ভবঘুরেকথা

-মোতওয়াল্লী চিলু ভূঁইয়া জালালী

: জালালী দর্শন বা উপাসনা :

জালালী দর্শনে মৃত্যু ও পরকাল বলতে রূপান্তর বুঝায়। বিশ্লেষণ করিলে যাহা পাওয়া যায়, তাহা হইল প্রতিটি মানুষই মহাজাগতিক নিয়মের রাজ্যে একরূপ হইতে অন্য রূপে রূপান্তরিত হইতেছে। যাহা খণ্ড থেকে খণ্ডিত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রূপ নিয়ে আসিতেছে। ইহাই পরকাল। পরকালের নির্ধারিত বিচার স্ব-স্ব কৃতকর্মের উপর নির্ভরশীল।

জালালী বা সূক্ষ্ম জ্ঞানীদের মতে, ‘মানুষের মৃত্যু আর কিছুনা। কামনার দেহ ছাড়িয়া নিষ্কাম দেহে প্রবেশ করা। ব্রহ্মাণ্ড মোট চারটি- একটি বায়ুময় ব্রহ্মাণ্ড, দ্বিতীয়টি শব্দময় ব্রহ্মাণ্ড, তৃতীয়টি স্বভাবময় ব্রহ্মাণ্ড আর চতুর্থটি জ্ঞানময় ব্রহ্মাণ্ড।’

১. বায়ুময় ব্রহ্মাণ্ড:
আমরা বায়ু সমুদ্রের কীট। বায়ুতেই উৎপত্তি, স্থিতি ও বিকাশ। এই বায়ুর বাহিরে কিছুই নাই। স্বর্গ, নরক বা পাতাল, শিবলোক, বিষ্ণুলোক, ব্রহ্মলোক যাহা কিছু আছে সবই এই বায়ুতে বিদ্যমান। ধর্মগুলো বিভিন্ন মতে বলে। যে প্রকারেরই থাকুক এই বায়ুময় ব্রহ্মাণ্ডেই আছে।

আর বায়ুর উপরে ভাসে শব্দ

২. শব্দময় ব্রহ্মাণ্ড:
জালালী মতে, মৃত্যুর পরে মানুষ কামনার দেহ ছাড়িয়া নিষ্কাম দেহে প্রবেশ করে। এক কোটির মধ্যে নিরানব্বই লাখ মানুষই মৃত্যুর পরে একটি শব্দময় নিষ্কাম শরীর নিয়ে চলিয়া যায়। যদিও এই ইন্দ্রিয় চোখে ইহা দেখা যায় না; ইহা সত্য।

শব্দেরও শরীর আছে, যখন কেহ কথা বলে তৎক্ষণাৎ একটি শরীর হইয়া কর্ণে প্রবেশ করে। মৃত্যুর পরে এই শরীরে কোন চেতনা থাকে না। ইহা শব্দের মতই একটি মৃত সত্তা। ইহার আর কোন বিকাশ নাই। বিচার নাই। মুক্তিও নাই। ইহা অন্যান্য শক্তির মতই বায়ুতে থাকে। ইহার নরক বা নিম্নগতি লাভ ঘটে।

জীবিতকালে ইহা আত্মজ্ঞানের অনুসরণ করে নাই। কেবল ভোগ-বিলাস, সুখ-দু:খ জনিত কর্ম করিয়াছে; নিজ আত্মাকে চিনবার বা বিকাশের জন্য কোন কর্মই করে নাই। মানুষের মধ্যে আল্লাহ বা মহাশক্তি বিলীন ইহা বিশ্বাস করে নাই। কেবল বিভিন্ন মানুষের তৈয়ারি উপাসনালয়গুলোতে উপাসনা করিয়াছে।

সত্যিকার আত্মজয়ী মানুষদের নিন্দা ও অবহেলা করিয়াছে। তাহাদের উপদেশ শুনে নাই। ইহারা মৃত্যকালে আত্মজয়ী অতীন্দ্রিয় সত্তাধারী মহাশক্তিধর কাহারও সাহায্য পাবে না। একটি আত্মাকে আরেকটি আত্মজয়ী আত্মাই কেবল নিজ শক্তি দ্বারা উদ্ধার করিতে পারে।

ইহাদের সাহায্যকারী বন্ধু নাই। কারণ ইহারা আত্মাকে কিভাবে জীবিত রাখা যায় সেই কর্ম করে নাই। ইহাদের কোন নরকও নাই, স্বর্গও নাই। জীবাদীর মত নিজেকে কেবল দেহমাত্র ভাবে। ইহারা ষড়রিপুর তাড়নায় নিজ প্রভুকে দ্বৈত বা দূরে ভাবে।

নিজ পবিত্র গুণাগুন হারাইয়া পশুত্ব স্বভাবে পরিণত হয়। নিজেকে আর প্রভুর সাথে বিলীন করিতে পারে না। যাহারা প্রভুতে বিলীন হইয়াছে, তাঁহাদের সাহায্যও না চাহিয়া কেবল নিন্দা করিয়া বেড়ায়। শব্দের উপরে ভাসে স্বভাব।

৩. স্বভাবময় ব্রহ্মাণ্ড
শব্দের উপরে ভাসে স্বভাব। মৃত্যুর পরে এক কোটির মধ্যে এক লাখ লোক এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থান করে। ইহারা ভক্ত! ইহারা অদ্বৈতবাদী, ঈশ্বরকে বা আল্লাহকে দূরে ভাবে না। নিজের যে আত্মা আছে সেখানেই মহাশক্তি বিলীন আছে ইহাতে বিশ্বাস রাখে।

সকল জীবিত সত্তাতেই অর্থাৎ গাছ-বৃক্ষ তরুলতা, পশু-পাখি, কিট-পতঙ্গের মাঝে মহাশক্তি বিলীন ইহা বিশ্বাস করে। ইহারা জ্ঞানময় ব্রহ্মাণ্ডের বসবাসকারী দুই জগতের বাদশাদের ভক্তি ও বিশ্বাস করে এবং তাঁহাদের নির্দেশ মত নিজেকে জানার জন্য জালালী বা সূক্ষ্ম জ্ঞানের উপাসনা করে।

শয়তানকে নিজ হইতে আলাদা মনে করে না। নিজ নিজ স্বভাবের কারণই মানুষ শয়তান বা ফেরেস্তা হয়। ভক্ত বা শিষ্যকে ফেরেস্তা বলা হয়। প্রকৃত ভক্তরা বা ফেরেস্তারা কাহারও কোন ক্ষতি করে না। সব সময় তার উপাস্য বা গুরুর উপাসনায় থাকে। ইহারা ষড়রিপু দমন করে।

মাশুককে চিনবার বা পাইবার জন্য স্বর্গ, মুক্তি, মৃত্যু ভয় ইত্যাদি সকল কামনা বাসনা ত্যাগ করত নিষ্কামভাবে প্রভুকে চায়। ইহারা মজনু বা প্রেমিক।

গুরু বা অতিমানবদের সাহায্যে মৃত্যুকালে ইহারা নিষ্কাম স্বভাবময় দেহ লইয়া অকপটময় জায়গায় বসবাস করে ও মৃত্যুকালে গুরু বা উপাস্য প্রভু এসে ভক্তের আত্মায় সূক্ষভাবে, অনেকটা স্বপ্নময় জগৎ সদৃশ কিন্তু অবচেতন নয়, চেতন অবস্থায় ভক্তের সূক্ষ্ম স্বভাবময় শরীর সহ সাথে নিয়ে যায়।

ভক্তরা অমর, ইহাদের ধ্বংস নাই। ভক্তরা সকলকে দেখে কিন্তু কাহারও সামনে নিজ রূপ প্রকাশ হইতে সমর্থ নাই। স্বভাবের উপরে ভাসে জ্ঞান।

৪. জ্ঞানময় ব্রহ্মাণ্ড
জগৎ দুই রূপে আছে। সূক্ষ্ম ও স্থূল। তদ্রূপ মনুষের মাঝেও সূক্ষ্ম ও স্থূল জগৎ বিদ্যমান। মানবের দেহে বিশ্বের থেকে বেশি শক্তি বর্তমান। ইহা কি জানো না যে, মৃত্যুর পরেও ইহারা ভক্তদের দেখা দেয়? ইহাদের আদেশে মৃতের দেহে জীবন শক্তি সঞ্চালন করেন!

পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের মানব-মানবী এখনও ভক্তের ডাকে সাড়া দেয়; তাঁহাদের আদেশে পবন সঞ্চারে, মেঘ- বৃষ্টি হয়। ইহা কি মিথ্যা? না! না! না! এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। তিনিই বিশ্বের বিস্ময়। জগৎ মাতা বা জগৎ পিতা। ভক্তের খেয়া পারের কর্তা। সেই কারণেই ইহাকে বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড বলে।

এই বিশ্বকে ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বলে। জ্ঞানময় ব্রহ্মাণ্ড আর কিছু নয়, আমাদের যে জ্ঞানময় সত্তা আছে ইহাকে বুঝায়। ইহা চোখে দেখা যায় না। জালালী বা সূক্ষ্ম জ্ঞান অনুশীলনের দ্বারা ইহার স্বরূপ ফুটিয়া উঠে। জ্ঞান মন্থনে সে জ্ঞানময় ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি হয়।

সে তখন এক অচিন দেশে চলিয়া যায়, জ্যোতির্ময়ও জ্ঞানময় শরীরধারী বাদশা বা বিচারক। দুই জাহান পরিচালক। ইহারা অতিমানব। যদি কেহ তাঁদের কাছে কিছু অন্তর থেকে চায়, যদি উনারা খুশি হয়, দয়া করতে পারেন। এইরূপ অতিমানব এক কোটির মধ্যে পাঁচজন মাত্র।

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!

……………………………….
-জালালী উপাসনা বা দর্শন

………………………………….……………..
জালালী দর্শন সম্পর্কে জানতে আরো পড়ুন-
মৃত্যু ও পরকাল

সৃষ্টিতত্ত্ব
পুনর্জন্ম
স্বর্গ
নরক
দ্বৈত-অদ্বৈত-বিশিষ্ট অদ্বৈত
আত্মজ্ঞান সাধনায় চারটি ধাপ বা স্তর
স্থূল
স্থূল-২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!