ভবঘুরেকথা
হযরত শাহজালাল

হযরত শাহ্জালাল

জন্ম: তুরস্ক- ৬৭১ হিজরি ১২৭১ খ্রিস্টাব্দ
ওফাত: বাংলা- ৭৪০ হিজরি ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দ

ভারত উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সুফি দরবেশ বাবা শাহ্ জালাল(রা)। তার পুরো নাম শায়খ শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ধারণা করা হয়, তিনি ৭০৩ হিজরিতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে আগমন করেন। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও তার রওজায় প্রাপ্ত ফলকলিপিতে উল্লেখিত সময়কালকেই সঠিক বলে ধরা নেয়া হয়।

পার্সি ভাষায় লিখিত এই ফলকলিপিটি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। শাহজালালের ৩৬০জন আউলিয়া সাথে নিয়ে সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই সমাহিত করা হয়।

 

শাহজালালাল বাবার প্রাথমিক জীবন:

হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকে মক্কার কুরায়েশি বংশের একটি শাখা হেজাজ ভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। ঐ শাখার মোহাম্মদ বা মাহমুদ ছিলেন শাহজালালের পিতা। মাহমুদের পিতার নাম ছিল ইব্রাহিম।

হযরত শাহজালালের রওজায় প্রাপ্ত ফলকলিপি সুহেলি ইয়ামেনি অনুসারে, শাহজালাল ৩২ বছর বয়সে ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট আগমন করেন। ফলক থেকে জানা যায়, ৬৭১ হিজরি (১২৭১ খ্রিস্টাব্দে) প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন ইয়ামেনের কুনিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শাহজালাল তিনমাস বয়সে মাতা এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। এরপর তার মামা আহমদ কবির তাঁকে পালক নেন।

আহমদ কবির কোরআন-হাদিস ও ইসলামের প্রাথমিক বিষয়ে শিক্ষা প্রদানে গুরুত্ব দেন। পরবর্তিতে আহমদ কবীর শাহজালালকে ইয়েমেন থেকে মক্কায় তার আস্তানা (হোজরা) নিয়ে যান। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে শাহজালালকেও উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করেন। 

 

শাহজালালাল বাবার গুরু পরিচিতি:

শাহজালালের মামা ও শিক্ষাগুরু সৈয়দ শায়েখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি। তার পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী। জানা যায়, সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী শাহজালালের জন্মের আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মোলতানের নিকটে আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখই ছিলেন আহমদ কবিরের মুর্শিদ।

 

শাহজালালাল বাবার ঊর্ধঃস্তন পীরদের তালিকা-

  • হযরত মোহাম্মদ (স)।
  • হযরত আলী (রা)।
  • শেখ হাসান বসরী।
  • শেখ হবিব আজমী।
  • শেখ মারুফ কর্খী।
  • শেখ সিংরি সুকতি।
  • শেখ মমশাদ সিকন্দরী।
  • শেখ আহমদ দিন্নুরী।
  • শেখ আমুবিয়া।
  • শেখ আজি উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী।
  • শেখ আবু নজিব জিয়াউদ্দিন।
  • শেখ হিসাব উদ্দীন।
  • শেখ মাখদুম।
  • শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া।
  • সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী।
  • সৈয়দ শায়েখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি।
  • হযরত শাহজালাল ইয়ামেনি।

 

শাহজালালাল বাবার আধ্যাত্মিকতা:

সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই মামা আহমদ কবির শাহজালালকে মক্কায় নিয়ে আসেন। সেসময় মক্কায় সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আহমদ কবির। আহমদ কবির শাহজালালকে ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয়ধারায় শিক্ষাদানে দীক্ষিত করেন।

 

শাহজালালাল বাবার দরবেশী জীবন:

শাহজালালের জন্ম দরবেশ পরিবারে। জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ। ইয়ামেনে ধর্মযুদ্ধে তিনি নিহত হন এবং মাতার দিক দিয়ে সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। তদুপরি তার শিক্ষাগুরু দরবেশ আহমদ কবির তাঁর মামা, তিনিও একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে উল্লেখ আছে। আহমদ কবির শাহজালালের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করার পর থেকেই তাঁকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।

 

শাহজালালাল বাবার সিলেট আগমন পর্ব:

ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারের স্বপ্ন দেখার পর শাহজালাল মামার কাছে সবকথা ব্যক্ত করেন। তিনি তখন তার মামা ও গুরুর আস্তানায় থাকতেন। মামা তাকে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে শাহজালালের হাতে একমুঠো মাটি তুলে দিয়ে বলেন, যে স্থানে এই মাটির ‘স্বাদ’ ‘গন্ধ’ ও ‘বর্ণের’ মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। গুরু আহমদ কবিরের দোয়া নিয়ে শাহজালাল ধর্মপ্রচার অভিযানে আরবের মক্কা থেকে প্রথমে একাই যাত্রা শুরু করেন।

 

শাহজালালাল বাবার হিন্দুস্থানে প্রবেশ:

শাহজালাল মক্কা হতে বিদায়কালে যে কয়েকজন সঙ্গী তাঁর সাথে যাত্রা করেন তার মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন চাশনী পীর ছিলেন মৃত্তিকার তহবিলদার। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরবান্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজামউদ্দীন, ইরান থেকে জাকারিয়া, শাহ দাউদ ও সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হন।

তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করেন। এরপর সুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিমউদ্দীন প্রমুখ তার মুরীদ হয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলেন। এভাবে দিল্লী পর্যন্ত এসে পৌঁছালেন তখন শিষ্যদের সংখ্যা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।

 

শাহজালালাল বাবার নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সাথে সাক্ষাৎ:

দিল্লিতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে শাহজালালের কুত্সা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিজাম্মুদ্দীন অন্যের কুত্সা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে শাহজালালের কাছে সালাম পাঠান। শাহজালাল সালামের উত্তরে উপঢৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠান।

নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহজালালের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালী কবুতর নামে খ্যাত।

 

শাহজালালাল বাবার শেখ বোরহান উদ্দীনের দেখা ও দুঃখ প্রকাশ:

শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে সিলেটে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তত্কালে মুসলমানরা বসতি গড়েছিল। সে সময় সিলেটের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহানউদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান ছেলের জন্মোত্সব উপলক্ষে গরু জবাই করে রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন।

এ কারণে, গোবিন্দ বুরহানউদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বুরহানউদ্দীন বাংলার তত্কালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের কাছে গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে বিশাল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখন রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টা বিফল করে দেয়।

গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর কাছে পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তাঁর রাজদরবারী আমেল-উলামাসহ জ্যোতিষিদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এক ব্যক্তি আছে, তাঁর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদুবিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট জয় সম্ভব হবে।

জ্যোতিষরা সেই আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে আরো বলেছিল, আগামী দুই/এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘরবাড়ির বিষম ক্ষতি হবে, কোথাও কোন প্রদীপ থাকবে না; একটি মাত্র তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে দেখেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরান পড়ছেন।

সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর বিষয়ে অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাঁকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যমে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় শাহজালালও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ঐতিহাসিক আজহার উদ্দীন ধরণা করে, দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহজালালের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তাঁর নিকট বর্ণনা করেন ।

-হযরত সিপাহশালার নাসির উদ্দীনের দেখা-

 

ত্রিবেণী হুগলী নদী

শাহজালাল দিল্লী থেকে বুরহানউদ্দীন সহ ২৪০জন সফরসঙ্গী নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। নাসির উদ্দীন শাহজালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহজালালের শিষ্য বর্ধিত হতেই লাগল।

ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসামউদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহজালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

 

-সিকান্দর গাজীর দেখা ও ব্রহ্মপুত্র পার-

 

ব্রহ্মপুত্রের দৃশ্য

শাহজালাল সোনারগাঁ আসামাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সিকান্দর গাজী শাহজালালকে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। শাহজালাল তাঁর সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহজালালের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সিলেট অভিমুখে যাত্রা করেন।

এভাবে শাহজালালের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। অন্যদিকে গৌড়গৌবিন্দ শাহজালালের আগমন সংবাদ পেয়ে; নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। ভক্তরা আজো বিশ্বাস করেন, শাহজালাল সে সময় তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাঁধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।

 

সিলেটে প্রবেশ:

খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্টভূমি লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সেই রাজ্যগুলোর মধ্যে গৌড় ছিল অন্যতম। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমারেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহজালাল তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন।

এখানে গৌড়ের সীমান্তরক্ষীরা অগ্নিবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়; কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। শাহজালাল পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন। উল্লিখিত তথ্য-সম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছে-

চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন ।

এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।

যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার ।

সর্বপ্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড়গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফলে হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার জন্য যাদুমন্ত্রসহ এক প্রকাণ্ড লৌহধনুক শাহজালালের কাছে প্রেরণ করে; যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা সেই ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তাহলে গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে।

শাহজালাল তাঁর দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ খাজা বাদ পড়া বাদ দেয়নি একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক ‘জ্যা’ করতে। অত:পর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন।

 

সুরমা নদী পারাপার:

উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়েছে। একসময় নদীদুটিই প্রবলস্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালে সাগরের মত দেখাত। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহজালাল ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন, এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী।

শাহজালাল আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছুসময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহজালাল নদী পার হন।

শাহজালাল বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে অনায়াসে গেলেন চলে নদীর ওপারে। গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্তগিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি। শাহজালাল তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল নিলেন।

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!