ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজের মহোৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৮৮২, ১লা জানুয়ারি
রাম, কেশব, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

আজ শ্রীরামকৃষ্ণ সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজের সাংবাৎসরিক মহোৎসবে ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন। জ্ঞান চৌধুরীর বাড়িতে মহোৎসব হইতেছে। ১লা জানুয়ারি, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, রবিবার, বেলা ৫টা হইবে। (১৮ই পৌষ, ১২৮৮)

শ্রীযুক্ত কেশব সেন, রাম, মনোমোহন, বলরাম, ব্রাহ্মভক্ত রাজমোহন, জ্ঞান চৌধুরী, কেদার, ব্রাহ্মভক্ত কান্তিবাবু, কালিদাস সরকার, কালিদাস মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি অনেক ভক্ত উপস্থিত।

নরেন্দ্র, রাম প্রভৃতির সঙ্গে গিয়া কেবল কয়দিন মাত্র হইল ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করিয়াছেন। আজও এই উৎসবে যোগদান করিয়াছেন। তিনি সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজে মধ্যে মধ্যে আসিতেন ও সেখানে গান ও উপাসনা করিতেন।

ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা হইবে।

প্রথমে কিছু পাঠ হইল। নরেন্দ্র গাইতে পারেন, তাঁহাকে গান গাইতে অনুরোধ করাতে তিনিও গান গাহিলেন।

সন্ধ্যা হইল। ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত গেরুয়াপরা ব্রহ্মচারীবেশে আসিয়া উপস্থিত।

গৌরী – কোথা গো পরমহংস বাবু?

কিয়ৎক্ষণ পরে কেশব ব্রাহ্মভক্তগণ সঙ্গে আসিয়া পৌঁছিলেন ও ভূমিষ্ঠ হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করিলেন। সকলেই দালানের উপর উপবিষ্ট; পরস্পর আনন্দ করিতেছেন। চর্তুদিকে সংসারী ভক্তগণকে উপবিষ্ট দেখিয়া ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তা সংসারে হবে না কেন? তবে কি জান, মন নিজের কাছে নাই। নিজের কাছে মন থাকলে তবে তো ভগবানকে দেবে। মন বন্ধক দিয়েছ; কামিনী-কাঞ্চনে বন্ধক! তাই সর্বদা সাধুসঙ্গ দরকার।

“মন নিজের কাছে এলে তবে সাধন-ভজন হবে। সর্বদাই গুরুর সঙ্গ, গুরুসেবা, সাধুসঙ্গ প্রয়োজন। হয় নির্জনে রাতদিন তাঁর চিন্তা, নয় সাধুসঙ্গ। মন একলা থাকলে ক্রমে শুষ্ক হয়ে যায়।

“এক ভাঁড় জল যদি আলাদা রেখে দাও, ক্রমে শুকিয়ে যাবে! কিন্তু গঙ্গাজলের ভিতর যদি ওই ভাঁড় ডুবিয়ে রাখো, তাহলে শুকবে না!

“কামারশালার লোহা আগুনে বেশ লাল হয়ে গেল। আবার আলাদা করে রাখো, যেমন কালো লোহা, তেমনি কালো। তাই লোহাকে মধ্যে মধ্যে হাপরে দিতে হয়।

“আমি কর্তা, আমি করছি তবে সংসার চলছে; আমার গৃহ পরিজন – এ সকল অজ্ঞান! আমি তাঁর দাস, তাঁর ভক্ত, তাঁর সন্তান – এ খুব ভাল।

“একেবারে আমি যায় না। এই বিচার করে উড়িয়ে দিচ্ছ, আবার কাটা ছাগল যেমন একটু ভ্যা ভ্যা করে হাত পা নাড়ে, সেই রকম কোথা থেকে আমি এসে পড়ে।

“তাঁকে দর্শন করবার পর, তিনি যে আমি রেখে দেন, তাকে বলে পাকা আমি।

“যেমন তরবার পরশমণি ছুঁয়েছে, সোনা হয়ে গিয়েছে। তার দ্বারা আর হিংসার কাজ হয় না!”

শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরদালানের উপর বসিয়া সকল কথা কহিতেছেন। কেশব প্রভৃতি ভক্তগণ নিস্তব্ধ হইয়া শুনিতেছেন। রাত ৮টা হইয়াছে। তিনবার ঘন্টা (Warning bell) বাজিল, যাহাতে উপাসনা আরম্ভ হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশব প্রভৃতির প্রতি) – এ কি! তোমাদের উপাসনা হচ্ছে না!

কেশব – আর উপাসনা কি হবে? এই তো সব হচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না গো, যেমন পদ্ধতি সেইরকম হক।

কেশব – কেন এই তো বেশ হচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক বলাতে কেশব উঠিয়া উপাসনা আরম্ভ করিলেন।

উপাসনা মধ্যে ঠাকুর হঠাৎ দণ্ডায়মান – সমাধিস্থ হইয়াছেন।

ব্রাহ্মভক্তগণ গান গাহিতেছেন:

মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
হরি হরি হরি বলে ভবসিন্ধু পারে চল ৷৷
জলে হরি স্থলে হরি, অনলে অনিলে হরি।
চন্দ্রে হরি, সূর্যে হরি, হরিময় এই ভূমণ্ডল।।

শ্রীরামকৃষ্ণ এখনও ভাবস্থ হইয়া দণ্ডায়ামন। কেশব অতি সন্তর্পণে তাঁহার হাত ধরিয়া দালান হইতে প্রাঙ্গণে নামিলেন।

গান চলিতেছে। এইবার ঠাকুর গানের সঙ্গে নৃত্য করিতেছেন। চতুর্দিকে ভক্তগণও নাচিতেছেন।

জ্ঞানবাবুর দ্বিতলের ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব প্রভৃতিকে জল খাওয়াবার আয়োজন হইতেছে।

তঁহারা জলযোগ করিয়া আবার নিচে নামিয়া বসিলেন। ঠাকুর কথা কহিতে কহিতে আবার গান গাহিতেছেন। কেশবও সেই সঙ্গে যোগ দিয়াছেন –

মজলো আমার মন ভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে।
যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল কামাদি কুসুম সকলে ৷৷

গান – শ্যামাপদ আকাশেতে মন ঘুড়ি খান উড়িতেছিল।
কলুষের কুবাতাস খেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল ৷৷

ঠাকুর কেশব দুজনেই মাতিয়া গেলেন। আবার সকলে মিলিয়া গান ও নৃত্য, রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত।

একটু বিশ্রাম করিয়া ঠাকুর কেশবকে বলিতেছেন – তোমার ছেলের বিবাহের বিদায় পাঠিয়েছিলে কেন? ফেরত এনো – আমি ও-সব নিয়ে কি করব?

কেশব ঈষৎ হাসিতেছেন। ঠাকুর আবার বলিতেছেন – আমার নাম কাগজে প্রকাশ কর কেন? বই লিখে, খবরের কাগজে লিখে, কারুকে বড়ো করা যায় না। ভগবান যাকে বড় করেন, বনে থাকলেও তাকে সকলে জানতে পারে। গভীরবনে ফুল ফুটেছে, মৌমাছি কিন্তু সন্ধান করে যায়। অন্য মাছি সন্ধান পায় না। মানুষ কি করবে? মানুষের মুখ চেয়ো না – লোক! পোক! যে মুখে ভাল বলছে, সেই মুখে আবার মন্দ বলবে। আমি মান্যগণ্য হতে চাই না। যেন দীনের দীন, হীনের হীন হয়ে থাকি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!