ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৭ই মার্চ
শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সন্ন্যাসের অবস্থা – তারকসংবাদ

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুরবাড়িতে অরতির উদ্যোগ হইতেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আলো জ্বালা ও ধুনা দেওয়া হইল। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসে জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া সুস্বরে নাম করিতেছেন। ঘরে আর কেহ নাই। কেবল মাস্টার বসিয়া আছেন।

ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। মাস্টারও দাঁড়াইলেন। ঠাকুর ঘরের পশ্চিমের ও উত্তরের দরজা দেখাইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন, “ওদিকগুলো (দরজাগুলি) বন্ধ করো।” মাস্টার দরজাগুলি বন্ধ করিয়া বারান্দায় ঠাকুরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

ঠাকুর বলিতেছেন, “একবার কালীঘরে যাব।” এই বলিয়া মাস্টারের হাত ধরিয়া ও তাঁহার উপর ভর দিয়া কালীঘরের সম্মুখের চাতালে গিয়া উপস্থিত হইলেন আর সেই স্থানে বসিলেন। বসিবার পূর্বে বলিতেছেন, “তুমি বরং ওকে ডেকে দাও।” মাস্টার বাবুরামকে ডাকিয়া দিলেন।

ঠাকুর মা-কালী দর্শন করিয়া বৃহৎ উঠানের মধ্য দিয়া নিজের ঘরে ফিরিতেছেন। মুখে “মা! মা! রাজরাজেশ্বরী!”

ঘরে আসিয়া ছোট খাটটিতে বসিলেন।

ঠাকুরের একটি অদ্ভুত অবস্থা হইয়াছে। কোন ধাতুদ্রব্যে হাত দিতে পারিতেছেন না। বলিয়াছিলেন, “মা বুঝি ঐশ্বর্যের ব্যাপারটি মন থেকে একেবারে তুলে দিচ্ছেন!” এখন কলাপাতায় আহার করেন। মাটির ভাঁড়ে জল খান। গাড়ু ছুঁইতে পারেন না, তাই ভক্তদের মাটির ভাঁড় আনিতে বলিয়াছিলেন। গাড়ুতে বা থালায় হাত দিলে ঝন্‌ঝন করে, যেন শিঙ্গি মাছের কাঁটা বিঁধছে।

প্রসন্ন কয়টি ভাঁড় আনিয়াছিলেন, কিন্তু বড় ছোট। ঠাকুর হাসিয়া বলিতেছেন, “ভাঁড়গুলি বড় ছোট। কিন্তু ছেলেটি বেশ। আমি বলাতে আমার সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়ালো। কি ছেলেমানুষ!”

[‘ভক্ত ও কামিনী’ – ‘সাধু সাবধান’ ]

বেলঘরের তারক একজন বন্ধুসঙ্গে উপস্থিত হইলেন।

ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। মাস্টার ও দুই-একটি ভক্তও বসিয়া আছেন।

তারক বিবাহ করিয়াছেন। বাপ-মা ঠাকুরের কাছে আসিতে দেন না। কলিকাতায় বউবাজারের কাছে বাসা আছে, সেইখানেই আজকাল তারক প্রায় থাকেন। তারককে ঠাকুর বড় ভালবাসেন। সঙ্গী ছোকরাটি একটু তমোগুণী। ধর্মবিষয় ও ঠাকুরের সম্বন্ধে একটু ব্যঙ্গভাব। তারকের বয়স আন্দাজ বিংশতি বৎসর। তারক আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (তারকের বন্ধুর প্রতি) – একবার দেবালয় সব দেখে এস না।

বন্ধু – ও-সব দেখা আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, তারক যে এখানে আসে, এটা কি খারাপ?

বন্ধু – তা আপনি জানেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ইনি (মাস্টার) হেডমাস্টার।

বন্ধু – ওঃ।

ঠাকুর তারককে কুশল প্রশ্ন করিতেছেন। আর তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া অনেক কথা কহিতেছেন। তারক অনেক কথাবার্তার পর বিদায় গ্রহণ করিতে উদ্যত হইলেন। ঠাকুর তাহাকে নানা বিষয়ে সাবধান করিয়া দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (তারকের প্রতি) – সাধু সাবধান! কামিনী-কাঞ্চন থেকে সাবধান! মেয়েমানুষের মায়াতে একবার ডুবলে আর উঠবার জো নাই। বিশালক্ষীর দ; যে একবার পড়েছে সে আর উঠতে পারে না! আর এখানে এক-একবার আসবি।

তারক – বাড়িতে আসতে দেয় না।

একজন ভক্ত – যদি কারু মা বলেন তুই দক্ষিণেশ্বরে যাস নাই। যদি দিব্য দেন আর বলেন, যদি যাস তো আমার রক্ত খাবি! –

[শুধু ঈশ্বরের জন্য গুরুবাক্য লঙ্ঘন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – যে মা ও কথা বলে সে মা নয়; – সে অবিদ্যারূপিণী। সে-মার কথা না শুনলে কোন দোষ নাই। সে-মা ঈশ্বরলাভের পথে বিঘ্ন দেয়। ঈশ্বরের জন্য গুরুজনের বাক্য লঙ্ঘনে দোষ নাই। ভরত রামের জন্য কৈকেয়ীর কথা শুনে নাই। গোপীরা কৃষ্ণদর্শনের জন্য পতিদের মানা শুনে নাই। প্রহ্লাদ ঈশ্বরের জন্য বাপের কথা শুনে নাই। বলি ভগবানের প্রীতির জন্য গুরু শুক্রাচার্যের কথা শুনে নাই। বিভীষণ রামকে পাবার জন্য জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাবণের কথা শুনে নাই।

“তবে ঈশ্বরের পথে যেও না, এ-কথা ছাড়া আর সব কথা শুনবি! দেখি, তোর হাত দেখি।”

এই বলিয়া ঠাকুর তারকের হাত কত ভারী যেন দেখিতেছেন। একটু পরে বলিতেছেন, “একটু (আড়) আছে – কিন্তু ওটুকু যাবে। তাঁকে একটু প্রার্থনা করিস, আর এখানে এক-একবার আসিস – ওটুকু যাবে! কলকাতার বউবাজারের বাসা তুই করেছিস?”

তারক – আজ্ঞা – না, তারা করেছে।

শ্রীরামৃষ্ণ (সহাস্যে) – তারা করেছে না তুই করেছিস? বাঘের ভয়ে?

ঠাকুর কামিনীকে কি বাঘ বলিতেছেন?

তারক প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

ঠাকুর ছোট খাটটিতে শুইয়া আছেন, যেন তারকের জন্য ভাবছেন। হঠাৎ মাস্টারকে বলিতেছেন, – এদের জন্য আমি এত ব্যাকুল কেন?

মাস্টার চুপ করিয়া আছেন – যেন কি উত্তর দিবেন, ভাবিতেছেন। ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন, আর বলিতেছেন, “বল না।”

এদিকে মোহিনীমোহনের পরিবার ঠাকুরের ঘরে আসিয়া প্রণাম করিয়া একপাশে বসিয়া আছেন। ঠাকুর তারকের সঙ্গীর কথা মাস্টারকে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তারক কেন ওটাকে সঙ্গে করে আনলে?

মাস্টার – বোধ হয় রাস্তার সঙ্গী। অনেকটা পথ, তাই একজনকে সঙ্গে করে এনেছে।

এই কথার মধ্যে ঠাকুর হঠাৎ মোহিনীর পরিবারকে সম্বোধন করে বলছেন, অপঘাত মৃত্যু হলে প্রেতনী হয়। সাবধান! মনকে বুঝাবে! এত শুনে-দেখে শেষকালে কি এই হল!

মোহিনী এইবার বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। পরিবারও ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন। ঠাকুর তাঁহার ঘরের মধ্যে উত্তর দিকের দরজার কাছে দাঁড়াইতেছেন। পরিবার মাথায় কাপড় দিয়া ঠাকুরকে আস্তে আস্তে কি বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এখানে থাকবে?

পরিবার – এসে কিছুদিন থাকব। নহবতে মা আছেন তাঁর কাছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা বেশ। তা তুমি যে বল – মরবার কথা – তাই ভয় হয়। আবার পাশে গঙ্গা!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!