ভবঘুরেকথা
মা সারদা শ্রীমা

বহুরূপিণী বিশ্বজননী সারদামণি

মায়ের মূর্তি আমাদের হৃদয় আপ্লুত করে, মায়ের মধুর উপদেশে অমৃত বর্ষিত হয়, সেই মা-ই হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের পরমশক্তি বহুরূপিণী বিশ্বজননী সারদামণি। মা একদিকে যেমন অসুরদলনী, অন্যদিকে ত্রাণকারিণী।

হরিশের কুবুদ্ধি দমনের জন্য বগলামূর্তি, আবার তেলোভেলোর মাঠে ডাকাত দম্পতির কাছে কালীরূপ ধারণ করেন। বহুরূপিণী মা সারদা তাঁর নিত্যশুদ্ধ আত্মা ভক্তদের কাছে আরাধ্য দেবীমূর্তিরূপে দেখা দিয়েছে।

আমরা যে সকল দেবীকে পূজা করি, মায়ের চরিত্রে সেইসব দেবীর প্রকাশ ঘটতে ভক্তেরা দেখেছেন। তাহলে শুরু করা যাক বহুরূপিণী মায়ের মহিমার কথা-

তাঁর এই রূপের উল্লেখ করে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাগনে হৃদয়কে বলছেন, ‘ওরে ওর নাম সারদা ও সরস্বতী। জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অমঙ্গল হয় তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে।’

শ্রীমা সারদামণিকে কালীরূপে দর্শন করেছেন অনেক ভক্ত। মা-ও ‘কালী’ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তেলোভেলোর মাঠে ডাকাত দম্পতি মাকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো সাধারণ মানুষ নও। আমরা তোমাকে কালীরূপে দেখছি।’

মা উত্তর দিলেন, ‘কী জানি! আমি তো কিছু জানি না।’

ঠাকুর একবার বলেছিলেন, সেই যে নহবতে আছে আর মন্দিরে ভবতারিণী-একই।’

মা কালী কি না জানতে চাইলে মা বলেন, ‘লোকে বলে কালী।’

প্রশ্ন: ‘কালী তো? ঠিক?’

ভক্ত বলেন, ‘বলো! তুমি আমার সকল ভার নিয়েছ। আর সাক্ষাৎ মা কালী কিনা?’

মা মাথায় হাত দিয়ে গম্ভীরভাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, তাই।’

একবার মা বিষ্ণুপুর স্টেশনে গাড়ির অপেক্ষায় বসে আছেন, এমন সময় এক পশ্চিমা কুলি তাঁকে দেখে ছুটে এল, বলল, ‘তু মেরে জানকী। তুঝে ম্যায়নে কিতনা দিনো সে খোঁজা থা। ইতনে রোজ তু কঁহা থি?’-এই বলে সে কাঁদতে লাগল।

মা তাকে শান্ত করে ফুল আনতে বললেন। সে ফুল এনে মায়ের চরণে অর্পণ করল। মা সেই পশ্চিমা কুলিকে তখনই মন্ত্রদীক্ষা দিলেন।

স্বামী-বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে শ্রীমা সারদা ছিলেন জ্যান্ত দুর্গা। ভক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ সেই জ্যান্ত দুর্গার পূজা করে ধন্য, কৃতকৃতার্থ হয়েছিলেন।

গিরিশচন্দ্রের জেদ, মা স্বয়ং না এলে পূজা করা নিরর্থক। গিরিশের বাড়িতে পূজা। খিড়কির দরজায় গভীররাতে করাঘাত। ‘আমি এসেছি।’

পূজামণ্ডপে সত্যি সত্যিই মা অবতীর্ণা হয়েছেন।
ভক্তগণ মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন।

শ্রীমা সারদামণির আরও পরিচয় হল তিনি করুণাময়ী, কৃপাময়ী ও ভক্তবৎসলা। মা জানতেন, ভগবানলাভের জন্য যে সবকিছু ত্যাগ করে, সে ধন্য। কিন্তু আবার কোনও সংসারী সন্ন্যাস নিতে চাইলে মা বলতেন, ‘দেখ দিকিনি, কী অন্যায়।

সে বেচারী এই কাচ্চাবাচ্চাদের নিয়ে যায় কোথায়? তিনি সন্ন্যাসী হবেন! কেন সংসার করেছিলেন? যদি সংসার ত্যাগই করতে চাও, আগে এদের খাওয়া থাকার সুব্যবস্থা করো।’

একজনের বাবা মারা গিয়েছে। ছেলে সন্ন্যাস নিতে চায়। মা আগে ভালো করে জেনে নিলেন, ছেলেটি না থাকলে বাড়িতে কোনও অসুবিধা হবে কি না। তাদের চলবে তো? জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে মা মন্ত্রদীক্ষা দিলেন।

সদ্য প্রসূতি একটি মেয়ে মাঠে কাজ করছে। তাই দেখে মা কাতর হয়ে পড়েন। অভিমানে মা মনে মনে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন তুমি এসব দেখতে পাচ্ছ না? মানুষের এত দুঃখ দুর্দশা? একটা কোনও বিহিত করো।

মা বলতেন, পৃথিবীর মতো সহ্যশক্তি চাই। অর্থাৎ যদি শান্তি চাও, তো শান্ত থাকো। মা যে কত রূপে বিরাজিতা। তিনি নিজেই ছিলেন পৃথিবী-কন্যা সীতার মতো আশ্চর্য সহনশীলা।

একবার একজন মহিলাকে ঠাকুর মায়ের কাছে পাঠালেন। বলে দিলেন, নহবতে যিনি আছেন তিনিই তোমার দুঃখ কষ্ট দূর করবেন। যাও তাঁকে গিয়ে সব খুলে বলো।

মা তাকে বলে দিলেন, তুমি মা, ওঁর কাছেই যাবে। উনিও জানবেন। ঠাকুর আবার পাঠালেন তাঁকে- না, না, তুমি গিয়ে ভালো করে তাঁকে বলো। এইভাবে বার তিনেক ঘোরানো হল। শেষে মা তাঁর কৃপাশক্তি প্রকাশ করলেন।

মহিলার হাতে একটি বেলপাতা দিয়ে বললেন, ‘এইটে নিয়ে যাও। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।’ সেটাই হয়েছিল।

মায়ের সেবা ছিল অতুলনীয়। ভক্তজননী খুব সকালবেলা গোয়ালার বাড়িতে দুধ আনতে গিয়েছেন। বাতের ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে বলেন, কলকাতা থেকে আমার সন্তান ক’জন এসেছে। তাদের সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস। তাই দুধ নিতে এসেছি।

অসুস্থ শরীরে নিজের হাতে তাদের বিছানার চাদর কাচছেন। এ কী করছেন? ময়লা বিছানাতে ছেলেরা শোবে কী করে? কষ্টকে কষ্ট বলে মানছেন না।

আর একটা ঘটনার কথা বলা যাক। জয়রামবাটীতে জগদ্ধাত্রী পূজার পরে ভক্ত ত্যাগী সন্তান যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই ম্যালেরিয়াতে শয্যাগত হলেন। মায়ের তখন চিন্তা-উদ্বেগের শেষ নেই, শুধু বলেন, মা গো কী হবে? ছেলেরা সবাই পড়ে পড়ে ভুগছে।

এইভাবে নানারূপে মায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন দেবীর মহিমায়। ঠাকুর বলেছেন, মাতৃভাব সবচেয়ে শুদ্ধভাব। মাতৃভাব সব সাধনার শেষ কথা। মাতৃরূপে আমাদের মা-কে ষোড়শী পূজার মাধ্যমে জগৎকল্যাণের জন্য পরমশক্তির উদ্বোধন করেছিলেন প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।

মা সব কাজ করছেন, আর একটু অবসর পেলেই দরজায় দাঁড়িয়ে রোগীদের দেখে যাচ্ছেন। গ্রামে দুধ দুষ্প্রাপ্য। মা তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে এক পোয়া আধ পোয়া যা পান দুধ আনেন।

পথ্যের ব্যবস্থা করেন। অন্ন-পথ্যের পরে মায়ের পরিশ্রম যাতে আর না বাড়ে তাই সবাই জোর করে চলে যাচ্ছেন। মা বলছেন, আর ক’দিন থাকো। শরীরে একটু বল পাও। তাঁরা চলে যাচ্ছেন। মা খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে আছেন। চোখে তাঁর জল…

মা ছিলেন সামাজিক বিধিনিষেধের ওপরে। তাঁকে গণ্ডিভাঙা মা বলে ভক্তেরা অভিহিত করেছেন। আমরা জানি তিনি মুসলমান আমজাদের এঁটো পরিষ্কার করছেন আর বলছেন, ‘আমার শরৎ (সারদানন্দজি) যেমন ছেলে, আমজাদও তেমন ছেলে।’ শ্রীরামকৃষ্ণের মতো তাঁর প্রেম ও কৃপাও আচণ্ডালকে ধন্য করে প্রবাহিত হতো।

মা সকলের ইহকাল ও পরকালের আশ্রয়। কেই বা তাঁর করুণায় বঞ্চিত? মুচি, মেথর, ডোম, বাগদি, চণ্ডাল, মুসলমান, আতুর সকলেই মায়ের কাছে অবাধ আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছে।

মায়ের বহুভুজা রূপ একদিন জয়রামবাটীতে মা অন্যমনস্কভাবে কাজ করতে করতে বললেন, ‘আমি আর অনন্ত হাতে কাজ করেও শেষ করতে পারছি না।’ বলেই বললেন, ‘দেখ তো, আমার আবার অনন্ত হাত, এ কী বলছি।’

এইভাবে নানারূপে মায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন দেবীর মহিমায়। ঠাকুর বলেছেন, মাতৃভাব সবচেয়ে শুদ্ধভাব। মাতৃভাব সব সাধনার শেষ কথা। মাতৃরূপে আমাদের মা-কে ষোড়শী পূজার মাধ্যমে জগৎকল্যাণের জন্য পরমশক্তির উদ্বোধন করেছিলেন প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

ভারতের ইতিহাসে আদর্শ নারীর অভাব নেই। কিন্তু মাতৃভাবের পূর্ণ বিকাশ আমরা এঁদের মধ্যে খুব একটা দেখতে পাই না। তিনি নিবেদিতাকে গ্রহণ করেছিলেন সাদরে।

শরৎ ও আমজাদের মধ্যে ফারাক রাখেননি কোনও দিন। সর্বজনীন মাতৃত্বের আদর্শ তিনিই। তাই তো স্বামীজি বলেছিলেন, ভারতে ‘জননী’ই আদর্শ নারী। মাতৃভাবই প্রথম ও শেষ কথা।

……………………..
অসীমকুমার দেব লিখছেন বর্তমান পত্রিকাতে।
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরো পড়ুন:
মা সারদা দেবী
প্রজ্ঞাপারমিতা শ্রীশ্রীমা সারদা
বহুরূপিনী বিশ্বজননী সারদামণি
মা মনোমোহিনী
শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সপ্তসাধিকা
মাতৃময়ী তিনরূপ
মা আনন্দময়ী
আনন্দময়ী মায়ের কথা
ভারত উপাসিকা নিবেদিতা
রাসমণি
নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে
পূণ্যশীলা মাতা কাশীমণি দেবীর সাক্ষাৎকার
আনন্দময়ী মা
মা মারিয়াম :: পর্ব-১
মা মারিয়াম :: পর্ব-২
মা মারিয়াম :: পর্ব-৩
মা মারিয়াম :: পর্ব-৪
মীরার কথা
অলৌকিক চরিত্র মাদার তেরেসা
মা আনন্দময়ীর কথা
বৈষ্ণব সাধিকা যশোদা মাঈ
আম্মার সঙ্গলাভ
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!