয়ে রিকশাওয়ালা চাচা বললো, ‘ফকিরের বাড়ি যাইবেন আপনেরা?’ আমাদের মেজাজ পাল্টে গেল। উৎসাহ নিয়া বললাম, ‘আপনি নিয়ে যাবেন?’

চাচামিঞা বললো, ‘না বাজান অতোপথ রিকশা যাইবো না। এইখানে একজন ফকির আছেন ওনার বাড়িতে কাল গান ছিল। এখনো লোকজন আছে ঐখানে গেলে নিয়া যাইতে পারি।’

আমরা তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে গেলাম। মাথার উপর চকচকে চাঁদ।

সাধুরবাড়িতে সাধুসঙ্গ শেষ হয়েছে দুপুরে এখনো কিছু লোকজন আছে কেউ কেউ গান গাইছে। সর্বত্র ঘুম ঘুম ভাব। উঠান পেরিয়ে সাধুর সামনে গেলাম। খুবই সাধারণ একজন সর্বকেশী ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু চোখের দিকে তাকালে টের পাওয়া যায় সাধু আর দশজনের মতো সাধারণ কেউ নন।

কিছু লোক সাধুকে ঘিরে বসে আছে। একপাশে কয়েকজন গোল হয়ে বসে গান গাইছে। চাচামিঞা আমাদের সাথেই আছেন। অসম্ভব আন্তরিকতা নিয়ে সাধু আমাদের বসতে বলে আমাদের জন্য রাতের সেবার ব্যবস্থা করতে চলে গেলেন।

বসে থাকা অন্যরা আমাদের সাথে পরিচিত হচ্ছিল। প্রচণ্ড স্মার্ট ভদ্রলোক একখানা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। তিনি আমেরিকা প্রবাসী ডাক্তার। উচ্চপদস্থ মেডিসিন গবেষক। সাথের জন পিজি হাসপাতালের ডাক্তার অন্যজন ইন্টার্ণ ডাক্তার। উনারা গতকাল এসেছেন।

আলাপ জমে গেল। কিছুসময় পরেই তিন পদের সবজি ডাল ধোঁয়া উঠা গরমভাত মিষ্টান্ন দিয়ে সেবা হলো। জানতে পারলাম সাধু একসময় আয়ুবের্দিক চিকিৎসা করতেন। অবশ্য এখন আর করেন না। তবে ভক্তদের রোগবালাই হলে তিনিই ঔষধ দেন। গ্রামের মানুষের অনুরোধেও এটা সেটা দেন। গভীররাত পর্যন্ত আলোচনা কথাবার্তা গান বাজনা হলো।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি ডাক্তার বাবু সদলবলে আড্ডা দিচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছিল তারা আর্লি রাইজার। ফিটফাট হয়ে রোদ পোহাতে বসেছেন। ভিড়ে গেলাম তাদের দলে।

এক ফাঁকে বলেই ফেললাম আপনি নিজে ডাক্তার হয়ে সাধুর কাছে আপনার নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বললেন দেখলাম। ওষুধ নিয়মকানুন জেনে নিলেন। ঘটনা কি? আপনি কি সাধুকে পরীক্ষা করছেন? উনি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বললেন, ছি ছি নাহ নাহ্ উনি খুবই গুণী কবিরাজ। দেহ ও দেহের রোগ সম্পর্কে ওনার অগাধ জ্ঞান। নাড়ী ধরে রোগ বলে দিতে পারেন রোগীর কি অবস্থা।

ওনার বাড়িতে ৩দিন রেখে আমাকে যা বুঝিয়েছিলেন সারাজীবনেও আমি এতো জ্ঞান আর কোথাও পাইনি। আমার ধারণা পৃথিবীর ১০জন চিকিৎসকের মধ্যে তিনি একজন হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু উপনিবেশিক আমলে যখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে দেয়া হয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম আপনি নিজে ডাক্তার হয়ে এতো সব ডিগ্রি নিয়ে কবিরাজী চিকিৎসার পরামর্শ নিচ্ছেন? এইবার প্রবাসী ডাক্তারবাবু মুখ খুললেন, ভাই আপনি কি জানেন মানবদেহের আজকে যত রোগ ছড়িয়ে পরছে তার জন্য কতটা দায়ী আমাদের এ্যালোপেথি চিকিৎসা?

আমরা রোগীকে গিনিপিগের মতো এক্সপ্রিমেন্ট করি। সাধারণ ডাক্তাররা অনেকেই বিশ্বাস করে ঔষধ দেয় রোগিকে। কিন্তু আমরা যারা গবেষণায় আছি আমরা জানি বেশিভাগ ঔষধই অল্প কিছু মানুষের উপর পরীক্ষা করে বাজারে ছাড়া হয়। যা ছড়িয়ে পরছে পৃথিবীব্যাপী।

এর বেশিভাগই অন্য আবহাওয়ায় উপযোগী কিনা তার গবেষণাও হয় না। ফর্মুলা আবিস্কার হলে বা বলা যায় একটা সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলেই কারখানায় ঔষুধ তৈরি শুরু হয়ে যায়। এ নিয়ে আর কোনো গবেষণা হয় না। এর ফলে যে কত শত রোগবালাই হচ্ছে, তার কোনো গবেষণা হয় না।

কারণ এসব গবেষণার জন্য ফান্ড নাই। এসব গবেষণা করলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আর বর্তমানে গবেষণা হয় মূলত ব্যবসা ধরে রাখার জন্য। যে সবে ব্যবসা হয় তাতেই গবেষণা হয়। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ৭০-৮০% ঔষধ প্রেসকাইভড করা হয় যার কোনো প্রয়োজনই নেই।

বাকি শতাংশের ঔষধ দেয়া হয় এমনভাবে যাতে রোগীর সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। অপ্রয়োজনীয় সার্জরী, এন্টিবায়টিক, প্যাথলজি টেস্টের কথা তো বাদই দিলাম। এর ফলে যে সব রোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার হিসাব রাখার কেউ নেই কারণ ঔষধ ইন্ডাস্ট্রি বিশাল অংকের ব্যবসা। আসলে এলোপ্যাথি হলো শেষ চিকিৎসা যখন আর কিছুই করার থাকে না তখনকার জন্য এই চিকিৎসা।

আমাদের ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র আসলে এর থেকে অনেকবেশি আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত। এর রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা অসাধারণ। আপনি ভাবতে পারবেন না। আমি দক্ষিণ ভারতের এক গ্রামের আয়ুবের্দিক চিকিৎসকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

ওনার বাড়িতে ৩দিন রেখে আমাকে যা বুঝিয়েছিলেন সারাজীবনেও আমি এতো জ্ঞান আর কোথাও পাইনি। আমার ধারণা পৃথিবীর ১০জন চিকিৎসকের মধ্যে তিনি একজন হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু উপনিবেশিক আমলে যখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে দেয়া হয়।

তখন আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় স্থানীয় সবকিছুই খারাপ পশ্চাৎপদ। তাই আমরা আমাদের নিজস্বতাকে ঘৃণা করতে শিখেছি। এ্যালোপ্যাথী অনেক সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দেয় আবার অনেক জটিল রোগীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখে বটে। কিন্তু আসলে তাকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে পাঠায় মাত্র।

ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র এমনটা কখনোই করে না। কিন্তু আমরা যখন থেকে আমাদের নিজস্বতাকে ঘৃণা করতে শিখেছি তখন থেকে স্থানীয় পণ্ডিত-হাকিম-কবিরাজরা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে।

দুপুরের সেবা নিয়ে আমি ও আমার সঙ্গীটি সাধুরবাড়ি থেকে বিদায় নিলাম। ডাক্তারবাবুর গাড়ি যখন গ্রামের মেঠো পথ ধরে আমাদের কাঙ্খিত সেই সাধুর বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার সঙ্গীটি জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, ‘আরে এই গুলা সব ভুয়া ডাক্তার বুঝলেন ভাই।

নইলে বিদেশে ব্যবসা জমাইতে পারে নাই। তাই এইসব তুকতাক শিখতে আসছে। আর নাইলে মাথাখারাপ হয়ে গেছে। তাও যদি না হয় তাইলে নির্ঘাত বৌ অন্য কারো সাথে পালাইছে। এইজন্যই এই বেটারা এসব আবোলতাবোল করে বেড়াইতেছে। ঠিক বললাম কিনা বলেন?’

এর জবাবে কি বলবো আমি? জানালার বাইরে গোধুলী আলোতে ডুবে যেতে যেতে সেদিন কি ভেবেছিলাম আজ আর তা মনে নেই। তবে এখন সেই সময়ের কথা মনে পরলে মনটা কেমন যেনো রোমাঞ্চিত হয়ে যায়। আসলেই কি আমার সফরসঙ্গীর কথা মতো ডাক্তারদের সেইসব কথাগুলো সবই পাগলের পাগলামী? কেউ তাদের ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছিল? নাকি ভেবে দেখবার সময় এসেছে নতুন করে?

চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কি ভাবতে হবে পুনরায় গোড়া থেকে? আবার গোড়া থেকে ভাবতে গেলেই কি চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বাণিজ্য সরিয়ে তাকে পুনরায় সেবায় পরিণত করা যাবে কি??

মাঘ মাসে রবিউল সাধুর গুরুর তিরোধান দিবস। প্রতিবারই যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। প্রতিবারই বলি সাধু দেখবেন ঠিক ঠিক চলে আসবো। কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও যাওয়া হয়নি। প্রত্যেকবার লালন উৎসবে তীব্র একটা অপরাধ বোধ নিয়ে রবিউল সাধুকে বলি, ‘সাধু কথা দিয়েও আসতে পারলাম না ক্ষমা করবেন।’

অন্য যে কেউ হলেই এর উত্তরে যা যা বলার কথা রবিউল সাধু সে সব কখনোই বলেন না। তিনি হেসে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব আপনাকে দাওয়াত দেয়া। আপনার কাজ হইলো দাওয়াত কবুল করা। কিন্তু আসা না আসা কি আর আমার আপনার উপর নির্ভর করে। তিনি আনাইলে আপনি আসবে। তিনি না আনলে আপনি আসবেন কেমনে?’

মানুষ কতো সুন্দর করে ভাবতে পারে তাই না? আমি রবিউল সাধুর উত্তরে অবাক হই প্রতিবার। প্রতিবার ভাবি ইস্ যদি এমনভাবে ভাবতে পারতাম, জীবনকে যদি এমনভাবে দেখতে পারতাম তাহলে হয়তো জীবনে এতো এতো অন্ধকার এতো এতো সমস্যা কখনোই আসতো না। আসলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের ক্ষমতা আমাদের হাতে নাই আমার কেবল মনস্থিতি পরিবর্তন করতে পারি-

গুরুপদে মতি আমার কই হলো।
আজ হবে কাল হবে বলে
কথায় কথায় দিন গেল।।

ইন্দ্ৰ আদি সব বিবাদী
সদায় বাধায় কল,
তারা কেউ শোনে না কারো কথা
উপায় কী করি বল।।

যে রূপ দেখি তাইতে আঁখি
হয়ে যায় রে বে-ভুলো,
দীপের আলো দেখে যেমন
পতঙ্গ পুড়ে মলো।।

কী করিতে এলাম ভবে
কী করে জনম গেল,
লালন বলে যজ্ঞের ঘৃত
সকলি কুত্তায় খেল।।

গুরুকার্য: ভিডিও

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • মিরজাহান , রবিবার ১৭ মে ২০২০ @ ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

    আমি মনে করি আত্ম পরিচয় লাভের যাত্রা শুরুর জন্য আমরা কোন রেডিমেড ইনভায়রোনমেন্ট প্রস্তুত পাই কি? বরং সব যায়গাতেই জোর করে অন্য পথে যাত্রার জন্য আমরা বাধ্য করি ও হই, আত্ম পরিচয় লাভের পথে সবচেয়েসহযোগীহতে পারে ভীতিমুক্ত আনন্দময় শৈশব। আর সবচেয়ে বেশি দরকার এই পথের প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিক ও সাবলীল উপস্থাপন আর ব্যপক প্রচার। হ্যা ব্যপক প্রচারও অত্যন্ত জরুরী কারন তিব্র অপপ্রার এই পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে যে বিশ মানুষের মনে তৈরি করছে তা অপসারনের জন্য প্রচারের বিকল্প নাই। ভক্তি গ্রহন করবেন। জয়গুরু…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!