ভবঘুরেকথা
জ্ঞানগঞ্জ ধর্ম বেদ প্রার্থনা

ভৌমলীলা যেমন আছে, সেইরূপ অপ্রাকৃত লীলাও আছে; ইহা শ্রমসাধ্য নিঃসন্দেহ। ‘অপ্রাকৃত’ ভূমি-দিব্যভূমি; সেখানে জড়া, ব্যাধি ও মৃত্যু নাই। উহা চিন্ময়ভূমি কোনক্রমে ঐ ভূমিতে স্থানলাভ বা দর্শন করিতে হইলে তপস্যা ও যোগের মাধ্যম ব্যতীত সম্ভব নয়।

যাঁহারা তথায় বাস করেন তাঁহারা সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস, শ্রীশ্রী রামঠাকুর, শ্রীশ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী, শ্রীশ্রী রামদাস কাঠিয়াবাবা, শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী ও শ্রীশ্রীত্রৈলঙ্গ স্বামী ও অন্যান্য বহু মহাপুরুষের জীবন বহুভাবে তথায় অপ্রাকৃত আত্মার সঙ্গে-যোগযুক্ত আছেন। প্রাকৃত ভূমি যেমন আছে তেমনি অপ্রাকৃত ভূমিও আছে।

পরম গুরুদেব শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের মুখে ওমা ভৈরবী, ত্রিপূরা ভৈরবী প্রভৃতি মাতাগণের নাম উল্লেখ আছে, এ এছাড়াও ক্ষেপা ভৈরবী নামে এক মাতার বয়স বর্তমানে প্রায় ১২০০ বৎসর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। পরমহংসদেবগণ ও ভৈরবী মাতাগণ নানা স্থানে এবং জ্ঞানগঞ্জেই অধিক সময় বাস করেন; নির্দেশানুসারে তাঁহারা মনোহর তীর্থেও গমন করেন।

জ্ঞানগঞ্জ বা জ্ঞানপীঠ নামক স্থান বলিতে অষ্টপাশ বা সকল প্রকার পাশমুক্ত স্থানকেই বুঝিয়া থাকি; হিমালয়ের বিভিন্ন অংশ দক্ষিণ ভারতের কিছু কিছু পর্বতের উপর সমুদ্রতীরবর্তী-অঞ্চলে পূর্ব-ভারতের আসামের কামাখ্যা ও জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে তিব্বতের বিভিন্ন অংশে পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে নৈনিতাল ও নেপালের মধ্যবর্তী পূর্ণগিরি অঞ্চলে-

সাধক, যোগীদের বাসভূমি, ইহা ছাড়াও বিন্ধ্যাচল, গির্ণার, ভৈরবঘাট, শ্রীশৈলম প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে জ্ঞানগঞ্জ বা জ্ঞানপীঠের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে যেমন আছে- তেমনই সমস্ত তীর্থাদির সঙ্গে পরস্পরা রূপে এবং সাধনক্ষেত্রে বা তপভূমির সঙ্গে এই জ্ঞানগঞ্জ বা জ্ঞানপীঠের যোগ অবিচ্ছেদ্য।

এই সকল স্থান সাধু, সন্ত, সন্ন্যাসী, যোগী, পরমহংসগণ, কুমারী ও ভৈরবী মাতাদের আবির্ভাব সহজেই হইয়া থাকে উপরন্তু বুভুক্ষুগণ এই সকল স্থানের মাহত্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পরিতৃপ্ত হয়।

গোপীনাথ কবিরাজের বহুগ্রন্থে জ্ঞানগঞ্জের প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ আছে- তা’ছাড়াও পরমগুরু শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের অধিকাংশ লীলাতে এবং ব্যবহারিক জীবনেও জ্ঞানগঞ্জের সমস্ত নির্দেশনার কথা লিখিত আছে। এই স্থানগুলোতে নানাশ্রেণীর সাধুসন্ত, বিভিন্ন প্রকার শক্তির অধিকারী হইলেও সকলেই পুজ্য ও মহাশ্বৈর্যপূর্ণ। পুরুষদেহে ও নারীদেহে যাঁহারা বাস করেন তাঁহাদিগকে পরমহংস বা ভৈরবী মাতা নামে পরিচিত।

এই ভূমি সকল অপ্রাকৃত অথচ প্রাকৃতভূমির সঙ্গেই সর্বদা সম্বন্ধ যুক্ত। জ্ঞানগঞ্জের নির্দেশ অনুসারেই সবকিছুর গবেষণার ও সব কার্য প্রতিমুহূর্তে পরিচালিত হইতেছে এখানে এই সকল পরম যোগিগণের এবং পরম যোগিণীদের আজ্ঞা বহনকারীরা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া আছেন।

তাঁহাদের আজ্ঞা-অনুসারেই যোগী শিক্ষা ও বিশেষ জ্ঞান লাভ করিবার অধিকার জন্মে। কোন কোন বিশেষ ভূমিতে তাঁহাদের আজ্ঞা ব্যতিরেকে ঐ সকল স্থানে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। একমাত্র সাধু সন্তগণই পরমযোগসিদ্ধি মহাপুরুষগণ সেখানে যাইতে সক্ষম।

জ্ঞানগঞ্জের প্রধান কার্যালয় মনোহর তীর্থ নামে পরিচিত। তা অতি দুর্গম হইলেও অত্যন্ত রমণীয় স্থান; ইহা জ্ঞানগঞ্জের অন্যান্য পরমহংসদেবের গুরুদেব ব্রহ্মর্ষি মহাতপার আসন তাই ইহাই একমাত্র পরমসিদ্ধ যোগীদিগের মহাতীর্থ।

পরম গুরুদেব শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের মুখে ওমা ভৈরবী, ত্রিপূরা ভৈরবী প্রভৃতি মাতাগণের নাম উল্লেখ আছে, এ এছাড়াও ক্ষেপা ভৈরবী নামে এক মাতার বয়স বর্তমানে প্রায় ১২০০ বৎসর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। পরমহংসদেবগণ ও ভৈরবী মাতাগণ নানা স্থানে এবং জ্ঞানগঞ্জেই অধিক সময় বাস করেন; নির্দেশানুসারে তাঁহারা মনোহর তীর্থেও গমন করেন।

প্রসিদ্ধ আছে যে রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ্যকালে সিদ্ধপুরী, আমপুরী ও জ্ঞানপুরী নামক তিনজন পর্যটক ভ্রমণ করিতে করিতে ব্রহ্মদেশে কিছুদিন অবস্থানের পর এই গুপ্তস্থানে আসিয়া স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে আরম্ভ করেন।

জ্ঞানগঞ্জ এবং জ্ঞানপীঠের পরমহংসদেবগণ বা যোগিগণ সর্বদা যোগযুক্ত থাকাতে তাঁহারা সর্বদায় থাকে। রোগ, শোক নাই বলিলেই চলে উপরন্তু তাঁহাদের কোন অভাব নাই। পরমগুরু শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব অন্যান্য জ্ঞানগঞ্জ ও জ্ঞানপীঠগুলির মধ্যে একটির কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন যে জলন্ধর (পাঞ্জাব) হইতে গোগা পর্যন্ত যানবাহন আছে তারপর হাঁটিয়া যাইতে হয়। দুইমাস সময় লাগে। উত্তর তিব্বতের কথাও উল্লেখ আছে।

জ্ঞানগঞ্জের ভূমি আকাশ জল তেজ সবই স্বপ্রকাশ, অর্থাৎ সেখানে মাটি নাই, আকাশ প্রভৃতিও নাই, একমাত্র চৈতন্যই ভূমি প্রভৃতিরূপে প্রকাশ পাইয়া থাকে। যেটি ব্যবহারিক জ্ঞানগঞ্জ সেইটি সিদ্ধ পুরুষ প্রভৃতির পরিচিত, কিন্তু যেটি পারমার্থিক জ্ঞানগঞ্জ সেটি যোগের চরম শিখরে উত্থিত না হইলে উপলব্ধি করা যায় না।

তাই বলা হয় তিব্বতের স্থান বিশেষে জ্ঞানগঞ্জ অবস্থিত যেখানে অধিষ্ঠাতৃ বর্গের সহানুভূতি না থাকিলে প্রবেশ করা যায় না। এমন কি সেই স্থানের সন্ধানও পাওয়া যায় না।

পারমার্থিক জ্ঞানগঞ্জের সন্ধান সকলের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে কেউ কেউ যে জ্ঞানগঞ্জের সন্ধান প্রাপ্ত হন বলিয়া শুনিতে পাওয়া যায় তাহা ব্যবহারিক জ্ঞানগঞ্জের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট জানিয়ে হইবে।

তিব্বতে অবস্থিত ‘সত্য জ্ঞানাশ্রম’ বা ‘জ্ঞানমঠ’ নামক গুপ্ত মঠের কথা উল্লিখিত হইয়া তাহা জ্ঞানগঞ্জের সহিত সংসৃষ্ট বলিয়া মনে হয়। এই মঠ হিমালয়ের উত্তরে তিব্বত প্রান্তে অবস্থিত। ইহার পাঁচ মাইল ব্যবধানে চিরতুষার প্রদেশ।

এই মঠে যে প্রকার জ্ঞান পাওয়া যায় তাহার তুলনা পৃথিবীতে আর কোন স্থান নেই।

প্রসিদ্ধ আছে যে রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ্যকালে সিদ্ধপুরী, আমপুরী ও জ্ঞানপুরী নামক তিনজন পর্যটক ভ্রমণ করিতে করিতে ব্রহ্মদেশে কিছুদিন অবস্থানের পর এই গুপ্তস্থানে আসিয়া স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে আরম্ভ করেন।

এখানে যোগ, অমৃতসিদ্ধি অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়ক তত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা হইত। গুরুদেব বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব জ্ঞানগঞ্জের যেরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন, রাম ঠাকুর মহাশয়ের কৌশিকী আশ্রমের বর্ণনা অনেকাংশে অনুরূপ ছিল।

জ্ঞানগঞ্জ, রাজরাজেশ্বরী মঠ এবং পরম গুরুদেবের শ্রীমন্দির এবং স্তরবিন্যাসের দৃষ্টিতে বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত। জ্ঞানগঞ্জ সকলের নিম্নস্তর, রাজ-রাজেশ্বরী মঠ মধ্য স্তর এবং পরমগুরু মহাতপার স্থান সর্বোচ্চ।

সিদ্ধভূমি অনেক আছে- শাস্ত্র পাঠে তাদের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং কোন কোন শক্তিশালী মহাত্মা নিজের জীবনে এ কিছু কিছু প্রত্যক্ষ অনুভব ও প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কথিত আছে, যে জ্ঞানগঞ্জ আমাদের এই পরিচিত পৃথিবীর একটি গুপ্ত স্থান বিশেষ-কিন্তু ইহা এমন গুপ্ত যে, বিশিষ্ট শক্তির বিকাশ না হইলে এবং ঐ স্থানের অধিষ্ঠাতার অনুজ্ঞা না হইলে মর্ত্য জীবের এইস্থান দৃষ্টিগোচর হয় না।

সিদ্ধভূমি মাত্রই ইহাই বৈশিষ্ট্য। সিদ্ধভূমি স্বয়ং প্রকাশ হইলে জীব ঐ স্থান হইতে কোন প্রকার শক্তির আনুকূল্যপ্রাপ্ত না হয় তাহাদের পক্ষে উহার দুর্ভেদ্য ভেদ করা অসম্ভব বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

জ্ঞানগঞ্জের আলোচনা কালে স্মরণ রাখা উচিত যে, এই স্থান সাধারণ ভৌগোলিক স্থানের ন্যায় নহে। ইহা যদিও গুপ্ত ভাবে ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান আছে তথাপি ইহার প্রকৃত স্বরূপ বহুদূরে। প্রকৃত যোগী ভিন্ন এই স্থানের সন্ধান কেউ দিতে পারে না, ইহাতে প্রবেশ লাভ করা তো দূরের কথা।

তবে অধিকারিগণের অনুগ্রহ হইলে এই জগতের সাধারণ মানুষও সেখানে যেতে সমর্থ হয়। ভৌম জ্ঞানগঞ্জ কৈলাসের পরে এবং ঊর্ধ্বে অবস্থিত। কিন্তু তাহা হইলেও উহা সাধারণ পর্যটকের গতিবিধির অতীত।

জ্ঞানগঞ্জ, রাজরাজেশ্বরী মঠ এবং পরম গুরুদেবের শ্রীমন্দির এবং স্তরবিন্যাসের দৃষ্টিতে বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত। জ্ঞানগঞ্জ সকলের নিম্নস্তর, রাজ-রাজেশ্বরী মঠ মধ্য স্তর এবং পরমগুরু মহাতপার স্থান সর্বোচ্চ।

এই স্থানটি যোগী নির্মিত। জ্ঞানগঞ্জ যোগী বিশেষের তীব্রতম যোগ সাধনার প্রভাবে বিশ্বকল্যাণের মহালক্ষ্য পূর্ণ করিবার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে।

………………………..
জ্ঞানগঞ্জ: গোপীনাথ কবিরাজ
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
গুরুছায়া আশ্রম
রহস্যময় কামাখ্যা মন্দির
রহস্যময় জ্ঞানগঞ্জ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!