ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৭, ৮ – ৯ই মে
ভাই সঙ্গে নরেন্দ্র – নরেন্দ্রের অন্তরের কথা

ধ্যানের ঘরে অর্থাৎ কালী তপস্বীর ঘরে, নরেন্দ্র ও প্রসন্ন কথা কহিতেছেন। ঘরের আর-একধারে রাখাল, হরিশ ও ছোটগোপাল আছেন। শেষাশেষি শ্রীযুক্ত বুড়োগোপাল আসিয়াছেন।

নরেন্দ্র গীতাপাঠ করিতেছেন ও প্রসন্নকে শুনাইতেছেন:

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঽর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্‌ সর্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।।
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।

তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপস্যসি শাশ্বতম্‌।।
সর্বধর্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।

নরেন্দ্র – দেখেছিস ‘যন্ত্রারূঢ়’? ভ্রাময়ন্‌ সর্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া। ঈশ্বরকে জানতে চাওয়া। তুই কীটস্য কীট, তুই তাঁকে জানতে পারবি! একবার ভাব দেখি, মানুষটা কি! এই যে অসংখ্য তারা দেখছিস, শুনেছি এক-একটি Solar System (সৌরজগৎ)। আমাদের পক্ষে একটি Solar System এতেই রক্ষা নাই। যে পৃথিবীকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করলে অতি সামান্য একটি ভাঁটার মতো বোধ হয়, সেই পৃথিবীতে মানুষটা বেড়াচ্ছে যেন একটা পোকা!

নরেন্দ্র গান গাইতেছেন:

[“তুমি পিতা আমরা অতি শিশু” ]

(১) পৃথ্বীর ধূলিতে দেব মোদের জনম,
পৃথ্বীর ধূলিতে অন্ধ মোদের নয়ন।।
জন্মিয়াছি শিশু হয়ে খেলা করি ধূলি লয়ে,
মোদের অভয় দাও দুর্বল-শরণ।।

একবার ভ্রম হলে আর কি লবে না কোলে,
অমনি কি দূরে তুমি করিবে গমন?
তাহলে যে আর কভু, উঠিতে নারিব প্রভু,
ভূমিতলে চিরদিন রব অচেতন।।

আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন।
পদে পদে হয় পিতা! চরণ স্খলন।।
রুদ্রমুখ কেন তবে, দেখাও মোদের সবে,
কেন হেরি মাঝে মাঝে ভ্রূকুটি ভীষণ।।

ক্ষুদ্র আমাদের পরে করিও না রোষ;
স্নেহ বাক্যে বল পিতা কি করেছি দোষ।।
শতবার লও তুলে, শতবার পড়ি ভুলে;
কি আর করিতে পারে দুর্বল যে জন।।

“পড়ে থাক। তাঁর শরণাগত হয়ে পড়ে থাক!”

নরেন্দ্র যেন আবিষ্ট হইয়া আবার গাইতেছেন:

[উপায় – শরণাগতি ]

প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা।
তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা।।
দো রোটি এক লেঙ্গোটি, তেরে পাস ম্যয় পায়া।
ভগতি ভাব আউর দে নাম তেরা গাঁবা।।
তু দেওয়ান মেহেরবান নাম তেরা বারেয়া।
দাস কবীর শরণে আয়া চরণ লাগে তারেয়া।।

“তাঁর কথা কি মনে নাই? ঈশ্বর যে চিনির পাহাড়। তুই পিঁপড়ে, এক দানায় তোর পেট ভরে যায়! তুই মনে করছিস, সব পাহাড়টা বাসায় আনবি। তিনি বলেছেন, মনে নাই, শুকদেব হদ্দ একটা ডেয়ো পিঁপড়ে? তাইতো কালীকে বলতুম, শ্যালা গজ ফিতে নিয়ে ঈশ্বরকে মাপবি?

“ঈশ্বর দয়ার সিন্ধু, তাঁর শরণাগত হয়ে থাক; তিনি কৃপা করবেন! তাঁকে প্রার্থনা কর –

‘যত্তে দক্ষিনং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্‌ -’
অসতো মা সদগময়। তমসো মা জ্যেতির্গময়।।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময় আবিরাবির্ম এধি।।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং। তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।।”

প্রসন্ন – কি সাধন করা যায়?

নরেন্দ্র – শুধু তাঁর নাম কর। ঠাকুরের গান মনে নাই?

নরেন্দ্র পরমহংসদেবের সেই গানটি গাহিতেছেন:

[উপায় – তাঁর নাম ]

(১) নামেরই ভরসা কেবল শ্যামা গো তোমার।
কাজ কি আমার কোশাকুশি, দেঁতোর হাসি লোকাচার।।
নামেতে কাল-পাশ কাটে, জটে তা দিয়েছে রটে।
আমি তো সেই জটের মুটে, হয়েছি আর হব কার।।
নামেতে যা হবার হবে, মিছে কেন মরি ভেবে,
নিতান্ত করেছি শিবে, শিবেরি বচন সার।।

(২) আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন।
পদে পদে হয় পিতা চরণ স্খলন।।

[ঈশ্বর কি আছেন? ঈশ্বর কি দয়াময়? ]

প্রসন্ন – তুমি বলছ ঈশ্বর আছেন। আবার তুমিই তো বলো, চার্বাক আর অন্যান্য অনেকে বলে গেছেন যে, এই জগৎ আপনি হয়েছে!

নরেন্দ্র – Chemistry পড়িসনি? আরে Combination কে করবে? যেমন জল তৈয়ার করবার জন্য Oxygen, Hydrogen আর Electricity এ-সব human-hand-এ একত্র করে।

“Intelligent force সব্বাই মানছে। জ্ঞানস্বরূপ একজন; যে এই সব ব্যাপার চালাচ্ছে।”

প্রসন্ন – দয়া আছে কেমন করে জানব?

নরেন্দ্র – ‘যত্তে দক্ষিণং মুখম্‌।’ বেদে বলেছে।

“John Stuart Mill-ও ওই কথাই বলেছেন। যিনি মানুষের ভিতর এই দয়া দিয়েছেন না জানি তাঁর ভিতরে কত দয়া! – Mill এই কথা বলেন। তিনি (ঠাকুর) তো বলতেন ‘বিশ্বাসই সার’। তিনি তো কাছেই রয়েছেন! বিশ্বাস করলেই হয়!” এই বলিয়া নরেন্দ্র আবার মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন:

[উপায় – বিশ্বাস ]

মোকো কাঁহা ঢুঁঢ়ো বন্দে ম্যয়তো তেরে পাশ মো।
ন হোয়ে ম্যয় ঝগ্‌ড়ি বিগ্‌ড়ি না ছুরি গঢ়াস মো।
ন হোয়ে মো খাল্‌ রোম্‌মে না হাড্ডি না মাস্‌ মো।।
ন দেবল মো না মস্‌জিদ মো না কাশী কৈলাস মো।

ন হোয়ে ম্যয় আউধ দ্বারকা মেরা ভেট বিশ্বাস মো।।
ন হোয়ে ম্যয় ক্রিয়া করম্‌মো, না যোগ বৈরাগ সন্ন্যাস মো।
খোঁজেগা তো আব মিলুঙ্গা, পলভরকি তল্লাস মো।।
সহর্‌সে বাহার ডেরা হামারি কুঠিয়া মেরী মৌয়াস মো।
কহত কবীর শুন ভাই সাধু, সব সন্তনকী সাথ মো।।

[বাসনা থাকলে ঈশ্বরে অবিশ্বাস হয় ]

প্রসন্ন – তুমি কখনও বল, ভগবান নাই; আবার এখন ওই সব কথা বলছো। তোমার কথার ঠিক নাই, তুমি প্রায় মত বদলাও। (সকলের হাস্য)

নরেন্দ্র – এ-কথা আর কখন বদলাব না – যতক্ষণ কামনা, বাসনা, ততক্ষণ ঈশ্বরে অবিশ্বাস। একটা না একটা কামনা থাকেই। হয়তো ভিতরে ভিতরে পড়বার ইচ্ছা আছে – পাস করবে, কি পণ্ডিত হবে – এই সব কামনা।

নরেন্দ্র – ভক্তিতে গদ্‌গদ্‌ হইয়া গান গাইতে লাগিলেন। ‘তিনি শরণাগত-বৎসল, পরম পিতা মাতা।’

জয় দেব জয় দেব জয় মঙ্গলদাতা, জয় জয় মঙ্গলদাতা।
সঙ্কটভয়দুখত্রাতা, বিশ্বভুবনপাতা, জয় দেব জয় দেব।।
অচিন্ত্য অনন্ত অপার, নাই তব উপমা প্রভু, নাহি তব উপমা।
প্রভু বিশ্বেশ্বর ব্যাপক বিভু চিন্ময় পরমাত্মা, জয় দেব জয় দেব।।
জয় জগদবন্দ্য বয়াল, প্রণমি তব চরণে, প্রভু প্রণমি তব চরণে।

পরম শরণ তুমি হে, জীবনে মরণে, জয় দেব দেব।।
কি আর যাচিব আমরা, করি হে এ মিনতি, প্রভু করি হে এ মিনতি।
এ লোকে সুমতি দেও, পরলোকে সুগতি, জয় দেব জয় দেব।।

নরেন্দ্র আবার গাইলেন। ভাইদের হরিরস পিয়ালা পান করিতে বলিতেছেন। ঈশ্বর খুব কাছেই আছেন – কস্তুরী যেমন মৃগের –

পীলেরে অবধূত হো মাতবারা, প্যালা প্রেম হরিরস কা রে।
বাল অবস্থা খেল গঁবাই, তরুণ ভয়ে নারী বশ কা রে।
বৃদ্ধাভয়ো কফ বায়ুনে ঘেরা, খাট পড়া রহে নহিঁ জায় বস্‌কারে।
নাভ কমলমে হ্যায় কস্তুরী, ক্যায়সে ভরম মিটে পশুকা রে।
বিনা সদ্‌গুরু নর য়্যাসাহি ঢুঁঢ়ে, জ্যায়সা মৃগ ফিরে বনকা রে।

মাস্টার বারান্দা হইতে এই সমস্ত কথা শুনিতেছেন।

নরেন্দ্র গাত্রোত্থান করিলেন। ঘর হইতে চলিয়া আসিবার সময় বলিতেছেন, মাথা গরম হল বকে বকে! বারান্দাতে মাস্টারকে দেখিয়া বলিলেন, “মাস্টার মহাশয়, কিছু জল খান।”

মঠের একজন ভাই নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, “তবে যে ভগবান নাই বলো!” নরেন্দ্র হাসিতে লাগিলেন।

[নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য – নরেন্দ্রের গৃহাস্থাশ্রম নিন্দা ]

পরদিন শনিবার, ৯ই মে। মাস্টার সকাল বেলা মঠের বাগানের গাছতলায় বসিয়া আছেন। মাস্টার ভাবিতেছেন, “ঠাকুর মঠের ভাইদের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ করাইয়াছেন। আহা, এঁরা কেমন ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল! স্থানটি যেন সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠ। মঠের ভাইগুলি যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ! ঠাকুর বেশিদিন চলিয়া যান নাই; তাই সেই সমস্ত ভাবই প্রায় বজায় রহিয়াছে।

“সেই অযোধ্যা! কেবল রাম নাই!

“এদের তিনি গৃহত্যাগ করালেন। কয়েকটিকে তিনি গৃহে রেখেছেন কেন? এর কি কোন উপায় নাই?”

নরেন্দ্র উপরের ঘর হইতে দেখিতেছেন, – মাস্টার একাকী গাছতলায় বসিয়া আছেন। তিনি নামিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, “কি মাস্টার মহাশয়! কি হচ্ছে?” কিছু কথা হইতে হইতে মাস্টার বলিলেন, “আহা তোমার কি সুর! একটা কিছু স্তব বল।”

নরেন্দ্র সুর করিয়া অপরাধভঞ্জন স্তব বলিতেছেন। গৃহস্থেরা ঈশ্বরকে ভুলে রয়েছে – কত অপরাধ করে – বাল্যে, প্রৌঢ়ে, বার্ধক্যে! কেন তারা কায়মনোবাক্যে ভগবানের সেবা বা চিন্তা করে না –

বাল্যে দুঃখাতিরেকো মললুলিতবপুঃ স্তন্যপানে পিপাসা,
নো শক্তশ্চেন্দ্রিয়েভ্যো ভবগুণজনিত শত্রবো মাং তুদন্তি।
নানারোগোত্থদুঃখাদ্‌রূদনপরবশঃ শঙ্করং ন স্মরামি,
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো।।

প্রৌঢ়েঽহম্‌ যৌবনস্থো বিষয়বিষধরৈঃ পঞ্চভির্মর্মসন্ধৌ,
দষ্টো নষ্টোবিবেকঃ সুতধনযুবতীস্বাদসৌখ্যে নিষণ্ণঃ।
শৈবীচিন্তাবিহীনং মম হৃদয়মহো মানগর্বাধিরূঢ়ং
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো।।

বার্ধক্যে চেন্দ্রিয়াণাং বিগতগতিমতিশ্চাধিদৈবাদিতাপৈঃ,
পাপৈঃ রোগৈর্বিয়োঢোগৈস্তনবসিতবপুঃ প্রৌঢ়িহীনঞ্চ দীনম্‌
মিথ্যামোহাভিলাষৈর্ভ্রমতি মম মনো ধুর্জটের্ধ্যানশূনং
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো।।

স্নাত্বা প্রত্যূষকালে স্নপনবিধিবিধৌ নাহৃতং গাঙ্গতোয়ং
পূজার্থং বা কদাচিদ্বহুতরগহনাৎ খণ্ডবিল্বীদলানি।
নানীতা পদ্মমালা সরসি বিকসিতা গন্ধধূপৈস্ত্বদর্থং,
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ শিব শিব শিব ভোঃ শ্রীমহাদেব শম্ভো।।

গাত্রং ভস্মসিতং সিতঞ্চ হসিতং হস্তে কপালং সিতং
খট্বাঙ্গঞ্চ সিতং সিতশ্চ বৃষভঃ কর্ণে সিতে কুণ্ডলে।
গঙ্গাফেনসিতা জটা পশুপতেশ্চন্দ্রঃ সিতো মূর্ধনি,
সোঽয়ং সর্বসিতো দদাতু বিভবং পাপক্ষয়ং সর্বদা।। ইত্যাদি

স্তব পাঠ হইয়া গেল। আবার কথাবার্তা হইতেছে।

নরেন্দ্র – নির্লিপ্ত সংসার বলুন আর যাই বলুন, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না করলে হবে না। স্ত্রী সঙ্গে সহবাস করতে ঘৃণা করে না? যে স্থানে কৃমি, কফ, মেদ, দুর্গন্ধ –

অমেধ্যপূর্ণে কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাবদুর্গন্ধে নিরন্তকান্তরে।
কলেবরে মুত্রপুরীষভাবিতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পণ্ডিতাঃ।।

“বেদান্তবাক্যে যে রমণ করে না, হরিরস মদিরা যে পান করে না তাহার বৃথাই জীবন।

ওঁকারমূলং পরমং পদান্তরং গায়ত্রীসাবিত্রীসুভাষিতান্তরং।
বেদান্তরং যঃ পুরুষো ন সেবতে বৃথান্তরং তস্য নরস্য জীবনম্‌।।

“একটা গান শুনুন:

“ছাড় মোহ – ছাড়রে কুমন্ত্রণা, জান তাঁরে তবে যাবে যন্ত্রণা।।
চারিদিনের সুখের জন্য, প্রাণসখারে ভুলিলে, একি বিড়ম্বনা।।

“কৌপীন না পরলে আর উপায় নাই। সংসারত্যাগ!”

এই বলিয়া আবার সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম্‌ বলিতেছেন:

বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।। ইত্যাদি

নরেন্দ্র আবার বলিতেছেন, মানুষ কেন সংসারে বদ্ধ হবে, কেন মায়ার বদ্ধ হবে? মানুষের স্বরূপ কি? ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং’ আমিই সেই সচ্চিদানন্দ।

ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোমভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।।

নরেন্দ্র আর একটি স্তব, বাসুদেবাষ্টক সুর করিয়া বলিতেছেন:

হে মধুসূদন! আমি তোমার শরণাগত; আমাকে কৃপা করে কামনিদ্রা, পাপ মোহ, স্ত্রীপুত্রের মোহজাল, বিষয়তৃষ্ণা থেকে ত্রাণ কর। আর পাদপদ্মে ভক্তি দাও।

ওমিতি জ্ঞানরূপেণ রাগাজীর্ণেন জীর্যতঃ।
কামনিদ্রাং প্রপন্নোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
ন গতির্বিদ্যতে নাথ ত্বমেকঃ শরণং প্রভো।
পাপপঙ্কে নিমগ্নোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

মোহিতো মোহজালেন পুত্রদার গৃহাদিষু।
তৃষ্ণয়া পীড্যমানোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
ভক্তিহীনঞ্চ দীনঞ্চ দুঃখশোকাতুরং প্রভো।
অনাশ্রয়মনাথঞ্চ ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

গতাগতেন শ্রান্তোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
পুনর্নাগন্তুমিচ্ছামি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
বহবোঽপি ময়া দৃষ্টং যোনিদ্বারং পৃথক্‌ পৃথক্‌।
গর্ভবাসেমহদ্দুঃখং ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

তেন দেব প্রপন্নোঽস্মি নারায়ণঃ পরায়ণঃ।
জগৎ সংসারমোক্ষার্থং ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
বাচয়ামি যথোৎপন্নং প্রণমামি তবাগ্রতঃ।
জরামরণভীতোঽস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

সুকৃতং ন কৃতং কিঞ্চিৎ দুষ্কৃতঞ্চ কৃতং ময়া।
সংসারে পাপপঙ্কেঽস্মিন্‌ ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
দেহান্তরসহস্রাণামন্যোন্যঞ্চ কৃতং ময়া।
কর্তৃত্বঞ্চ মনুষ্যাণাং ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

বাক্যেন যৎ প্রতিজ্ঞাতং কর্মণা নোপপাদিতম্‌।
সোঽহং দেব দুরাচারস্ত্রাহি মাং মধুসূদন।।
যত্র যত্র হি জাতোঽস্মি স্ত্রীষু বা পুরুষেষু বা।
তত্র তত্রাচলা ভক্তিস্ত্রাহি মাং মধুসূদন।।

মাস্টার (স্বগত) – নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য! তাই মঠের ভাইদের সকলেরই এই অবস্থা। ঠাকুরের ভক্তদের ভিতর যাঁরা সংসারে এখনও আছেন, তাঁদের দেখে এদের কেবল কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা উদ্দীপন হচ্ছে। আহা, এদের কি অবস্থা! এ-কটিকে তিনি সংসারে এখনও কেন রেখেছেন? তিনি কি কোন উপায় করবেন? তিনি কি তীব্র বৈরাগ্য দিবেন; না সংসারেই ভুলাইয়া রাখিয়া দিবেন?

আজ নরেন্দ্র ও আরও দু-একটি ভাই আহারের পর কলিকাতায় গেলেন। আবার রাত্রে নরেন্দ্র ফিরিবেন। নরেন্দ্রের বাটীর মোকদ্দমা এখনও চোকে নাই। মঠের ভাইরা নরেন্দ্রের অদর্শন সহ্য করিতে পারেন না। সকলেই ভাবিতেছেন, নরেন্দ্র কখন ফিরিবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!