ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সাকার-নিরাকার কথা

বিজয় প্রভৃতির সঙ্গে সাকার-নিরাকার কথা – চিনির পাহাড়

কেদার ও কয়েকটি ভক্ত গাত্রোত্থান করিলেন – বাড়ি যাইবেন। কেদার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন, আর বলিলেন, আজ্ঞা তবে আসি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি অধরকে না বলে যাবে? অভদ্রতা হয় না?

কেদার – তস্মিন্‌ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্‌; আপনি যেকালে রইলেন, সকলেরই থাকা হল – আর কিছু অসুখ বোধ হয়েছে – আর বিয়ে থাওয়ার জন্য একটা ভয় হয় – সমাজ আছে – একবার তো গোল হয়েছে –

বিজয় – এঁকে রেখে যাওয়া –

সময় ঠাকুরকে লইয়া যাইতে অধর আসিলেন। ভিতরে পাতা হইয়াছে। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন ও বিজয় ও কেদারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, এসো গো আমার সঙ্গে। বিজয়, কেদার ও অন্যান্য ভক্তেরা ঠাকুরের সঙ্গে বসিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।

ঠাকুর আহারান্তে বৈঠকখানায় আসিয়া আবার বসিলেন। কেদার, বিজয় ও অন্যান্য ভক্তেরা চারিপার্শ্বে বসিলেন।

কেদারের কাকুতি ও ক্ষমা প্রার্থনা – বিজয়ের দেবদর্শন

কেদার কৃতাঞ্জলি হইয়া অতি নম্রভাবে ঠাকুরকে বলিতেছেন, মাপ করুন, যা ইতস্ততঃ করেছিলাম। কেদার ভাবিতেছেন, ঠাকুর যেখানে আহার করিয়াছেন, সেখানে আমি কোন্‌ ছার!

কেদারের কর্মস্থল ঢাকায়। সেখানে অনেক ভক্ত তাঁহার কাছে আসেন ও তাঁহাকে খাওয়াইতে সন্দেশাদি নানারূপ দ্রব্য আনয়ন করেন। কেদার সেই সকল কথা ঠাকুরকে নিবেদন করিতেছেন।

কেদার (বিনীতভাবে) – লোকে অনেকে খাওয়াতে আসে। কি করব প্রভু, হুকুম করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ভক্ত হলে চণ্ডালের অন্ন খাওয়া যায়। সাত বৎসর উন্মাদের পর ও-দেশে (কামারপুকুরে) গেলুম। তখন কি অবস্থাই গেছে। খানকী পর্যন্ত খাইয়ে দিলে! এখন কিন্তু পারি না।

কেদার (বিদায় গ্রহণের পূর্বে মৃদুস্বরে) – প্রভু, আপনি শক্তি সঞ্চার করুন। অনেক লোক আসে। আমি কি জানি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হয়ে যাবে গো! আন্তরিক ঈশ্বরে মতি থাকলে হয়ে যায়।

কেদার বিদায় লইবার পূর্বে বঙ্গবাসীর সম্পাদক শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্র প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

সাকার-নিরাকার সম্বন্ধে কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনি সাকার, নিরাকার, আবার কত কি; তা আমরা জানি না! শুধু নিরাকর বললে কেমন করে হবে?

যোগেন্দ্র – ব্রাহ্মসমাজের এক আশ্চর্য! বারবছরের ছেলে, সেও নিরাকার দেখছে! আদিসমাজে সাকারে অত আপত্তি নাই। ওরা পূজাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে আসতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ইনি বেশ বলেছেন, সেও নিরাকার দেখছে।

অধর – শিবনাথবাবু সাকার মানেন না।

বিজয় – সেটা তাঁর বুঝবার ভুল। ইনি যেমন বলেন, বহুরূপী কখন এ রঙ কখন সে রঙ। যে গাছতলায় বসে থাকে, সেই ঠিক জানতে পারে। আমি ধ্যান করতে করতে দেখতে পেলাম চালচিত্র। কত দেবতা, তাঁরা কত কি বলেন। আমি বললুম, তাঁর কাছে যাব তবে বুঝব।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার ঠিক দেখা হয়েছে।

কেদার – ভক্তের জন্য সাকার। প্রেমে ভক্ত সাকার দেখে। ধ্রুব যখন ঠাকুরকে দর্শন কল্লেন, বলেছিলেম, কুণ্ডল কেন দুলছে না? ঠাকুর বললেন, তুমি দোলালেই দোলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সব মানতে হয় গো – নিরাকার-সাকার সব মানতে হয়। কালীঘরে ধ্যান করতে করতে দেখলুম রমণী খানকী! বললুম, মা তুই এইরূপেও আছিস! তাই বলছি, সব মানতে হয়। তিনি কখন কিরূপে দেখা দেন, সামনে আসেন, বলা যায় না।

এই বলিয়া ঠাকুর গান ধরিলেন – এসেছেন এক ভাবের ফকির।

বিজয় – তিনি অনন্তশক্তি – আর-একরূপে দেখা দিতে পারেন না? কি আশ্চর্য! সব রেণুর রেণু এরা সব কি না এই সব ঠিক করতে যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – একটু গীতা, একটু ভাগবত, একটু বেদান্ত পড়ে লোকে মনে করে, আমি সব বুঝে ফেলেছি। চিনির পাহাড়ে একটা পিঁপড়ে গিছল। একদানা চিনি খেয়ে তার পেটে ভরে গেল। আর-একদানা মুখে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় ভাবছে, এবারে এসে পাহাড়টা নিয়ে যাব! (সকলের হাস্য)

-১৮৮৪, ১লা অক্টোবর-

………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ত্রিংশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!