ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ ২

-ড. এমদাদুল হক

৮১
এক নিখুঁত আবৃত্তিকার সমাবেশে একটি চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করলেন। দর্শক, শ্রোতারা তুমুল করতালিতে তাকে অভিনন্দন জানালো।

একটু পর, একই কবিতা তিনি আবার আবৃত্তি করলেন- এবারও কিছু লোক করতালি দিল। একই কবিতা, একই সুরে ও ভঙ্গিতে তিনি আরো কয়েকবার আবৃত্তি করলেন। অবশেষে লোকে তাকে তিরস্কার করে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিল।

জীবন থেকে কোনো শিক্ষাই তিনি নিলেন না। একই দিনে, তিনি আরো ৪টি অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন, প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে একই কবিতা বারবার আবৃত্তি করে নিগৃহীত হলেন। কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- জীবন থেকে শিক্ষা নিবেন না। যতদিন বেঁচে থাকবেন, একই কবিতার আবৃত্তি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যাবেন।

তবু লোকে তাকে অনুষ্ঠানে ডাকে কেন? কারণ যারা ডাকে তারাও এমনই। একই সুরে প্রতিদিন আহ্বায়ক আহ্বান করে যাচ্ছেন- “তিনি সবার বড়, তিনি সবার বড়… তিনি সবার বড়, তিনি সবার বড়।”

আচ্ছা, যিনি প্রকৃতই সবার বড়, তাকে যদি বারবার মাইক ফাটিয়ে চিৎকার করে শুনানো হয়, ‘আপনি সবার বড়, আপনি সবার বড়’, তবে কি তাকে ছোট করা হয় না?

জোসেফ গোয়েবেল প্রমাণ করে গেছেন- “মিথ্যা বারবার বলতে হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্যের মতো শোনায়।” এ থেকে কি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে, “সত্য বারবার বলতে হয় না; সত্য বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়?”

৮২
আমরা বসে আছি সেই পূর্বধারণা নিয়ে, ‘কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না‘। কেষ্ট আমার কষ্ট দিয়ে কী করবে? কোন নির্দয় পিতা চায় পুত্র কষ্ট করে পিতার ভালোবাসা অর্জন করুক? পিতার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যদি পুত্রকে শর্ত পূরণ করতে হয়, তবে মহান পিতার মহত্ব থাকে কোথায়?

সুতরাং ‘কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মিলে না’- ধারণাটি ঠিক না। দুনিয়ার সবকিছু পাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হয়, শুধু কেষ্ট পাওয়ার জন্য কোনো কষ্ট করতে হয় না।

যে পুত্র সৎকর্মপরায়ণ, সৎ জীবিকা অর্জন করে, যার আচরণ ভালো, যে দয়াশীল, বিনয় যার স্বভাব পিতার আশীর্বাদ সেই পুত্রের সঙ্গে সর্বদাই থাকে।

যে পুত্র সারাদিন ‘আব্বা, আব্বা’ করে, কিন্তু লেখাপড়া করে না, জীবিকার জন্য পরনির্ভরশীল থাকে, পরম পিতা এমন অকর্মণ্য অথর্ব পুত্রের কাছ থেকে ‘আব্বা’ ডাক শুনতে চায় না।

“সুতরাং বলে দাও সে যেন আমাকে না ডাকে, আমি যদি তার ডাকে সাড়া দেই, তবে লানৎ ছাড়া সে আর কিছুই পাবে না।”

ইশা আ. একবার এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তুমি কি কর?’ লোকটি বলল, ‘ইবাদত করি’।

-‘তোমার সংসার চলে কীভাবে?’

– ‘ভক্তরা চালায়’।

ইশা আ. বললেন- ‘ভক্তরা তোমার চেয়ে বড় আবেদ’।

৮৩
শিক্ষা হলো বাহিরের তথ্য ভেতরে ঢুকানোর প্রক্রিয়া। দীক্ষা হলো ভেতরের তথ্য বাহির করার প্রক্রিয়া। শিক্ষকের কাজ শাস্ত্র বুঝিয়ে দেওয়া। গুরুর কাজ জীবনশাস্ত্র পাঠ করার প্রেরণা দেওয়া।

শিক্ষকের কাজ পড়া দেওয়া, পড়া ধরা- দীক্ষকের কাজ শুধু স্মরণ কার্যে সহযোগিতা করা। শিক্ষার শিখা দ্বারা অহং স্ফীত হয়। দীক্ষার দীপ দ্বারা অহং ক্ষয় হয়।

শিক্ষা বাসনা জাগায়। দীক্ষা বাসনা নিভায়। শিক্ষা প্রতিযোগিতা শেখায়। দীক্ষা সহযোগিতা শেখায়। শিক্ষকতা চাকরি। দীক্ষকতা স্বেচ্ছা সেবা।

শিক্ষার বিষয়বস্তু পড়তে হয়, মুখস্থ করতে হয়। দীক্ষার বিষয়বস্তু পড়তেও হয় না, মুখস্থও করতে হয় না। শিক্ষার বিষয়বস্তু (a+b)²= a²+2ab+b², F=ma. দীক্ষার বিষয়বস্তু- সম্পর্ক, প্রেম, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভক্তি, আনন্দ।

শিক্ষার বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হয়, তাই নতুন-নতুন বিষয় শিখতেও হয়।

শিক্ষা সমসাময়িক- দীক্ষা শাশ্বত। শাশ্বত মানে যা ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। শিক্ষার শেষ আছে- দীক্ষার শেষ নাই।

যদি কেউ মনে করে, তার দীক্ষা শেষ হয়ে গেছে- তবে সেও শেষ হয়ে গেছে। সে স্মরণ করতে পারেনি, সে কে।

৮৬
সুফিবাদের দারিদ্র্য: “সুফিবাদই মুক্তির একমাত্র পথ” এমন অহেতুক দাবী করা।

শাস্ত্রের বিরোধিতা করা, অথচ সর্বক্ষণ শাস্ত্র কচলানো। কুরআনের রূপক অর্থ আবিষ্কার করা, অথচ সুফিদের নামে প্রচলিত আজগুবি গল্পগুলো আক্ষরিক অর্থে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা।

ভরণ-পোষণের জন্য অনুসারীদের উপর নির্ভর করা। মুশকিল-আসান ও সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া।
ভয় ও লোভ দেখানো।

মানত।

বিত্তবান ও মূর্খদের কাছে টানা এবং বিত্তহীন ও জ্ঞানীদের দূরে রাখা।

পরচর্চা ও পরনিন্দা।

গুরু-শিষ্যের মধ্যে মালিক ও দাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা। সমর্পণের নামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করা। গুরুর মহিমাকীর্তন করতে করতে তাকে আকাশে তুলে ফেলা এবং তার নামে বানোয়াট অলৌকিক ঘটনা প্রচার করা।

মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া, অথচ প্রচার করা যে- ‘তাঁর মৃত্যু হয় নি, আক্ষরিক অর্থেই তিনি জীবিত ও জীবিকা প্রাপ্ত।’ যাকে-তাকে খিলাফত প্রদান করে ধর্মব্যবসার সম্প্রসারণ।

সুফিদেরকে অঞ্চল, প্রদেশ, দেশ, মহাদেশ, পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের পরিচালক হিসেবে প্রচার করা। নামের আগে অস্বাভাবিক লম্বা ও অর্থহীন উপাধি ধারণ করা। সাধারণ মানুষের সামনে এক ধরনের কথা বলা, আর ভেতরে ভেতরে ভিন্ন কথা বলা।

লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা করা। পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণে প্রথার অনুসরণ করা। রতি সাধানার নামে ব্যভিচার ও ‘পঞ্চরস‘ নামক দেহ বর্জ্য পানের মতো গাধামি চর্চা ইত্যাদি। দরিদ্রতা দূরীকরণের প্রথম পদক্ষেপ, বাস্তবতা স্বীকার করা।

৯০
পাখিরা দুনিয়াটিকে পশুদের চেয়ে একটু বেশিই জানে বৈকি। পশুরা বাস করে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে, আর পাখিরা উড়ে বেড়ায় দেশ হতে দেশ দেশান্তরে।

পশুর সঙ্গে পাখির বন্ধুত্ব হয় না। এদের বিচরণ ক্ষেত্র আলাদা।

পাখিদের মধ্যেও কতো প্রজাতি! প্রত্যেক প্রজাতির জীবন চলার পথ ভিন্ন। ময়ূরের সঙ্গে ময়ূর থাকে। কাকের সঙ্গে কাক থাকে। কাক ও ময়ূর যদি ঘটনাক্রমে বন্ধু হয়েও যায়- একসঙ্গে বেশিদিন থাকতে পারে না। তাই বিরোধ পরিহার করার জন্যই আনফলো, আনফ্রেন্ড করতে হয়, ব্লক করতে হয়। এতে ময়ূরেরও লাভ, কাকেরও লাভ।

ময়ূর খুঁজে ময়ূর। কাক খুঁজে কাক। আমি যাকে খুঁজি, সেও আমাকে খুঁজে। আমি তার সঙ্গে থাকি না, যার সঙ্গে তুমি থাকো। তুমিও তার সঙ্গে থাকো না, যার সঙ্গে আমি থাকি। সুতরাং তোমার কর্ম তোমার জন্য, আমার কর্ম আমার জন্য।

দুটি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হলে যেমন দুটি গাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি দুজন মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ হলে দুজনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিরোধিতা দ্বারা বিরোধেরও নিষ্পত্তি হয় না। এতে বরং উভয়ের শক্তি হ্রাস পায়। কাকের শক্তি বৃদ্ধি পায় কাকযোগে, ময়ূরের শক্তি বৃদ্ধি পায় ময়ূরযোগে। সুতরাং যোগের জন্যই বিরোধ পরিহার করা শ্রেয়।

ময়ূরগুলো একসঙ্গে সুখে থাকুক। কাকগুলোও একসঙ্গে সুখে থাকুক। সকলের মঙ্গল হোক।

(চলবে…)

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!