ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ

-ড. এমদাদুল হক

১৮০
ঈশ্বর এই জগতের নিয়ন্তা, অথচ জগতে এতো নিষ্ঠুরতা কেন? কেন এতো অন্যায়?

এই প্রশ্নের একটিই উত্তর- কর্মফল।

ঈশ্বর অন্যায় করেন না, ন্যায়ও করেন না। ঈশ্বর শক্তিরই আরেক নাম। শক্তি ন্যায়-অন্যায় করে না। ন্যায়-অন্যায় করে মানুষ; আপন মূল্যবোধে। এবং ভোগ করে নিজ কৃতকর্মের ফল।

ঈশ্বর ধর্ষকামী নন। মানুষকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য তাঁর নেই। দরিদ্রতা, অন্ধত্ব, বিকলাঙ্গতা সবই প্রারব্ধ- জের।
স্বরূপে জীব শুদ্ধ, পবিত্র। কর্ম তার স্বরূপ আবৃত করে রাখে। আধ্যাত্মিক পরিভাষায় একে বলা হয় অবিদ্যা।
অবিদ্যা দূর হলে জীব তার স্বরূপ-শুদ্ধতায় ফিরে যায়।

স্বরূপ দর্শন না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে জীবনের ভ্রমণ- জীবন থেকে জীবনে।

জীবন মানেই স্বরূপ দর্শনের আরেকটি সুযোগ।

মানবদেহ ধারণ করা মানে ‘কর্মদেহ’ ধারণ করা। মানবদেহ বা কর্মদেহই নির্ধারণ করে মানুষের নিয়তি। এই অর্থেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। দেবগণও (ফেরেশতা) সৃষ্টি। মানুষ সৃষ্টির সেরা মানে দেবগণ থেকেও তার মর্যাদা উচ্চতর।

আত্মা বা আমি অপরিণামী। শিশু, বালক, যুবক, বৃদ্ধ ইত্যাদি দেহের অবস্থা- আমি বা আত্মার অবস্থা নয়। দেহ নানা আকার ধারণ করে, মন পরিবর্তিত হয়, কিন্তু আমি শাশ্বত।

যে-সব কর্ম দ্বারা আত্মা আবৃত হয় সেগুলি পাপ। যে-সব কর্ম দ্বারা আত্মা উন্মোচিত হয় সেগুলি পুণ্য।
পুণ্য কর্ম দ্বারা আত্মদর্শনই জীবনের গন্তব্য।

আত্মদর্শনে হয় সত্যদর্শন। জীবনের স্বপ্ন ভেঙে গেলে উপলব্ধিতে আসে জীবনের আসা-যাওয়া স্বপ্ন মাত্র। স্বরূপ অনন্ত। অনন্ত যাবে কোথায়? আসবে কোথা থেকে?

আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, শত্রু নাই, মিত্র নাই, পিতা নাই, পুত্র নাই, জন্ম নেয় না, জন্ম দেয় না। আত্মা অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ। এই উপলব্ধিই জ্ঞান। একেই বলে ‘আমিত্ব’ লাভ করা- সমগ্র জগৎকে নিজের দেহ বোধ হওয়া, জগতের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া।

অহং এর দেহটি ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র দেহের সুখ, কত বড়ই না মনে হয় আমাদের কাছে! সমগ্র জগৎ যদি আমার দেহ হয়, তবে সুখানুভব কেমন হতে পারে? এই অনন্ত অসীম সুখের উপলব্ধিকে বলা হয় পরমানন্দ।
‘তত্ত্বমসি’ ইহাই পরম সত্য।

২০১
নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অশ্বত্থ গাছের নীচে আসন নিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। দৃঢ় সংকল্প- সত্যলাভ না করে উঠবেন না। কতো লোকই তো এমন প্রতিজ্ঞা করে, তিন দিনও যায় না।

ঊনপঞ্চাশ দিন কেটে গেল। সিদ্ধার্থ উঠছেন না। সুতরাং ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো ত্রিলোকে। পাতাল লোকে মার (শয়তান) জরুরি সভা ডাকলো। আর দেরী করা যায় না। আক্রমণের সিদ্ধান্ত হলো।

প্রথম আক্রমণ করলো কাম সেনা। চোখে জেগে উঠলো সুন্দরী রমনীর রূপ দর্শনের ইচ্ছা। মনে জাগলো রমণের ইচ্ছা। ঠোঁটে জাগলো চুম্বনের ইচ্ছা। কর্ণে জাগলো পুলক শব্দ শ্রবণের ইচ্ছা। নাসিকায় জাগলো ঘ্রাণ নেওয়ার ইচ্ছা।

তিনি পাত্তা দিলেন না। ক্রমান্বয়ে আক্রমণ করলো ক্ষুৎ-পিপাসা, নিদ্রা, ভয়, সংশয় সেনারা। সবাই হেরে গেলো। সিদ্ধার্থ বোধি লাভ করলেন। বুদ্ধ হলেন।

আমরা তো এমন কোনো সংকল্প নেই নি যে, বোধি লাভ না করে আসন ত্যাগ করবো না! তবে কেন মার আমাদের পিছু নেয়?

আসলে, মার আমাদের পিছু নেয় না! আমরাই মারের পিছু নিই। কাম আমাদের পিছু নেয় না। আমরাই কামের পিছু নেই। নারীদেহের ছবি দেখলেই হাজার লাইক!

আমরা এখন ক্ষুধা লাগলে খাই না। খাওয়ার সময় হয়েছে, খেতে মজা লাগে কিংবা ফ্রি পাওয়া গেছে তাই খাই।
নিদ্রা আমাদের আক্রমণ করে না, আমরাই নিদ্রাকে আক্রমণ করি। ঘুম না পেলে, ওষুধ খেয়ে ঘুমাই।

আমাদেরকে ভয় দেখাতে হয় না। আমরা ভয়ের মধ্যেই আছি।

সন্দেহ আমাদের পিছু নেয় না। আমরাই সন্দেহের পিছু নেই। চুন খেয়ে গাল পুড়েছে, তাই দই দেখলেও এখন সন্দেহ হয়।

মারামারি এখন আর লাগাতে হয় না। লেগেই আছে। মার সেনারা এখন ছুটিতে। কতদিনের ছুটি?

ততদিনের, যতদিন পর্যন্ত না আবার কোনো এক নৈরঞ্জনা নদীর তীরে, কোনো এক অশ্বত্থ গাছের নীচে আসন নিবেন কোনো এক সিদ্ধার্থ।

২০২

“জঁহা রাম তহাঁ কাম নহীঁ,
জঁহা কাম তহাঁ নহী রাম।
দুঁহু মিলত নহীঁ
রব রজনী নহীঁ মিলত একঠাম” [তুলসীদাস]।

কামের সঙ্গে থাকে উত্তেজনা। প্রেমের সঙ্গে থাকে প্রশান্তি।
তার মানে, উত্তেজনা দূর করো, প্রশান্তির পরশ লাগবে হৃদয়ে।
কামের সংযোগ অজ্ঞতার সঙ্গে। প্রেমের সংযোগ জ্ঞানের সঙ্গে।
তার মানে, অজ্ঞতা দূর করো- জ্ঞানের কিরণ প্রবেশ করবে হৃদয়ে।

কাম চায় অন্ধকার। প্রেম চায় আলো। তার মানে, আলো জ্বালাও। অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। জন্ম অন্ধকারেই হয়, কিন্তু অন্ধকারে থাকার জন্য নয়- আলোর দিকে যাওয়ার জন্য। পঙ্কেই পঙ্কজ জন্ম নেয়, কিন্তু পঙ্কে থাকার জন্য নয়- আকাশে উড়াল দেওয়ার জন্য।

প্রেম হলো জীবনের কেন্দ্র। কাম হলো বৃত্তচাপ।
কাম প্রয়োজন- প্রেম সমর্পণ।
কাম চুক্তি- প্রেম মুক্তি।
কামের তৃপ্তি ভোগে- প্রেমের তৃপ্তি ত্যাগে।
পাওয়ার ইচ্ছা কামের লক্ষণ।
দেওয়ার ইচ্ছা প্রেমের লক্ষণ।
কাম চঞ্চল- প্রেম ধীর।
কাম অশান্ত- প্রেম প্রশান্ত।
কাম বিধ্বংসী- প্রেম সৃষ্টিশীল।

কাম শুরু হয় বিচ্ছিন্নতা থেকে, তৃপ্ত হয় মিলনে শেষ হয় নিঃসঙ্গতায়।
প্রেম শুরু হয় একাকিত্বে। তৃপ্ত হয় একাত্মতায়। চলতে থাকে অনন্তে।
কামের সঙ্গে থাকে লোলুপতা। প্রেমের সঙ্গে থাকে শ্রদ্ধা।
কামের সঙ্গে থাকে সন্দেহ। প্রেমের সঙ্গে থাকে বিশ্বাস।
কামুকের দৃষ্টি থাকে দেহে। প্রেমিকের দৃষ্টি থাকে মনে।

কামে যখন মন ঢাকা পড়ে যায়, তখন মানুষ রূপ দেখে- মন দেখে না। মনটা তখন হা-হুতাশ করে মরে।
মানুষ প্রেমে পড়ে না- কামে পড়ে।
প্রেমে উঠা যায়- পড়া যায় না।
হঠাৎ পড়া যায়- হঠাৎ উঠা যায় না।

কামে পড়তে সময় লাগে না, সাধনা লাগে না। জল নিচের দিকে এমনিতেই গড়িয়ে পড়ে। জল উপরে তোলা কঠিন। প্রেমে উঠাও কঠিন- সময় লাগে, সাধনা লাগে।

“ভবে সাধন বিনা সে ধন মিলে না,
কর সাধন, পূর্ণ হবে মনস্কামনা।”

২০৩
আধ্যাত্মিকতা এখন চিতল পিঠার মতো হয়ে গেছে। পথের ধারে বিক্রি হয়। ভর্তা ফ্রি।

কর্পোরেট গুরুদের মার্কেটিং চলছে অবিরত। ফেসবুক, ইউটিউব, বইয়ের দোকানে ধর্মবটিকার ছড়াছড়ি। স্কাই শপে বিক্রি হচ্ছে আল্লাহ লকেট! ফুটপাতে কিতাবের প্লাবন। মসজিদ টু মসজিদ বিচরণ। উপরন্তু ওয়াজ টু ওরসের সিজন।

তিনজন মানুষের উপস্থিতিতে এমন কোনো শাস্ত্রবাণী উদ্ধৃতির সুযোগ নেই, যা অন্তত দুইজন জানে না।

মারেফাতের গোপন কথা এখন আর গোপন নেই। গোপনেরও গোপন কথা বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বৃহস্পতিবারে বায়াত হও, শুক্রবারে প্রচার কর, শনিবারে গউস পাক।

ভালোই তো- ক্ষতি কি?

প্রথম ক্ষতি: পথের পিঠা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেলে পরমান্ন খাওয়ার ইচ্ছাটি মন থেকে উঠে যায়। দইকেও মনে হয় চুন। মনে সন্দেহ জাগে- ‘সবাই ভণ্ড। সবাই ভালো-ভালো কথা বলে, আর খারাপ-খারাপ কাজ করে’।

দ্বিতীয় ক্ষতি: শোনা কথা ও মিথ্যাচারে ডুবে যাওয়া। পারমার্থিক মিথ্যাচারগুলো পার্থিব মিথ্যাচার থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর। পার্থিব মিথ্যাচারে অর্থ ক্ষতি হয় কিন্তু পারমার্থিক মিথ্যাচারে আত্মার ক্ষতি হয়। অর্থের ক্ষতি পূরণ করা সহজ, কিন্তু আত্মিক ক্ষতি পূরণ করা খুবই দুরূহ।

তৃতীয় ক্ষতি: রোগাক্রান্ত হওয়া।

কি রোগ?

অহং রোগ।

কি অহং?

সব আধ্যাত্মিক রহস্য জেনে যাওয়ার অহং।

এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করে কথার মারপেঁচ শিখা যায়। আধ্যাত্মিকতা কি কথার শিল্প? এতো সহজ?

“যার মুর্শিদ নেই, তার মুর্শিদ শয়তান”- তোমার মুর্শিদ আছে, সুতরাং তুমি আল্লাহ হয়ে গেছো? মেডিটেশনের কোর্স করেছো, কয়েকদিন গান-বাজনা, মিলাদ করেছো, এরই মধ্যে তুমি ‘কলন্দর’ হয়ে গেলে? সুলতানুল আউলিয়া?

লে হালুয়া।

আধ্যাত্মিক সাহিত্যে রত্ন যেমন আছে, তেমনি আছে ছাইভস্ম। পথেঘাটে ছাইভস্মই বিক্রি হয়- রত্ন বিক্রি হয় না। ধর্মব্যবসা এখন তুঙ্গে। ধর্মের নামে অধর্মের দোকানে ভরে গেছে দেশটা। চারিদিকে এতো প্রতারণার জাল বিছানো রয়েছে, যা কল্পনারও অতীত। বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তার প্রচার বাড়ছে মারাত্মকভাবে। ফলে অধ্যেতারা আলোর পথে না গিয়ে অন্ধকারে পতিত হচ্ছে গণহারে।

বড় বড় গুরুরা ব্যবসা, খ্যাতি ও প্রতিপত্তির স্বার্থে আধ্যাত্মিক মিথ্যাচার প্রচার করছে । অধ্যেতারা তাদের প্রতারণা ধরতে পারছে না। যারা বলছে, ইমামতি করে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ নয়, তারাই কৌশলে অনুসারীদের ফতুর করে দিচ্ছে।

ভণ্ডরা সফল- প্রকৃতরা ব্যর্থ। এমতাবস্থায় কার কাছে যাবো, কাকে বিশ্বাস করবো, কী চিন্তা করবো, কোন পদ্ধতি অনুশীলন করবো, তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। এবং অবশ্যই, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন সতর্ক থাকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

(শেষ)

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!