ভবঘুরেকথা
শ্রীকৃষ্ণ কালা দোল উৎসব

-ড সৌরভ মণ্ডল

দোল অর্থাৎ দোলায়মান বা দুলিতে থাকা। এই জগৎ সংসারে প্রাণের চঞ্চল ভাব, মনের চঞ্চলতা। যাহা সদাই দোদুল্যমান। আমার মন স্থির নয় বলিয়া, ‘আমি’ ও ‘আমার’ নয়নপথ স্থিত সমস্ত বিষয় দুলিতেছে বলিয়া বোধ হয়। এই দোলনার দোল না থামিলে আমার দোলায়মান অবস্থার নিবৃত্তি অসম্ভব।

আমি জীবিত কারণ আমার মধ্যে প্রাণ আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসই তার প্রমাণ। এই শ্বাস ও প্রশ্বাস সদা সর্বদাই বহিতেছে বা দুলিতেছে। আমি না চাহিলেও দুলিতেছে। কারণ তিনি না দুলিলে (শ্বাস প্রশ্বাস না চলিলেই মৃত) আমি বলিবার কেহ থাকিবে না। আর সেই শ্বাস-প্রশ্বাস না দোলালেও আপনি দোলে।

এই দোদুল্যমান শ্বাস ও প্রশ্বাস স্থির করিতে হইবে, তাহা জানাইবার জন্যই মহান ঋষিগণ এই দোল উৎসবের আয়োজন করিয়াছিলেন। এই দেহরূপ দোলনার ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুই নাড়িতে বাহিত শ্বাস-প্রশ্বাসের চঞ্চলতার কারণে মন স্থির হয় না।

যখন প্রাণ বায়ু এই দুই নাড়ি হইতে সুষুম্নায় প্রবেশ করে তখন চিত্ত স্থির হয় ও সাধক বহুবিধ জ্যোতি দর্শন করে। সেই ভিন্ন ভিন্ন রঙের জ্যোতির প্রতীকস্বরূপ এই রঙ নিবেদন।

এই প্রসঙ্গে যোগীবর শ্রী শ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয়ের রচিত যোগ সংগীতে তিনি লিখেছেন-

হৃদি বৃন্দাবনে মৃদুমন্দ সমীরে।
শ্রীমতীসহ শ্রীপতি দুলিছে আনন্দভরে।।

নবীন-নীরদ-কোলে, যেন স্থির বিজলী দোলে,
আপনাকে আপনি ভোলে, বারেক হেরিলে পরে।।

সৎপ্রবৃত্তি সখীগণে, কুঙ্কুম আবীর দানে,
তুষিছে রাধা-রমনে ভাসিছে প্রেম-সাগরে।।

করিছে পরম রঙ্গ, উঠিছে কত তরঙ্গ,
যে করেছে সাধুসঙ্গ, সেই সে বুঝিতে পারে।।

আপনি হয়ে গোপবালা, আপনা আপনি করে খেলা,
কে বুঝিবে এ গুপ্ত লীলা, প্রত্যক্ষ না হলে পরে।।

সদগুরু করুনা হলে দেখবে রাধাশ্যাম-যুগলে।
ভাসি আনন্দ – হিল্লোলে, যাবে পঞ্চ-তত্ত্ব পারে।।

তখন সাধক স্বয়ং গোপি (গোপনে সাধন করে বলে গোপি পদবাচ্য) হয়ে আপন দেহস্থ ভূমি, বহ্নি, জল, বায়ু, শূন্য, মন, বুদ্ধি, অহংকার এই অষ্ট প্রকৃতি বা সখীর সাথে হৃদয় মন্দিরে পীত জ্যোতি সম শ্যামসুন্দরে সাক্ষাৎ পায়।

এই রূপ জ্যোতি দর্শনের ফলে সাধকের হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্জ্বোলিত হয়। সেই জ্ঞান রূপ অগ্নিতে মেঢ্রাসুর (অর্থাৎ মেঢ্রা = মেষ বা কামরূপ স্পর্ধা) পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তখন সাধক আপন হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত দোল লীলা সাক্ষাৎ করে ধন্য ধন্য হয়ে যায়।

এই প্রসঙ্গে যোগীবর শ্রী শ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয় অনত্র এক স্থানে লিখেছেন-

দেহ কুঞ্জ বন, প্রমোদ কানন
যুগল মিলন, হৃদি মাঝে,
পীত জ্যোতি মাঝে, শ্যাম ঘন রাজে
কেমন সাজে আজ সাজে।।

দেখ সে মূরতি, জ্যোতি সে প্রকৃতি
পুরুষ শ্রীপতি, কিবা শোভে,
ভূমি বহ্নি জল, বায়ু নভস্থল
মন বুদ্ধিবল, অহং আদি।।

এরা অষ্ট সখী, সে রূপ নিরখি
নিরখি নিরখি আছে ভুলে,
চরনে চরন, প্রাণেতে অপান
প্রনব বাজন, বাঁশী বাজে।।

গুরুমুখে জান, যুগল মিলন,
হৃদি বৃন্দাবন, মিলবে তবে।।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………..
আরো পড়ুন:
সব তীর্থ বার বার গঙ্গা সাগর একবার
দোল উৎসব

আম্মার সঙ্গলাভ
ক্রিয়াযোগ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি

জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা ও নবকলেবর রহস্য

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!