ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
সংকীর্তনানন্দে ভক্তসঙ্গে

গিরিশ বাড়ি চলিয়া গেলেন। আবার আসিবেন।
শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেনের সহিত ত্রৈলোক্য আসিয়া উপস্থিত। তাঁহারা ঠাকুরকে প্রনাম করিলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর তাঁহাদের কুশল প্রশ্ন করিতেছেন। ছোট নরেন আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, – কই তুই শনিবারে এলিনি? এইবার ত্রৈলোক্য গান গাইবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা, তুমি আনন্দময়ীর গান সেদিন করলে, – কি গান! আর সব লোকের গান আলুনী লাগে! সেদিন নরেন্দ্রের গানও ভাল লাগল না। সেইটে অমনি অমনি হোক না।

ত্রৈলোক্য গাইতেছেন – ‘জয় শচীনন্দন’।

ঠাকুর মুখ ধুইতে যাইতেছেন। মেয়ে ভক্তেরা চিকের পার্শ্বে ব্যাকুল হইয়া বসিয়া আছেন। তাঁহাদের কাছে গিয়া একবার দর্শন দিবেন। ত্রৈলোক্যের গান চলিতেছে।

ঠাকুর ঘরের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, – একটু আনন্দময়ীর গান, – ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

কত ভালবাস গো মা মানব সন্তানে,
মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে (গো মা)।
তব পদে অপরাধী, আছি আমি জন্মাবধি,
তবু চেয়ে মুখপানে প্রেমনয়নে, ডাকিছ মধুর বচনে,
মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে।
তোমার প্রেমের ভার, বহিতে পারি না গো আর,
প্রাণ উঠিছে কাঁদিয়া, হৃদয় ভেদিয়া, তব স্নেহ দরশনে,
লইনু শরণ মা গো তব শ্রীচরণে (গো মা) ৷৷

গান শুনিতে শুনিতে ছোট নরেন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছেন, যেন কাষ্ঠবৎ! ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখ, দেখ, কি গভীর ধ্যান! একেবারে বাহ্যশূন্য!”

গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর ত্রৈলোক্যকে এই গানটি গাইতে বলিলেন – ‘দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে।’

রাম বলিতেছেন, কিছু হরিনাম হোক! ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
হরি হরি হরি বলে, ভবসিন্ধু পারে চল।

মাস্টার আস্তে আস্তে বলিতেছেন, ‘গৌর-নিতাই তোমরা দুভাই।’

ঠাকুরও ওই গানটি গাইতে বলিতেছেন। ত্রৈলোক্য ও ভক্তেরা সকলে মিলিয়া গাইতেছেন:

গৌর নিতাই তোমরা দুভাই পরম দয়াল হে প্রভু!

ঠাকুরও যোগদান করিলেন। সমাপ্ত হইলে আর একটি ধরিলেন:

যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা ব্রজের কানাই বলাই তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা আচণ্ডালে কোল দেয় তারা তারা দুভাই এসেছে রে।

ওই গানের সঙ্গে ঠাকুর আর একটা গান গাহিতেছেন:

নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।

ঠাকুর আবার ধরিলেন:

কে হরিবোল হরিবোল বলিয়ে যায়?
&nnbsp;যা রে মাধাই জেনে আয়।
বুঝি গৌর যায় আর নিতাই যায় রে।
যাদের সোনার নূপুর রাঙা পায়।
যাদের নেড়া মাথা ছেঁড়া কাঁথা রে।
যেন দেখি পাগলেরই প্রায়।

ছোট নরেন বিদায় লইতেছেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুই বাপ-মাকে খুব ভক্তি করবি। – কিন্তু ঈশ্বরের পথে বাধা দিলে মানবিনি। খুব রোখ আনবি – শালার বাপ!

ছোট নরেন – কে জানে, আমার কিছু ভয় হয় না।

গিরিশ বাড়ি হইতে আবার আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সহিত আলাপ করিয়া দিতেছেন; আর বলিতেছেন, ‘একটু আলাপ তোমরা কর।’ একটু আলাপের পর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ‘সেই গানটি আর একবার,’ – ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

[ঝিঁঝিট খাম্বাজ – ঠুংরী ]

জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।
কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ,
কিবা মৃণালনিন্দিত, আজানুলম্বিত, প্রেম প্রসারিত, কোমল যুগল কর
কিবা রুচির বদন-কমল, প্রেমরসে ঢল ঢল,
চিকুর কুন্তল, চারু গণ্ডস্থল, হরিপ্রেমে বিহ্বল, অপরূপ মনোহর।
মহাভাবে মণ্ডিত হরি রসে রঞ্জিত, আনন্দে পুলকিত অঙ্গ,
প্রমত্ত মাতঙ্গ, সোনার গৌরাঙ্গ,
আবেশে বিভোর অঙ্গ, অনুরাগে গরগর।
হরিগুণগায়ক, প্রেমরস নায়ক,
সাধু-হৃদিরঞ্জক, আলোকসামান্য, ভক্তিসিন্ধু শ্রীচৈতন্য,
আহা! ‘ভাই’ বলি চণ্ডালে, প্রেমভরে লন কোলে,
নাচেন দুবাহু তুলে, হরি বোল হরি বলে,
অবিরল ঝরে জলে নয়নে নিরন্তর!
‘কোথা হরি প্রাণধন’ – বলে করে রোদন,
মহাস্বেদ কম্পন, হুঙ্কার গর্জন,
পুলকে রোমাঞ্চিত, শরীর কদম্বিত,
ধুলায় বিলুণ্ঠিত সুন্দর কলেবর।
হরি-লীলা-রস-নিকেতন, ভক্তিরস-প্রস্রবণ;
দীনজনবান্ধব, বঙ্গের গৌরব, ধন্য ধন্য শ্রীচৈতন্য প্রেম শশধর।

‘গৌর হাসে কাঁদে নাচে গায়’ – এই কথা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন, – একেবারে বাহ্যশূন্য!1

কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া – ত্রৈলোক্যকে অনুনয় বিনয় করিয়া বলিতেছেন, “একবার সেই গানটি! – কি দেখিলাম রে।”

ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতি; গৌরাঙ্গ মূরতি, দুনয়নে প্রেম বহে শত ধারে।

গান সমাপ্ত হইল। সন্ধ্যা হয়। ঠাকুর এখনও ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি) – বাজনা নাই! ভাল বাজনা থাকলে গান খুব জমে। (সহাস্যে) বলরামের আয়োজন কি জান, – বামুনের গোড্ডি (গরুটি) খাবে কম, দুধ দেবে হুড়হুড় করে! (সকলের হাস্য) বলরামের ভাব, – আপনারা গাও আপনারা বাজাও! (সকলের হাস্য)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!