ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৬ই নভেম্বর

কালীপূজার দিবসে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর সেই উপরের ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন; বেলা ১০টা। বিছানার উপর বালিশে ঠেসান দিয়া আছেন, ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া। রাম, রাখাল, নিরঞ্জন, কালীপদ, মাস্টার প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত আছেন। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় মুখুজ্জের কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (রাম প্রভৃতিকে) – হৃদে এখনও জমি জমি করছে। যখন দক্ষিণেশ্বরে তখন বলেছিল, শাল দাও, না হলে নালিশ করব।

“মা তাকে সরিয়ে দিলেন। লোকজন গেলে কেবল টাকা টাকা করত। সে যদি থাকত এ-সব লোক যেত না। মা সরিয়ে দিলেন।

“গো – অমনি আরম্ভ করেছিল। খুঁতখুঁত করত। গাড়িতে আমার সঙ্গে যাবে তা দেরি করত। অন্য ছোকরারা আমার কাছে এলে বিরক্ত হত। তাদের যদি আমি কলকাতায় দেখতে যেতাম – আমায় বলত, ওরা কি সংসার ছেড়ে আসবে তাই দেখতে যাবেন! জল-খাবার ছোকরাদের দেওয়া আগে ভয়ে বলতুম, তুই খা আর ওদের দে। জানতে পারলুম ও থাকবে না।

“তখন মাকে বললাম – মা ওকে হৃদের মতো একেবারে সরাস নে। তারপর শুনলাম বৃন্দাবনে যাবে।

“গো – যদি থাকত এই-সব ছোকরাদের হত না। ও বৃন্দাবনে চলে গেল তাই এই-সব ছোকরারা আসতে যেতে লাগল।”

গো (বিনীতভাবে) – আজ্ঞে, আমার তা মনে ছিল না।

রাম (দত্ত) – তোমার মন উনি যা বুঝবেন তা তুমি বুঝবে?

(গো) – চুপ করিয়া রহিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গো প্রতি) তুই কেন অমন করছিস – আমি তোকে সন্তান অপেক্ষা ভালবাসি!

“তুই চুপ কর না …… এখন তোর সে ভাব নাই।”

ভক্তদের সহিত কথাবার্তার পর তাঁহারা কক্ষান্তরে চলিয়া গেলে ঠাকুর গো – কে ডাকাইলেন ও বলিলেন, তুই কি কিছু মনে করেছিস।

গো – আজ্ঞে না।

ঠাকুর মাস্টারকে বলিলেন, আজ কালীপূজা, কিছু পূজার আয়োজন করা ভাল। ওদের একবার বলে এস। পাঁকাটি এনেছে কিনা জিজ্ঞাসা করো দেখি।

মাস্টার বৈঠকখানায় গিয়া ভক্তদের সমস্ত জানাইলেন। কালীপদ ও অন্যান্য ভক্তেরা পূজার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।

বেলা আন্দাজ ২টার সময় ডাক্তার ঠাকুরকে দেখিতে আসিলেন। সঙ্গে অধ্যাপক নীলমণি। ঠাকুরের কাছে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। গিরিশ, কালীপদ, নিরঞ্জন, রাখাল, খোকা (মণীন্দ্র), লাটু, মাস্টার অনেকে। ঠাকুর সহাস্যবদন, ডাক্তারের সঙ্গে অসুখের কথা ও ঔষধাদির কথা একটু হইলে পর বলিতেছেন, “তোমার জন্য এই বই এসেছে।” ডাক্তারের হাতে মাস্টার সেই দুখানি বই দিলেন।

ডাক্তার গান শুনিতে চাইলেন। ঠাকুরের আদেশক্রমে মাস্টার ও একটি ভক্ত রামপ্রসাদের গান গাইতেছেন:

গান – মন কর কি তত্ত্ব তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে।

গান – কে জানে কালী কেমন ষড়দর্শনে না পায় দরশন।

গান – মন রে কৃষি কাজ জান না।

গান – আয় মন বেড়াতে যাবি।

ডাক্তার গিরিশকে বলিতেছেন, “তোমার ওই গানটি বেশ – বীণের গান – বুদ্ধ চরিতের।” ঠাকুরের ইঙ্গিতে গিরিশ ও কালীপদ দুইজনে মিলিয়া গান শুনাইতেছেন:

আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার।
যে যত্ন জানে বাজায় বিণে উঠে সুধা অনিবার ৷৷
তানে মানে বাঁধলে ডুরি, শত ধারে বয় মাধুরী।
বাজে না আলগা তারে, টানে ছিঁড়ে কোমল তার ৷৷

গান – জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ৷৷
কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন,
জাগিয়ে ঘুমাই কুহকে যেন।
এ কেমন ঘোর, হবে নাকি ভোর,
অধীর-অধীর যেমতি সমীর, অবিরাম গতি নিয়ত ধাই ৷৷
জানি না কেবা, এসেছি কোথায়,
কেন বা এসেছি, কোথা নিয়ে যায়,
যাই ভেসে ভেসে কত কত দেশে,
চারিদিকে গোল ওঠে নানা রোল।
কত আসে যায়, হাসে কাঁদে গায়,
এই আছে আর তখনি নাই ৷৷
কি কাজে এসেছি কি কাজে গেল,
কে জানে কেমন কি খেলা হল।
প্রবাহের বারি, রহিতে কি পারি,
যাই যাই কোথা কূল কি নাই?
কর হে চেতন, কে আছ চেতন,
কতদিনে আর ভাঙিবে স্বপন?
কে আছ চেতন ঘুমাইও না আর,
দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার।
কর তমঃ নাশ, হও হে প্রকাশ,
তোমা বিনা আর নাহিক উপায়,
তব পদে তাই শরণ চাই ৷৷

গান - আমায় ধর নিতাই

আমার প্রাণ যেন আক করে রে কেমন ৷৷
নিতাই, জীবকে হরি নাম বিলাতে,
উঠল গো ঢেউ প্রেম-নদীতে,
(এখন) সেই তরঙ্গে এখন আমি ভাসিয়ে যাই।
নিতাই যে দুঃখ আমার অন্তরে, দুঃখের কথা কইব কারে,
জীবের দুঃখে এখন আমি ভাসিয়ে যাই।

 গান - প্রাণভরে আয় হরি বলি, নেচে আয় জগাই মাধাই।

 গান - কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জুয়ারে বয়ে যায়।

বহিছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায় ৷৷
প্রেমের কিশোরী প্রেম বিলায় সাধ করি,
রাধার প্রেমে বল রে হরি।
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেম তরঙ্গে প্রাণ নাচায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে, আয় আয় আয় আয় ৷৷

গান শুনিতে শুনিতে দুই-তিনটি ভক্তের ভাব হইয়া গেল, – খোকার (মণীন্দ্রের), লাটুর! লাটু নিরঞ্জনের পার্শ্বে বসিয়াছিলেন। গান হইয়া গেলে ঠাকুরের সহিত ডাক্তার আবার কথা কহিতেছেন। গতকল্য প্রতাপ (মজুমদার) ঠাকুরকে ‘নাক্‌স্‌ ভমিকা’ ঔষধ দিয়াছিলেন। ডাক্তার সরকার শুনিয়া বিরক্ত হইয়াছেন।

ডাক্তার – আমি তো মরি নাই, নাক্‌স্‌ ভমিকা দেওয়া।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তোমার অবিদ্যা মরুক!

ডাক্তার – আমার কোনকালে অবিদ্যা নাই।

ডাক্তার অবিদ্যা মানে নষ্টা স্ত্রীলোক বুঝিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – না গো! সন্ন্যাসীর অবিদ্যা মরে যায় আর বিবেক সন্তান হয়। অবিদ্যা মা মরে গেলে অশৌচ হয়, – তাই বলে সন্ন্যাসীকে ছুঁতে নাই।

হরিবল্লভ আসিয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “তোমায় দেখলে আনন্দ হয়।” হরিবল্লভ অতি বিনীত। মাদুরের নিচে মাটির উপর বসিয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন। হরিবল্লভ কটকের বড় উকিল।

কাছে অধ্যাপক নীলমণি বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাঁহার মান রাখিতেছেন ও বলিতেছেন, আজ আমার খুব দিন। কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তার ও তাঁহার বন্ধু নীলমণি বিদায় গ্রহণ করিলেন। হরিবল্লভও আসিলেন। আসিবার সময় বলিলেন, আমি আবার আসব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!