ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

ভবনাথ নরেন্দ্র প্রভৃতি মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ও নৃত্য

হাজরা উত্তর-পূর্ব বারান্দায় বসিয়া হরিণামের মালা হাতে করিয়াজপ করিতেছেন। ঠাকুর সম্মুখে আসিয়া বসিলেন ও হাজরার মালা হাতে লইলেন। মাস্টার ও ভবনাথ সঙ্গে। বেলা প্রায় দশটা হইবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) – দেখ, আমার জপ হয় না; – না, না, হয়েছে! – বাঁ হাতে পারি, কিন্তু উদিক (নামজপ) হয় না!

এই বলিয়া ঠাকুর একটু জপ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু জপ আরম্ভ করিতে গিয়া একেবারে সমাধি!

ঠাকুর এই সমাধি অবস্থায় অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন। হাতে মালা-গাছটি এখনও রহিয়াছে। ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। হাজরা নিজের আসনে বসিয়া – তিনিও অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। অনেক্ষণ পরে হুঁশ হইল। ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, খিদে পেয়েছে। প্রকৃতিস্থ হইবার জন্য এই কথাগুলি সমাধির পর প্রায় বলেন।

মাস্টার খাবার আনিতে যাইতেছেন। ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, “না বাপু, আগে কালীঘরে যাব।”

নবমীপূজা-দিবসে শ্রীরামকৃষ্ণের ৺কালীপূজা

ঠাকুর পাকা উঠান দিয়া দক্ষিণাস্য হইয়া কালীঘরের দিকে যাইতেছেন। যাইতে যাইতে দ্বাদশ মন্দিরের শিবকে উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিলেন। বামপার্শ্বে রাধাকান্তের মন্দির। তাঁহাকে দর্শন করিয়া প্রণাম করিলেন। কালীঘরে গিয়া মাকে প্রণাম করিয়া আসনে বসিয়া মার পাদপদ্মে ফুল দিলেন, নিজের মাথায়ও ফুল দিলেন।

চলিয়া আসিবার সময় ভবনাথকে বলিলেন এইগুলি নিয়ে চল্‌ – মার প্রসাদী ডাব আর শ্রীচরণামৃত। ঠাকুর ঘরে ফিরিয়া আসিলেন, সঙ্গে ভবনাথ ও মাস্টার। আসিয়াই, হাজরার সম্মুখে আসিয়া প্রণাম। হাজরা চিৎকার করিয়া উঠিলেন, বলিলেন, কি করেন, কি করেন!

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, তুমি বল, যে এ অন্যায়?

হাজরা তর্ক করিয়া প্রায় এই কথা বলিতেন, ঈশ্বর সকলের ভিতরেই আছেন, সাধনের দ্বারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে।

বেলা হইয়াছে। ভোগ আরতির ঘন্টা বাজিয়া গেল। অতিথিশালায় ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, কাঙাল সকলে যাইতেছে। মার প্রসাদ, রাধাকান্তের প্রসাদ, সকলে পাইবে। ভক্তেরাও মার প্রসাদ পাইবেন। অতিথিশালায় ব্রাহ্মণ কর্মচারীরা যেখানে বসেন, সেইখানে ভক্তেরা বসিয়া প্রসাদ পাইবেন। ঠাকুর বলিলেন, সবাই গিয়ে ওখানে খা – কেমন? (নরেন্দ্রের প্রতি), না তুই এখানে খাবি? –

“আচ্ছা নরেন্দ্র আর আমি এইখানে খাব।”

ভবনাথ, বাবুরাম, মাস্টার ইত্যাদি সকলে প্রসাদ পাইতে গেলেন।

প্রসাদ পাওয়ার পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। ভক্তেরা বারান্দায় বসিয়া গল্প করিতেছেন সেইখানে আসিয়া বসিলেন ও তাঁহাদের সঙ্গে আনন্দ করিতে লাগিলেন। বেলা দুইটা। সকলে উত্তর-পূর্ব বারান্দায় আছেন। হঠাৎ ভবনাথ দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দা হইতে ব্রহ্মচারী বেশে আসিয়া উপস্থিত। গায়ে গৈরিকবস্ত্র, হাতে কমণ্ডলু, মুখে হাসি। ঠাকুর ও ভক্তেরা সকলে হাসিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ওর মনের ভাব ওই কিনা, তাই ওই সেজেছে।

নরেন্দ্র – ও ব্রহ্মচারী সেজেছে, আমি বামাচারী সাজি। (হাস্য)

হাজরা – তাতে পঞ্চ মকার, চক্র – এ-সব করতে হয়।

ঠাকুর বামাচারের কথায় চুপ করিয়া রহিলেন। ও কথায় সায় দিলেন না। কেবল রহস্য করিয়া উড়াইয়া দিলেন। হঠাৎ মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। গাহিতেছেন:

আর ভুলালে ভুলব না মা, দেখেছি তোমার রাঙা চরণ।

পূর্বকথা – রাজনারায়ণের চণ্ডী – নকুড় আচার্যের গান

ঠাকুর বলিতেছেন, আহা, রাজনারায়ণের চণ্ডীর গান কি চমৎকার! ওই রকম করে নেচে নেচে তারা গায়। আর ও-দেশে নকুড় আচার্যের কি গান। আহা, কি নৃত্য, কি গান!

পঞ্চবটীতে একটি সাধু আসিয়াছেন। বড় রাগী সাধু। যাকে তাকে গালাগাল দেন, শাপ দেন! তিনি খড়ম পায়ে দিয়ে এসে উপস্থিত।

সাধু বলিলেন, হিঁয়া আগ মিলে গা? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হাতজোড় করিয়া সাধুকে নমস্কার করিতেছেন এবং যতক্ষণ সে সাধুটি রহিলেন, ততক্ষণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

সাধুটি চলিয়া গেলে ভবনাথ হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, আপনার সাধুর উপর কি ভক্তি!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ওরে তমোমুখ নারায়ণ! যাদের তমোগুণ, তাদের এইরকম করে প্রসন্ন করতে হয়। এ যে সাধু!

শ্রীরামকৃষ্ণ ও গোলকধাম খেলা – “ঠিক লোকের সর্বত্র জয়”

গোলকধাম খেলা হইতেছে। ভক্তেরা খেলিতেছেন, হাজরাও খেলিতেছেন। ঠাকুর আসিয়া দাঁড়াইলেন। মাস্টার ও কিশোরীর ঘুঁটি উঠিয়া গেল। ঠাকুর দুয়জনকে নমস্কার করিলেন! বলিলেন, ধন্য তোমরা দু-ভাই। (মাস্টারকে একান্তে) আর খেলো না। ঠাকুর খেলা দেখিতেছেন, হাজরার ঘুঁটি একবার নরকে পড়িয়াছিল। ঠাকুর বলিতেছেন, হাজরার কি হল! – আবার!

অর্থাৎ হাজরার ঘুঁটি আবার নরকে পড়িয়াছে! এই সকলে হো-হো করিয়া হাসিতেছেন।

লাটুর ঘুঁটি সংসারের ঘর থেকে একেবারে সাতচিৎ মুক্তি! লাটু ধেই ধেই করিয়া নাচিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, নেটোর যে আহ্লাদ – দেখ। ওর উটি না হলে মনে বড় কষ্ট হত। (ভক্তদের প্রতি একান্তে) – এর একটা মানে আছে। হাজরার বড় অহংকার যে, এতেও আমার জিত হবে। ঈশ্বরের এমনও আছে যে, ঠিক লোকের কখনও কোথাও তিনি অপমান করেন না। সকলের কাছেই জয়।

-১৮৮৪, ২৯শে সেপ্টেম্বর-

………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ঊনত্রিংশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!