ভবঘুরেকথা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নিমাই

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবকাল ১৪৮৬ খ্রীঃ

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবকালে ভারতবর্ষ জাত-গোত্রের নামে ধর্মীয় বৈষম্য চরমে ছিল। ঠিক সেই সময় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রচারিত বর্ণ-বৈষম্যহীন প্রেম-ভক্তি পূর্ণ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সাধারণ মানুষ পেয়ে ছিল নূতন জীবন ও ধর্মে-কর্মে অধিকার আর মহাপ্রভু তার ভক্তদের কাছে হয়েছিলেন কলিযুগে ভগবানের অবতার।

শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু, মহাপ্রভুর বর্ণ-বৈষম্যহীন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কট্টরপন্থী মৌলভীরা মহাপ্রভুকে সুনজরে দেখতেন না। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ ও সমাজপতিদের আধিপত্যবাদের দূর্গে আঘাত লাগায় ব্রাহ্মণরাও মহাপ্রভুকে ভাল চোখে দেখতেন না।

মহাপ্রভুর পিতার পারলৌকিক ক্রিয়ায় ব্রাহ্মণদের সাথে চণ্ডালের নিমন্ত্রণ করায় ব্রাহ্মণরা ক্ষিপ্ত হয়ে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে একঘরে করার ব্যবস্থা করেছিলেন, সমাজপতিদের চাপের মুখে ব্রহ্মহরিদাসকে (জন্ম সূত্রে মুসলমান হওয়ায়) মহাপ্রভুর কীর্ত্তনের দল থেকে বাদ দিতে হয়েছিল, সকল বর্ণের মানুষ নিয়ে এক সাথে হরির নাম সংকীর্ত্তন করার কারণে মহাপ্রভুর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিচারব্যবস্থার প্রধান, কাজী সাহেবের কাছে ব্রাহ্মণরা নালিশ করেছিলেন।

এমন কি মহাপ্রভুর কীর্ত্তনের দলের মৃদঙ্গ পর্যন্ত ব্রাহ্মণরা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, তবে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করেননি, বরং আরও পুরো উদ্যমে তার বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ২৪বছর বয়সে স্ত্রী ও মায়ের বিনা অনুমতিতে হঠাৎ করেই কেশব ভারতী গোঁসাই-এর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর সংসারে বাস ও স্ত্রীর সাথে বাক্যালাপ করা শাস্ত্রীয় বিধান মতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তাই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন কিন্তু মায়ের অনুরোধক্রমে তিনি উড়িষ্যার পূরীধামে থেকে গেলেন।

পূরীধামে থাকার সময় মহাপ্রভু হয়ে উঠলেন সাধারণ মানুষের প্রাণের ঠাকুর। কাশীনাথ মিশ্র, বাসুদেব সার্বভৌম, রায় রামানন্দ প্রমূখ মহা মহা বিজ্ঞ পণ্ডিতগণ মহাপ্রভুর অনুগামী হয়েছিলেন, তারপর উড়িষ্যার পরাক্রান্ত রাজা প্রতাপরুদ্র গজপতিও হয়ে পড়লেন মহাপ্রভুর একান্ত সেবক, তিনি মহাপ্রভুর আজ্ঞামত যুদ্ধবিগ্রহ সবকিছুই ছেড়ে দিয়ে একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সর্বাঙ্গীন মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লেন।

মহাপ্রভু জীবনের প্রথম ২৪ বছর ছিলেন নদীয়াতে, নদীয়াতে থাকার সময় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে তিনি যেমনি সাধারণ মানুষের কাছে হয়েছিলেন প্রাণের ঠাকুর, তেমনি সমাজপতি ব্রাহ্মণদের কাছে হয়েছিলেন চক্ষুশূল। মহাপ্রভু জীবনের শেষ ২৪ বছর ছিলেন পূরীধামে, সেখানেও মহাপ্রভুর জীবনে ঘটেছিল একই অবস্থা।

মহাপ্রভুর ইচ্ছামত রাজা প্রতাপরুদ্র, পুরীধামের জগন্নাথ মন্দিরে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সকল বর্ণের মানুষের প্রবেশ করার অধিকার দিলেন, এতেই হল কাল বা মহাসঙ্কট, এ জন্য মন্দিরের তত্তাবধানে থাকা ব্রাহ্মণরা ক্ষিপ্ত হলেন, তারা ভাবলেন এতদিনের পর এবারই অস্পৃশ্য, হীন জাতিদের স্পর্শে মন্দির ও মন্দিরের দেবতা অপবিত্র হয়ে যাবে, এই অবস্থা ব্রাহ্মণরা মানতে না পারলেও রাজা প্রতাপরুদ্রের নির্দেশ থাকায় তারা কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে গেলেন।

ব্রাহ্মণদের বুঝতে বাকী রইল না যে ঐ টিকিধারী সন্ন্যাসী গৌরাঙ্গ গোঁসাই এর মূল কারণ, বেদবিধান কিছুই মানে না এমন সন্ন্যাসীর ভক্ত মহারাজ কি করে হলেন, কি আশ্চার্য! অবশেষে ব্রাহ্মণরা শ্রীচৈতন্যদেবকে কি ভাবে গোপনে হত্যা করা যায় তাই যড়যন্ত্র করতে লাগলেন।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিজে ব্রাহ্মণের সন্তান হয়েও ব্রাহ্মণদের তৈরি বংশগত জাতিভেদ ও আধিপত্যবাদকে গ্রহণ করেননি বরং এর বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তার কাছে দীন-দুঃখী, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সবাই ছিল সমান।

মহাপ্রভু তার প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত ভক্তদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বৈষ্ণব ধর্ম (কৃষ্ণমন্ত্র) গ্রহণকারী ভক্তের পরলোক গমনের পর ব্রাহ্মণ দিয়ে আদ্যশ্রাদ্ধ করার পরিবর্তে নিষ্ঠাবান উপযুক্ত বৈষ্ণব দ্বারা হরির নাম সংকীর্ত্তন ও ভোগ-রাগের মাধ্যমে অন্তেষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত করবে, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নির্দেশে বৈষ্ণবরা অদ্যাবধি ব্রাহ্মণ দিয়ে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করেনা।

মহাপ্রভু জীবনের প্রথম ২৪ বছর ছিলেন নদীয়াতে, নদীয়াতে থাকার সময় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে তিনি যেমনি সাধারণ মানুষের কাছে হয়েছিলেন প্রাণের ঠাকুর, তেমনি সমাজপতি ব্রাহ্মণদের কাছে হয়েছিলেন চক্ষুশূল। মহাপ্রভু জীবনের শেষ ২৪ বছর ছিলেন পূরীধামে, সেখানেও মহাপ্রভুর জীবনে ঘটেছিল একই অবস্থা।

পূরীধামে থাকার সময় তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেছিলেন পন্ডিত জগদানন্দ, মহাপ্রভুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, মহাপ্রভু জগদানন্দকে প্রতিবছর নদীয়ার ভক্তদের ও মায়ের খোঁজখবর নেবার জন্য পাঠাতেন, বৈষ্ণব চুড়ামনি প্রভূ অদ্বৈত আচার্য ঐ জগদানন্দ মারফত গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কাছে একটি তরজা প্রহেলিকা পাঠিয়ে ছিলেন। মহাপ্রভুর কাছে অদ্বৈত কর্তৃক প্রহেলিকা প্রেরণ প্রহেলিকাটি ছিল-

বাউলকে কহিও লোক হইল আউল,
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল।
বাউল কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।
(চৈ,চ,অন্তলীলা ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ, ৬১২ পৃষ্ঠা)

পণ্ডিত জগদানন্দ পূরীধামে গিয়ে তরজা প্রহেলিকাটি মহাপ্রভুকে বললেন, মহাপ্রভু ব্যতিত আর কেউ ঐ প্রহেলিকার অর্থ তখন বুঝতে পারল না, মহাপ্রভু শুধু ঈষৎ হাসলেন মাত্র।

তরজা শুনিয়া মহাপ্রভু ঈষৎ হাসিলা,
তার এই আজ্ঞাবলি মৌন করিলা। চৈ,চ,অন্ত্য।

ভাবার্থ: এখানে বাউলকে অর্থাৎ পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্য্য নিজেকে বাউল বলে পরিচয় দিয়েছেন, আর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকেও বাউল বলেছেন। বাউল শব্দের অর্থ- মালিককে পাওয়ার জন্য ব্যকুল, যারা বৈষ্ণব ধর্মালম্বী হয়ে সংসারে থেকেও বিষয় বৈরাগী, যেমন অদ্বৈত আচার্য্য এবং সংসার ত্যাগী ডোর কৌপিন ধারী সন্ন্যাসী, যেমন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু

আউল শব্দের অর্থ- মালিককে পাওয়ার জন্য আকুল, উদাসীন, সংসার ও বিষয় বাসনায় মনযোগহীন। অদ্বৈত আচার্য্য প্রহেলিকার মাধ্যমে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে এই কথাই বুঝাতে চেয়েছেন যে ‘বাউল কে কহিও লোক হইল আউল’ অর্থাৎ তুমি সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করছ, মানুষ এই পথ অবলম্বন করে সংসারে মনযোগী হচ্ছে না, সবাই উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।

বাউল কে কহিও হাটে না বিকায় চাউল অর্থাৎ যে সংসার ধর্মের মাধ্যমে এই জীব জগৎ চলছে, সেই সংসার ধর্ম বিঘিœত হচ্ছে, এই ভাবে সবাই যদি উদাসীন হয়ে সংসারে মনযোগী না হয় তাহলে সংসার ধর্ম বলে আর কিছুই থাকবে না এতে কোন সুফল হবে না, “বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল”।

অর্থাৎ মহাপ্রভুকে বলো এই উদাসীনতার আর প্রয়োজন নেই, “বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল” অর্থাৎ মহাপ্রভুকে বলো এই কথা বলেছে বাউল অদ্বৈত আচার্য্য। মহাপ্রভু এই প্রহেলিকাটি শুনে একটু হেসে তারপর চুপ করে থাকলেন।

তরজা প্রহেলিকার অন্য ভাবার্থ

বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল অর্থাৎ পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্য্য জগদানন্দ মারফৎ পাঠানো ঐ তরজা প্রহেলিকার মাধ্যমে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে এই কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তুমি নদীয়ায় থাকা কালে ভক্তির মাহাত্ম্য পূর্ণ ভগবানের মাধূর্য্য প্রেমরস আস্বাদনের যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলে, তাতে হরির নামের প্রেমের বন্যায় নদীয়া প্লাবিত হয়েছিল কিন্তু তোমার অবর্তমানে আজ সেই প্রেম সাগরে ভাটা পড়ে যাচ্ছে।

তুমি নদীয়াতে যে কৃষ্ণ প্রেমের হাট বসিয়েছিলে সেই হাটে আজ ঠিকমত বেচা কেনা হচ্ছে না। ‘বাউলকে কহিও লোক হইল আউল’ অর্থাৎ মানুষ হরির নামের আকর্ষণে ভাবাবেশে উদাসীন হয়ে হরির নাম সংকীর্ত্তন করতে করতে দুবাহু তুলে নাচছে বটে কিন্তু তোমার যে আদর্শ প্রকৃত পক্ষে তা কার্যকরী হচ্ছে না। তুমি বলেছিলে-

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা
অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ

অর্থাৎ তৃন যেমন পদ পিষ্ঠ হয়ে, বৃক্ষ লতাদি যেমন সহনশীল হয়ে জীব জগতের কল্যাণ সাধন করে যাচ্ছে, তোমারাও সেই সহনশীল গুণের অধিকারী হও, অমানিকেও সম্মান কর অর্থাৎ ছোট বড় জাতিভেদ ভূলে সকলে এক সাথে হরির নাম সংকীর্ত্তন কর কিন্তু তোমার অনুসারী বৈষ্ণবগণ তা থেকে অনেক দূরে।

বৈষ্ণব হইতে বড় মনে ছিল সাধ
তৃণাদপী সুনীচেন পড়ে গেল বাদ

অর্থাৎ বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করা অনেকের ইচ্ছা ছিল বটে কিন্তু জাত্যাভিমান ত্যাগ করে ছোট জাতের সাথে মিশে এক সাথে হরিনাম সংকীর্ত্তন করতে হবে, এজন্য কেউ বৈষ্ণব থেকে চাচ্ছে না। তুমি বলেছিলে-

যে নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি
নামের সহিত আছে আপনি শ্রী হরি

অর্থাৎ কৃষ্ণ নাম ও কৃষ্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, তোমরা নিষ্ঠার সাথে কৃষ্ণ কে ভজনা কর। মানুষ কৃষ্ণ নামের মহিমায় ক্ষণেকের জন্য নামের আনন্দে আপ্লুত হচ্ছে বটে কিন্তু মানুষের মধ্যে সেই নিষ্ঠাভাবের খুবই অভাব। সবাই কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছে কিন্তু আচার ভ্রষ্ট হয়ে ক্রমে ক্রমে অনাচারে ভরে যাচ্ছে।

তোমার আদর্শের অনুসারী বৈষ্ণবগণ উদাসীনের ন্যায় হরির নাম সংকীর্ত্তন করতে করতে দুবাহু তুলে নাচলেও পারিবারিক ও সমাজ জীবনে এর কোন প্রভাব পড়ছে না, কারণ সংসারাবদ্ধ জীবের জন্য এতে কোন বিধান নেই। ডোর কৌপিন পড়ে মাথায় চৈতন্য রেখে বৈষ্ণব হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাউল কে কহিও কাজে নাহিক আউল

অর্থাৎ- উদাসীনতার আর প্রয়োজন নেই, তুমি মায়ামুগ্ধ সংসারাবদ্ধ জীব নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই যাতে এক সাথে মালিকের ভজন পূজন করতে পারে তার বিহিত ব্যবস্থা একটা কর।

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু অদ্বৈত আচার্য্য কর্তক প্রেরিত এই তরজা প্রহেলিকাটি শুনে মুদুভাবে একটু হাসলেন এবং চুপ করে থাকলেন। ঐ প্রহেলিকার সারমর্ম গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ব্যতিরেকে তখন আর কেউ বুঝতে পারেনি, সেই দিন থেকেই মহাপ্রভু চিন্তা করতে লাগলেন সত্যিই তো আমি সংসারে মায়ামুগ্ধ জীবের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য কিছু করিনি।

বিবাহিত স্ত্রী ও মাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আমি ডোর কৌপিন পরে সন্ন্যাসী হয়ে, যে ধর্মমত প্রচার করেছি তাত সবাই গ্রহণ করতে পারবে না, সত্যিই আমার এটা ভূল হয়েছে।

যখন সন্ন্যাস লৈনু ছন্ন হইলে মন
কি কাজ সন্ন্যাসে মোর প্রেম প্রয়োজন -চৈ,চ,মধ্য

অর্থাৎ সন্ন্যাসী হওয়া যে ভূল হয়েছিল গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তা নিজেই স্বীকার করে গেছেন। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ সমাজ জীবনে প্রতিফলিত না হওয়ার কারণ পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্য্য কর্ত্তৃক প্রেরিত তরজা প্রহেলিকাটি শুনে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হঠাৎ একদিন সকলের অজান্তেই অন্তর্ধান (মতান্তরে আত্মগোপন) করলেন।

মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বা রহস্যময় আত্মগোপনের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যে হিন্দুর ধর্মীয় ও সমাজ ব্যবস্থা কতক গুলি কারণে- যথা পূর্বং- তথা পরং অর্থাৎ যা ছিল তাই হয়ে গেল। কারণসমূহ-

১. স্মার্ত, মায়াবাাদী ও গোড়া ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা শুরুতেই মহাপ্রভুর আদর্শ ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষন করে এর বিরোধিতা করত, আর মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর পূনরায় তারা আরও বেশি বিরোধিতা করতে থাকে। গোড়া ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা সহযোগিতা না করে বিরোধিতা করায় সমাজ জীবনে তার খুব একটা প্রতিফলন হয়নি। গোড়া ব্রাহ্মণরা যে মহাপ্রভুর বিরোধিতা করত শ্রীমদ্ভাগবতে তার উল্লেখ আছে।

চাপাল, গোপাল নামে বিপ্র (ব্রাহ্মণ) দূরাচার,
মহা অপরাধী নিন্দা করিত তোমার।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১১স্কন্ধ, ৮৯১পৃষ্ঠা)

২. মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করায় সংসারী মানুষের সাথে তার দুরত্ব বেড়ে গিয়েছিল এবং তার আদর্শে অনুপ্রাণিত বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বিশেষ বিশেষ একনিষ্ঠ ভক্ত রূপ সনাতন প্রমুখ গোঁসাইরা ছিল সংসার ত্যাগী, তাই সমাজে এদের কোন প্রভাব ছিল না, এজন্য মহাপ্রভুর লীলা অবসানের পর সমাজ জীবনে মহাপ্রভুর আদর্শ বাস্তবায়নে এরা খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনি।

৩. মহাপ্রভু তার ভক্তদের বলতেন-

“ঘরে ঘরে গিয়া আজ কর এই ভিক্ষা;
লহ কৃষ্ণ, কহ কৃষ্ণ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা”
-চৈ.চ.মধ্য

কিন্তু মহাপ্রভুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ভক্তরা স্থান বিশেষে মনের আনন্দে হরির নাম সংকীর্ত্তন করলেও পারিবারিক জীবনে ছিল তারা সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম।

সমাজপতি বা ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের কারণে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত ব্যক্তিগণ বৈদিক আচারে পূজা পার্বণে ব্যস্ত থেকে ব্রাহ্মণের আধিপত্য তথা ব্রাহ্মণ্যবাদকেই গ্রহণ করেছিল, তাই সমাজ জীবনে মহাপ্রভুর আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি।

৪. গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভূক্ত ভক্তদের কাছে শ্রীমদ্ভাগবত একটি অতি পবিত্র, পূজনীয় ও তার বিধি নিষেধ বিশেষ ভাবে পালনীয় ধর্মগ্রন্থ। কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যারা সংসারে থেকে হরিনাম সংকীর্ত্তন করে তাদেরকে বলা হয় গৃহী বৈষ্ণব, যারা সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয় তারা ত্যাগী বৈষ্ণব।

এই উভয় বৈষ্ণবগণই শ্রীমদ্ভাগবতকে অতিশয় শ্রদ্ধা করে এবং নিজ বাড়িতে বা হরি বাসরে নিত্য নৈমিত্তিক শ্রদ্ধার সাথে পাঠ করে থাকে, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা, বিধি-নিষেধ, আচার-আচরণ করণীয় কী? পালনীয় কী? বর্জনীয় কি? সব কিছুই এতে উল্লেখ আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-

অজ আর মার্জারের রেনু প্রভৃতি।
লাগয়ে আপন অঙ্গে ওহে মহামতি
তাহাতে যে পূর্বকৃত পূণ্য থাকে যত।
তাহার কারণ তার সব হয় হত
(*শ্রীমদ্ভাগবত ১২স্কন্ধ, ১০২৫পৃষ্ঠা)

এ কথার তাৎপর্য্য এই যেঃ- অজ সংস্কৃত ভাষা বাংলায়-ছাগল, মার্জরী সংস্কৃত ভাষা বাংলায় বিড়াল অর্থাৎ ছাগল ও বিড়ালের রেনু (নাদি, পশম) যদি দেহে স্পর্শ হয়ে যায় তাহলে উক্ত ব্যক্তির পূর্বকৃত যত পূণ্য ফল থাকে সবই নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত ব্যক্তিগণ শ্রীমদ্ভাগবত উপেক্ষা করে নিজ বাড়িতে ছাগল পালন করতে দ্বিধা করছে না। শ্রীমদ্ভাগবতে আরও বলা হয়েছে-

উদরের লাগি যারা পশু হত্যা করে।
পরলোকে মৃত পশু তাহারে সংহারে
আত্মসুখ লাগি যারা করে জীব হত্যা।

নাহি মানে ধর্মকর্ম হরি পরমাত্মা
স্ত্রী পুত্র স্নেহেতে যারা হইয়া মোহিত।
জীবের জীবন হিংসা করে অবিরত

নরকে ডুবিয়া অধঃপাতে তারা যায়।
আত্মঘাতী বলে সবে জগতে তাহায়
(শ্রীমদ্ভাগবত ১১স্কন্ধ, ৮৯০পৃষ্ঠা)

এ কথার তাৎপর্য্য এই যেঃ- মুখ রোচক খাদ্য হিসেবে পেট ভর্তি করার জন্য যারা পশু হত্যা করে, পরলোকে গিয়ে তাদের সেই পশুতেই সংহার করে। আত্মসুখ লাগি অর্থাৎ স্বর্গে গিয়ে সুখেবাস করব এজন্য পূণ্য সঞ্চয় করা দরকার এই উদ্দেশ্যে যারা ধর্মের নামে পশু বধ করে তারা আত্মঘাতী মহাপাপী।

স্ত্রী, পুত্র কন্যার স্নেহে মোহিত হয়ে যদি তাদের কারণে জীব হত্যা করে তাহলে সেই ব্যক্তিও মহাপাপী এজন্য অবশ্যই নরকে বাস করতে হবে, কিন্তু কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েও গৃহী বৈষ্ণবগণ বৈদিক আচারে পশুবলি দিয়ে আচার ভ্রষ্ট হওয়ার কারণে মহাপ্রভুর আদর্শ বৈষ্ণব ধর্ম সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে না। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-

যাহারা আচার ভ্রষ্ঠ হয় ভূমণ্ডেলে।
হরিপ্রাপ্তি তাহাদের না হয় কপালে
হরি তাহাদের প্রতি সদাই বিমুখ।
চিরকাল কষ্টপায় নাহি ঘুচে দুঃখ
(শ্রীমদ্ভাগবত, ১২ষ্কন্ধ, ৯৮৯ পৃষ্ঠা)

এ কথার তাৎপর্য্য এই যেঃ- যারা নিজ নিজ ধর্মের আচার আচরণ মানে না তারা ইহকাল ও পরকালে দুঃখ-কষ্ট পায় তারা কোন দিন হরি প্রাপ্তি হবে না। হরি তাদের প্রতি সদায় বিমুখ থাকে, স্বধর্মের আচার-আচরণ বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে যতই হরি হরি কর না কেন সবই নিষ্ফল হরি তাদের ভাগ্যে কোন দিনই মিলবে না, শ্রীমদ্ভাগবতে সেই কথাই বলা হয়েছে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সনাতন কে উদ্দেশ্য করে নিজেই বলেছেন-

জীবে দয়া, নামে রুচি, বৈষ্ণব সেবন।
ইহা হৈতে ধর্ম আর নাহি সনাতন।।

এ কথার তাৎপর্য্য এই যেঃ- জীবকে দয়া কর, জীবকে হত্যা কর না, ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে হরির নাম শ্রবণ কীর্ত্তন কর, শুধু আনন্দে মেতে থেকো না, সাধু গুরু বৈষ্ণব এর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি কর এটাই হচ্ছে ধর্মের মূল কথা এর উপরে আর ধর্ম-কর্ম নেই সনাতন, কিন্তু তৎকালীন বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভূক্ত গৃহী বৈষ্ণবগণ হরিনাম করতে করতে আত্মহারা হলেও পারিবারিক ও সমাজ জীবনে মহাপ্রভুর আদর্শের বৈষ্ণবধর্ম প্রতিফলিত হয়নি।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ইচ্ছা ছিল বর্ণ-বৈষম্যহীন প্রেম ভক্তি পূর্ণ বৈষ্ণব ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে সকল বর্ণের মানুষের হবে মহামিলন। জাতিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে ৪ জাতি, ৩৬ বর্ণ একাকার হয়ে মানুষে মানুষে থাকবে না কোন ভেদাভেদ নিম্নবর্ণের মানুষেরা পাবে ধর্ম কর্মে অধিকার ও মনুষ্যত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার আশ্রয়।

কিন্তু তা তো হলই না বরং বৈষ্ণবরা আরও একটি নূতন জাতি সৃষ্টি হয়ে ৫ জাতি, ৩৭ বর্ণ হল, তাছাড়া বৃন্দাবনের মাধুর্য্য রস আস্বাদন করতে গিয়ে বৈষ্ণবরা কেউ কেউ পরকীয়াবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। এই কারণেই মহাপ্রভুর আদর্শ সমাজে প্রতিফলিত হয়নি।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রমাণ-

তৎকালীন সময়ে নিম্ন ও উচ্চবর্ণ হিন্দু যারা কৃষ্ণমন্ত্র গ্রহণ করে বৈষ্ণব হয়েছিল, মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর তারাও ব্রাহ্মণের ন্যায় নিম্নবর্ণের হিন্দু শূদ্রদের অস্পৃশ্য মনে করে ঘৃনা করতে লাগল। বৈষ্ণব ধর্ম তথা কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্রের যে মিলন হয়নি তার জলন্ত প্রমাণ হচ্ছে ১৫৩৩ খ্রীঃ মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর থেকে ‘সতীমা’ আবির্ভাব কাল ১৭৩৫খ্রীঃ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০০ বছর।

তার পর বৃটিশ খৃষ্টানদের শাসনাধীন থেকে ১৯৪৭ খ্রীঃ পাক-ভারত স্বাধীন হওয়া, ভারতবর্ষ থেকে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত দুই শতাধিক বছর, মোট ৪০০শত বছরেরও অধিককাল পর্যন্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অস্পৃশ্য ভাবে দেখা হত।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার পর পাঁচশতাধিক বছর অতিবাহিত হয়েছে, সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দুদের প্রচেষ্টায় যতগুলি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশই শিব মন্দির, দূর্গা মন্দির, কালী মন্দির কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, গৌরাঙ্গ মন্দির নেই বললেই চলে, তার প্রমাণ গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরের মন্দির পরিক্রমা করলে সহজেই বোঝা যায়।ৱ

পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত কর্তৃক প্রেরিত তরজা প্রহেলিকাটি শুনে শ্রী চৈতন্য দেব কিছুদিন মৌন অবস্থায় ছিলেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ভক্তদের সাথেও কথা বলতেন না, তারপর হঠাৎ একদিন রাতের বেলা থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। শ্রী চৈতন্যদেব কে খুঁজে না পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিক, গবেষক ও ভক্ত মণ্ডলীর মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। ঐতিহাসিক গবেষকদের ধারণা।

নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, সাত্ত্বিকভাবে জীবনযাপন ও সাত্ত্বিক খাদ্য গ্রহণ করে, একই কৃষ্ণনাম (১৬ নাম বত্রিশ অক্ষর) জপ, কীর্ত্তন করা সত্বেও উচ্চবর্ণ হিন্দুরা তাদেরকে নামযজ্ঞের আঙ্গিনায় কীর্ত্তন করতে দিত না এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর বিগ্রহ ও মন্দির স্পর্শ করতে দিত না কিন্তু বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শের পরিপন্থী, কারণ ব্রাহ্মণ দিয়ে দেব-দেবীর পূজা করার অর্থই হল ব্রাহ্মণ্যবাদকে গ্রহণ করা।

কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ মত যদি ব্রাহ্মণ্যবাদ জাতিভেদ, বর্ণভেদ, কৌলিন্য প্রথা, অস্পৃশ্যতা বিল্প্তু হত, নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা যদি মানুষের অধিকার নিয়ে ধর্ম-কর্মে অধিকার পেত, তাহলে ইংরেজ শাসনামলে খৃষ্টান মিশনারীরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দলে দলে খৃষ্টান বানাতে পারত না এবং কর্তাভজা সত্যধর্ম প্রচারের প্রয়োজন হত না।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস গোরাচাঁদই আউলচাঁদ। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বর্ণ-বৈষম্যহীন যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন তার সেই ধর্মীয় আদর্শ সমাজ জীবনে প্রতিফলিত না হওয়ায়, তিনি ভাবলেন সংসারে থেকে কি ভাবে মালিকের উপাসনা করা যায় তার উপাসনা পদ্ধতি প্রচারের উদ্দেশ্যে গোপৗনাথ জীউর মন্দির থেকে আত্মগোপন করে নিত্যধাম ঘোষপাড়ায় এসে আউলচাঁদ রূপে কর্তাভজন সত্যধর্ম প্রচার করেন।

তবে শ্রীচৈতন্যর অন্তর্ধানের পর আউলচাঁদের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় দুইশত বছরের ব্যবধান, তাই এ বিষয়ে কারো কারো মতান্তর থাকতে পারে। তবে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস গোরাচাঁদই আউলচাঁদ। চৈতন্যদেব তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্যই আউলচাঁদ রূপে পুণরায় আবির্ভাব।

পরম বৈষ্ণব অদ্বৈত কর্তৃক প্রেরিত তরজা প্রহেলিকাটি শুনে শ্রী চৈতন্য দেব কিছুদিন মৌন অবস্থায় ছিলেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ভক্তদের সাথেও কথা বলতেন না, তারপর হঠাৎ একদিন রাতের বেলা থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। শ্রী চৈতন্যদেব কে খুঁজে না পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিক, গবেষক ও ভক্ত মণ্ডলীর মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। ঐতিহাসিক গবেষকদের ধারণা।

মহাপ্রভুর শত্রুরা তাকে হত্যা করে তার পঞ্চভৌতিক দেহ গুপ্ত করে ফেলেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহের সাথে মিশে গিয়ে অন্তর্ধান করেছেন, আবার কারো কারো মতে টোটা গোপীনাথ মন্দিরে গোপীনাথ জীউর বিগ্রহের সাথে মিশে অন্তর্ধান করেছেন।

কর্তাভজা ভক্তদের বিশ্বাস, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আদর্শ-উদ্দেশ্য সমাজে প্রতিফলিত না হওয়ায় এবং অদ্বৈত আচার্য্য কর্ত্তৃক প্রহেলিকার মাধ্যমে আজ্ঞা পেয়ে সংসারে থেকে কিভাবে মালিকের উপাসনা করা যায় তার বিধি-বিধান প্রচারের জন্য তিনি আত্মগোপন করেছিলেন এবং কিছুকাল বাংলা, বিহার ঘুরে অবশেষে ফকির বেশে আউলচাঁদ রূপে নিত্যধাম ঘোষপাড়ায় উদয় হয়ে কর্তাভজা সত্যধর্ম প্রচার করেন।

তবে এ ধারণার সাথেও অনেকে দ্বিমত পোষন করেন কারণ- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর অন্তর্ধান থেকে আউলচাঁদ মহাপ্রভুর আবির্ভাব কাল প্রায় দুইশত বছর, এতদিন শ্রীচৈতন্য দেবের মত একজন জ্যোতির্ময়ী মহাপুরুষ আত্মগোপন করে থাকল, আর প্রায় দুইশত বছরের মধ্যে কোথাও তার জ্যোতি ফুটে উঠল না, একথা বিশ্বাস করা কঠিন।

তবে কর্তাভজা সম্প্রদায়ভূক্ত ভক্তরা মনে করেন গোরাচাঁদই আউলচাঁদ, এইভাবে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর খোঁজ না পাওয়া সম্মন্ধে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। আউলচাঁদ মহাপ্রভু বলেছেন-

গুরুভক্তি অভিলাষে, থাকবি তক্তে বসে, নাম ধরে ডাকবি ওরে ভোলামন
মিলবে তোর মনের মানুষ যা বলি তাই শোন”
(ভাবেরগীত নং- ৩২৭, কলি-২)

ভাবার্থ: তোমরা গুরুর আশ্রিত হও, গুরুবাক্য পালন কর, গুরুকে শ্রদ্ধাভক্তি কর, একমাত্র চেতন গুরুই পারে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে পারমার্থিক মুক্তির সন্ধান দিতে, গুরুর কৃপা বিনে পারমার্থিক মুক্তি কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তিনি অন্যান্য ধর্মমত সম্মন্ধে বলেছেন-

দেখ পারের প্রকার আছে হে সুগম,
অধিকারো সংসার সবার, আছে যার যে নিময়।
ভার কি রে পার থেকে এ ভবে”
(‘ভাবেরগীত নং-২, কলি-৩)

ভাবার্থ: জাতি, ধর্ম, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মালিক উপাসনায় সকলের সমান অধিকার এবং ধর্মপথ সবার জন্য সুগম অর্থাৎ উন্মুক্ত, তাই যে, যে ধর্মের মানুষ হন না কেন, যার যে নিয়ম আছে সে, সেই নিয়ম যথাযথভাবে পালন করলেই মালিক প্রাপ্তি হতে পারে এতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ সকলের একই উদ্দেশ্য পরম সত্যকে ধারণ করা বা মালিক প্রাপ্তি।

আউলচাঁদ মহাপ্রভু আত্মপ্রকাশ করার পর অল্পদিন আনুমানিক ১৫ বছর, এই ধরাধমে ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ইহজাগতিক ভোগবিলাসে উদাসীন, অহংভাব বর্জিত এক মহাপুরুষ। দীন হীন ফকির বেশে আউলচাঁদ মহাপ্রভু যখন ঘোষপাড়ার অপর পারে গঙ্গা নদীর তীরে আবির্ভূত হন তখন গঙ্গা পারাপারের জন্য খেয়া নৌকার দায়িত্বে ছিল শঙ্কর পাল, ফকির ঠাকুর ওপারে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে মাঝিকে বললেন-

আমাকে পার করে দাও আমি ওপারে যাবো। তার বেশ দেখে মাঝি আগেই পারের পয়সা দাবী করল, তখন ঠাকুর বললেন আমি দীন হীন কাঙাল ফকির মানুষ, আমি পয়সা কোথায় পাব, আর আমিতো জীবনে পয়সা স্পর্শ করিনি তুমি আমাকে ধর্ম খেয়ায় পার করে দাও। মাঝি এসব কথায় কর্ণপাত না করে আপন মনে নৌকা বেয়ে মাঝ নদীতে চলে যেতে লাগল।

তখন আউলচাঁদ মহাপ্রভু হস্তস্থিত একটি মাটির পাত্র নিয়ে গঙ্গা নদীতে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘আও গঙ্গামায়ী ইস্কা ভিতর আও।” তখনই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা, শঙ্কর মাঝি দেখলেন গঙ্গার জলরাশি প্রবল বেগে ঐ মাটির পাত্রে ঢুকতে লাগল আর গঙ্গার বুকে তৈরি হল সুন্দর একটা পথ আর ফকির পদব্রজে গঙ্গা পার হয়ে চলে গেলেন, ঐ দৃশ্য দেখে শঙ্কর মাঝি কিছুক্ষণ জ্ঞানশূন্য ছিল।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলেন কিন্তু ঠাকুর যদি কৃপা করে নিজগুণে ধরা না দেন তবে কার সাধ্য তাকে ধরে, অকস্ম্যাৎ শুরু হল প্রবল ঝড়বৃষ্টি সেই ঝড় বৃষ্টির মাঝে ফকির হারিয়ে গেলেন তৎকালীন ডুবোপাড়া বর্তমানে ঘোষপাড়ার গহীন অরণ্যে, শঙ্কর মাঝি ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসলেন বাড়িতে।

বাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা ব্যক্ত করলে কেহ বিশ্বাস করলো না। কিন্তু শঙ্কর মাঝি নিজের চোখকে অবিশ্বাস কি করে করবে তাই সে ফকির বেশী ঐ মহাপুরুষের পুনরায় দর্শনের চিন্তায় অর্ধ জাগ্রত, অর্ধ নিদ্রায় তার রাত কাটতে লাগল। একদিন শঙ্কর স্বপ্ন দেখলেন ফকির বেশী ঐ মহাপুরুষ পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে কৃষ্ণদাসের বাড়ি সাধুসঙ্গ করছেন।

মানুষের যখন জ্ঞানের উদয় হয় তখন সে তার স্বরূপকে চিনতে পারে তার ইহজগতের স্বপ্নময় মোহ দূর হয়, তখন সে তার পূর্বকৃত্য সকল ভূলক্রটির জন্য অনুতপ্ত হয়, নিজেকে অপরাধী জ্ঞান করে এবং নিজের পূর্বকৃত্য সকল ভূলক্রটির জন্য শুধু মালিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে, মনে যদি সত্যিই সেই ভাবের উদয় হয় তাহলে মালিক তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে।

জাগ্রত হয়ে শঙ্করের মনটা যেন অনাবিল আনন্দে ভরে গেল এবং ভাবলেন নিশ্চয় ঠাকুরের দর্শন মিলবে। ভোর হওয়ার সাথে সাথে শঙ্কর কৃষ্ণদাসের বাড়িতে উপস্থিত হল কিন্তু শঙ্করের আশা পূর্ণ হল না, ফকির বেশী ঐ মহাপুরুষের কথা জিজ্ঞাসা করলে কৃষ্ণদাস বললেন একজন সাধু পুরুষ গতরাত্রে এখানে এসেছিলেন।

তার সাথে সারারাত সাধুসঙ্গ করেছি কিন্তু তিনি কিছুক্ষণ আগে এখান থেকে চলে গেছেন, তবে কোথায় গেছেন তা জানি না, শঙ্কর আবার বিফল মনোরথ হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। ডুবোপাড়া গহীন অরণ্যের অনতি দূরেই ছিল শঙ্করের বসত বাড়ি, শঙ্কর বাড়ি ফেরার পথে ঐ বনের কাছে আসলে বনের মধ্য থেকে দৈববাণীর ন্যায় একটা শব্দ শুনতে পেলেন।

কে যেন বলছে আমি বেটুয়ার মধ্যে যে সত্যরত্ন এনেছি এ দেশে তার প্রকৃত গ্রাহক খুঁজে পেলাম না, এ দেশে গ্রাহকের বড়ই কোটকেনা (অর্থাৎ অভাব)।

ঐ শব্দ শুনে শঙ্কর কিছুটা ভয়ে কিছুটা সাহসে ভর করে বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং দেখতে পেলেন সেই দিব্য কান্তি সৌম্য শান্ত মহাপুরুষ যার দর্শনের আশায় আহার নিদ্রা কাজ কর্মত্যাগ করে বিরহী উদাসীনির ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শঙ্কর দীন হীন ফকির বেশী ঠাকুরের দর্শন পাওয়া মাত্রই কাঁদাতে কাঁদতে ঠাকুরের চরণে লুটায়ে পড়ল।

এবং অনুতপ্ত বেদনায় শঙ্করের ক্রন্দনরত অশ্রুধারায় ঠাকুরের চরণ সিক্ত থেকে লাগল, ঠাকুর শঙ্করের হাত ধরে তুলে বসালেন এবং বললেন এত কাদছিস, কেন, শান্ত হ বল না তোর কি হয়েছে।

শঙ্কর বললেন, আমি অজ্ঞান বালক না জেনে না বুঝে সাধারণ ফকির মনে করে গতকাল তোমাকে খেয়া নৌকায় পার করিনি, এ জন্য আমি অনুতপ্ত, বেদনাহত আমাকে ক্ষমা কর ঠাকুর। তুমি নিজ গুণে কৃপা করে আমাকে ক্ষমা কর ঠাকুর, এ কথা বলতে বলতে শঙ্কর পুনরায় ফকির ঠাকুরের চরণ ধরে কাঁদতে লাগল।

ফকির ঠাকুর শঙ্করকে শান্তনা করে বললেন, “মানুষ যতক্ষণ মায়া মোহরূপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকে ততক্ষণ সে তার নিজেকে চিনতে পারে না আর নিজেকে চিনতে না পারলে অপরকেও চেনা যায় না।

মানুষের যখন জ্ঞানের উদয় হয় তখন সে তার স্বরূপকে চিনতে পারে তার ইহজগতের স্বপ্নময় মোহ দূর হয়, তখন সে তার পূর্বকৃত্য সকল ভূলক্রটির জন্য অনুতপ্ত হয়, নিজেকে অপরাধী জ্ঞান করে এবং নিজের পূর্বকৃত্য সকল ভূলক্রটির জন্য শুধু মালিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে, মনে যদি সত্যিই সেই ভাবের উদয় হয় তাহলে মালিক তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে।

ফকির ঠাকুরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে শঙ্করের কনিষ্ঠ পুত্র রামশরণ ও পুত্রবধু স্বরসতী বিস্মিত হলেন। ঠাকুরকে আরও কিছু দিন নিজ গৃহে রাখার জন্য অনুরোধ করল, কিন্তু ফকির ঠাকুর কিছুতেই রাজী হলেন না, তবে রামশরণের অনুরোধে ফকির ঠাকুর বললেন আমাকে যদি রাখতে চাস তাহলে তোর গৃহে নয় ঐ বনের মধ্যে (বর্তমান ঘোষপাড়া) একটি কুঁড়ে ঘর বেঁধে দে আমি ওখানে থাকবো।

তোর যখন মনে সেই ভাবের উদয় হয়েছে আর চিন্তা করিসনে মালিক তোর সকল অপরাধ ক্ষমা করবেন এখন হাসিমুখে গৃহে ফিরে যা।” একথা গুনে শঙ্কর কিছুটা শান্ত মনে ঠাকুরকে বললেন, “ওগো ঠাকুর কৃপা করে এ অধমকে যখন পুনরায় দর্শন দিয়েছ, তখন এ অধমের পূর্ণ কুটিরে একটু চরণধুলি দিতেই হবে।”

ফকির ঠাকুর বললেন, “আমি একজন পাগল, দীনহীন ফকির আমাকে গৃহে নেওয়ার জন্য এত উৎসাহিত হচ্ছো কেন? আমি কত পাগলামি করব কত দৌরাত্ম করব এসব সহ্য হবে কি?” শঙ্কর বললেন, “সব কিছুই ঠাকুরের অনুগ্রহমাত্র, ঠাকুর যদি সবকিছু সইবার শক্তি যোগায় তাহলে সবকিছুই সইতে পারব বৈকী।”

ঠাকুর দেখলেন শঙ্করের মনে যে ভাবের উদয় হয়েছে তাকে আর কোন কথায় ভোলানো যাবে না, অবশেষে ঠাকুর শঙ্করের গৃহে যেতে রাজি হলেন, তবে তিনি বললেন আমি মাত্র দুই-এক দিন থাকব, আমি চলে যেতে চাইলে কোনক্রমেই আপত্তি করবে না। শঙ্কর বললেন, সেটাও প্রভুর কৃপা মাত্র, অতপর ফকির ঠাকুর শঙ্করের সাথে শঙ্করের গৃহে গমন করলেন।

ফকিরকে গৃহে পেয়ে শঙ্করের বাড়ির সকলেই অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং সাধ্য মত সেবাযত্ন, শ্রদ্ধা ভক্তি করলেন। ফকিরের ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা শুনে দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যধি আক্রান্ত শঙ্করের ছোট ভাই সদানন্দ রোগমুক্তির আশায় ফকিরের চরণ ধরে কাঁদতে লাগল।

‘ফকির’ সদানন্দের জীবনের সকল পাপকর্মের নিকাশ গ্রহণ করলেন এবং ভবিষ্যতে সত্যবলা সৎপথে চলার অঙ্গীকার করতঃ মুহুর্তের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে সদানন্দের রোগমুক্তি করলেন। এই ঘটনা দেখে শঙ্করের বাড়ির সকলে ও প্রতিবেশীরা হতবাক হয়ে গেলেন। তখন থেকেই তিনি ফকির ঠাকুর নামে পরিচিতি পেলেন।

ফকির ঠাকুরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে শঙ্করের কনিষ্ঠ পুত্র রামশরণ ও পুত্রবধু স্বরসতী বিস্মিত হলেন। ঠাকুরকে আরও কিছু দিন নিজ গৃহে রাখার জন্য অনুরোধ করল, কিন্তু ফকির ঠাকুর কিছুতেই রাজী হলেন না, তবে রামশরণের অনুরোধে ফকির ঠাকুর বললেন আমাকে যদি রাখতে চাস তাহলে তোর গৃহে নয় ঐ বনের মধ্যে (বর্তমান ঘোষপাড়া) একটি কুঁড়ে ঘর বেঁধে দে আমি ওখানে থাকবো।

তবে আমি চলে যেতে চাইলে বাঁধা দিবি না, রামশরণ বললেন সে তো ঠাকুরের কৃপা মাত্র। এই ভাবে ঠাকুরের ইচ্ছামত রামশরণ বনের মধ্যে ছোট্ট একটি তাল পাতার কুঁড়ে ঘর বেঁধেদিলেন, ফকির ঠাকুর ঐ নির্জনে একাকী থাকতে লাগলেন।

…………………………………..
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
১. ভবের গীত
২. কর্তাভজা সত্যধর্ম

…………………………………..
আরও পড়ুন-
নদের নিমাই
যুগে যুগে মহাপ্রভু
প্রসঙ্গ ‘শ্রীচৈতন্যদেব’
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
বৈষ্ণব মতবাদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা সত্যধর্মের ৩০ ধারা
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষাগ্রহণ
সতী মা
কর্তাভজা সত্যধর্ম
কর্তাভজার দশ আজ্ঞা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
ডালিম তলার মাহাত্ম্য
বাইশ ফকিরের নাম
কর্তা
দুলালচাঁদ
কর্তাভজা সত্যধর্মের পাঁচ স্তম্ভ
সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
ভাবেরগীত এর মাহাত্ম্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Rakhal das , বুধবার ৩ মে ২০২৩ @ ৩:৫২ অপরাহ্ণ

    চার জাতী কি কি? ছত্রিশ বর্ণ কি কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!