ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

নবাই চৈতন্য, নরেন্দ্র, বাবুরাম, লাটু, মণি, রাখাল, নিরঞ্জন, অধর

ঠাকুর নিজের ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। বলরাম আম্র আনিয়াছিলেন! ঠাকুর শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যেকে বলিতেছেন – তোমার ছেলের জন্য আমগুলি নিয়ে যেও। ঘরে শ্রীযুক্ত নবাই চৈতন্য বসিয়াছেন। তিনি লাল কাপড় পরিয়া আসিয়াছেন।

উত্তরের লম্বা বারান্দায় ঠাকুর হাজরার সহিত কথা কহিতেছেন। ব্রহ্মচারী হরিতাল ভস্ম ঠাকুরের জন্য দিয়াছেন। – সেই কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ব্রহ্মচারীর ঔষধ আমার বেশ খাটে – লোকটা ঠিক।

হাজরা – কিন্তু বেচারী সংসারে পড়েছে – কি করে! কোন্নগর থেকে নবাই চৈতন্য এসেছেন। কিন্তু সংসারী লাল কাপড় পরা!

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি বলব! আর আমি দেখি ঈশ্বর নিজেই এই-সব মানুষরূপ ধারণ করে রয়েছেন। তখন কারুকে কিছু বলতে পারি না।

ঠাকুর আবার ঘরের মধ্যে আসিয়াছেন। হাজরার সহিত নরেন্দ্রের কথা কহিতেছেন।

হাজরা – “নরেন্দ্র আবার মোকদ্দমায় পড়েছে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – শক্তি মানে না। দেহধারণ করলে শক্তি মানতে হয়।

হাজরা – বলে, আমি মানলে সকলেই মানবে, – তা কেমন করে মানি।

“অত দূর ভাল নয়। এখন শক্তিরই এলাকায় এসেছে। জজসাহেব পর্যন্ত যখন সাক্ষী দেয়, তাঁকে সাক্ষীর বাক্সে নেমে এসে দাঁড়াতে হয়।”

ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন – তোমার সঙ্গে নরেন্দ্রের দেখা হয় নাই?

মাস্টার – আজ্ঞা, আজকাল হয় নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – একবার দেখা করো না – আর গাড়ি করে আনবে।

(হাজরার প্রতি) – “আচ্ছা, এখানকার সঙ্গে কি তার সম্বন্ধ?”

হাজরা – আপনার সাহায্য পাবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ভবনাথ? সংস্কার না থাকলে এখানে এত আসে?

“আচ্ছা, হরিশ, লাটু – কেবল ধ্যান করে; – উগুনো কি?”

হাজরা – হাঁ, কেবল ধ্যান করা কি? আপনাকে সেবা করে, সে এক।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হবে! – ওরা উঠে গিয়ে আবার কেউ আসবে।

মণির প্রতি নানা উপদেশ। শ্রীরামকৃষ্ণের সহজাবস্থা

হাজরা ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। এখনও সন্ধ্যার দেরি আছে। ঠাকুর ঘরে বসিয়া একান্তে মণির সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – আচ্ছা, আমি যা ভাবাবস্থায় বলি, তাতে লোকের আকর্ষণ হয়?

মণি – আজ্ঞা, খুব হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – লোকে কি ভাবে? ভাবাবস্থায় দেখলে কিছু বোধ হয়?

মণি – বোধ হয়, একধারে জ্ঞান, প্রেম, বৈরাগ্য – তার উপর সহজাবস্থা। ভিতর দিয়ে কত জাহাজ চলে গেছে, তবু সহজ! ও অবস্থা অনেকে বুঝতে পারে না – দু-চারজন কিন্তু ওইতেই আকৃষ্ট হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ঘোষপাড়ার মতে ঈশ্বরকে ‘সহজ’ বলে। আর বলে, সহজ না হলে সহজকে না যায় চেনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও অভিমান ও অহংকার। “আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী”

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – আচ্ছা, আমার অভিমান আছে?

মণি – আজ্ঞা, একটু আছে। শরীররক্ষা আর ভক্তির-ভক্তের জন্য, – জ্ঞান-উপদেশের জন্য। তাও আপনি প্রার্থনা করে রেখেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি রাখি নাই; – তিনিই রেখে দিয়েছেন। আচ্ছা, ভাবাবেশের সময় কি হয়?

মণি – আপনি তখন বললেন, ষষ্ঠভূমিতে মন উঠে ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। তারপর কথা যখন কন, তখন পঞ্চমভূমিতে মন নামে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনিই সব কচ্ছেন। আমি কিছুই জানি না।

মণি – আজ্ঞা, তাই জন্যই তো এত আকর্ষণ!

Why all Scriptures – all Religions – are true –
শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিরুদ্ধ শাস্ত্রের সমন্বয়

মণি – আজ্ঞা, শাস্ত্রে দুরকম বলেছে। এক পুরাণের মতে কৃষ্ণকে চিদাত্মা, রাধাকে চিচ্ছক্তি বলেছে। আর এক পুরাণে কৃষ্ণই কালী – আদ্যাশক্তি বলেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেবীপুরাণের মত। এ-মতে কালীই কৃষ্ণ হয়েছেন।

“তা হলেই বা! – তিনি অনন্ত, পথও অনন্ত।”

এই কথা শুনিয়া মণি অবাক্‌ হইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।

মণি – ও বুঝেছি। আপনি যেমন বলেন, ছাদে উঠা নিয়ে কথা। যে কোন উপায়ে উঠতে পারলেই হল – দড়ি, বাঁশ – যে কোন উপায়ে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এইটি যে বুঝেছে, এটুকু ঈশ্বরের দয়া। ঈশ্বরের কৃপা না হলে সংশয় আর যায় না।

“কথাটা এই – কোনরকমে তাঁর উপর যাতে ভক্তি হয় – ভালবাসা হয়। নানা খবরে কাজ কি? একটা পথ দিয়ে যেতে যেতে যদি তাঁর উপর ভালবাসা হয়, তাহলেই হল। ভালবাসা হলেই তাঁকে লাভ করা যাবে। তারপর যদি দরকার হয়, তিনি সব বুঝিয়ে দিবেন – সব পথের খবর বলে দিবেন।

ঈশ্বরের উপর ভালবাসা এলেই হল – নানা বিচারের দরকার নাই। আম খেতে এয়েছ, আম খাও; কত ডাল, কত পাতা – এ-সবের হিসাবের দরকার নাই। হনুমানের ভাব – ‘আমি বার তিথি নক্ষত্র জানি না – এক রামচিন্তা করি’।”

সংসারত্যাগ ও ঈশ্বরলাভ। ভক্তের সঞ্চয় না যদৃচ্ছালাভ?

মণি – এখন এরূপ ইচ্ছা হয় যে, কর্ম খুব কমে যায়, – আর ঈশ্বরের দিকে খুব মন দিই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা! তা হবে বইকি!

“কিন্তু জ্ঞানী নির্লিপ্ত হয়ে সংসারে থাকতে পারে।”

মণি – আজ্ঞা, কিন্তু নির্লিপ্ত হতে গেলে বিশেষ শক্তি চাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, তা বটে। কিন্তু হয়তো তুমি (সংসার) চেয়েছিলে।

“কৃষ্ণ শ্রীমতীর হৃদয়েই ছিলেন, কিন্তু ইচ্ছা হল, তাই মানুষরূপে লীলা।

“এখন প্রার্থনা করো, যাতে এ-সব কমে যায়।

“আর মন থেকে ত্যাগ হলেই হল।”

মণি – সে যারা বাহিরে ত্যাগ করতে পারে না। উঁচু থাকের জন্য একেবারেই ত্যাগ – মনের ত্যাগ ও বাহিরের ত্যাগ।

ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – বৈরাগ্য মানে কি বল দেখি?

মণি – বৈরাগ্য মানে শুধু সংসারে বিরাগ নয়। ঈশ্বরে অনুরাগ আর সংসারে বিরাগ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, ঠিক বলেছ।

“সংসারে টাকার দরকার বটে, কিন্তু উগুনোর জন্য অত ভেবো না। যদৃচ্ছালাভ – এই ভালো। সঞ্চয়ের জন্য অত ভেবো না। যারা তাঁকে মন প্রাণ সমর্পণ করে – যারা তাঁর ভক্ত, শরণাগত, – তারা ও-সব অত ভাবে না। যত্র আয় – তত্র ব্যয়। একদিক থেকে টাকা আসে, আর-একদিক থেকে খরচ হয়ে যায়। এর নাম যদৃচ্ছালাভ। গীতায় আছে।”

শ্রীযুক্ত হরিপদ, রাখাল, বাবুরাম, অধর প্রভৃতির কথা

ঠাকুর হরিপদর কথা কহিতেছেন। – “হরিপদ সেদিন এসেছিল।”

মণি (সহাস্য) – হরিপদ কথকতা জানে। প্রহ্লাদচরিত্র, শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা – এ-সব বেশ সুর করে বলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – বটে সেদিন তার চক্ষু দেখলাম, যেন চড়ে রয়েছে। বললাম, “তুই কি খুব ধ্যান করিস?” তা মাথা হেঁট করে থাকে। আমি তখন বললাম, অত নয় রে!

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর মার নাম করিতেছেন ও চিন্তা করিতেছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরবাড়িতে আরতি আরম্ভ হইল। শ্রাবণ শুক্লা দ্বাদশী। ঝুলন-উৎসবের দ্বিতীয় দিন। চাঁদ উঠিয়াছে! মন্দির, মন্দির প্রাঙ্গণ, উদ্যান, – আনন্দময় হইয়াছে। রাত আটটা হইল। ঘরে ঠাকুর বসিয়া আছেন। রাখাল ও মাস্টারও আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – বাবুরাম বলে, ‘সংসার! – ওরে বাবা!’

মাস্টার – ও শোনা কথা। বাবুরাম সংসারের কি জানে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, তা বটে। নিরঞ্জন দেখেছ, – খুব সরল!

মাস্টার – আজ্ঞা, হাঁ। তার চেহারেতেই আকর্ষণ করে। চোখের ভাবটি কেমন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – শুধু চোখের ভাব নয় – সমস্ত। তার বিয়ে দেবে বলেছিল, – তা সে বলেছে, আমায় ডুবুবে কেন? (সহাস্য) হ্যাঁগা, লোকে বলে, খেটে-খুটে গিয়ে পরিবারের কাছে গিয়ে বসলে নাকি খুব আনন্দ হয়।

মাস্টার – আজ্ঞা, যারা ওইভাবে আছে, তাদের হয় বইকি!

(রাখালের প্রতি, সহাস্যে) – একজামিন হচ্ছে – leading question.

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – মায়ে বলে, ছেলের একটা গাছতলা করে দিলে বাঁচি! রোদে ঝলসা পোড়া হয়ে গাছতলায় বসবে।

মাস্টার – আজ্ঞা, রকমারি বাপ-মা আছে। মুক্ত বাপ ছেলেদের বিয়ে দেয় না। যদি দেয় সে খুব মুক্ত! (ঠাকুরের হাস্য)।

অধরের ও মাস্টারের কালীদর্শন।
অধরের চন্দ্রনাথতীর্থ ও সীতাকুণ্ডের গল্প

শ্রীযুক্ত অধর সেন কলিকাতা হইতে আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। একটু বসিয়া কালীদর্শন জন্য কালীঘরে গেলেন।

মাস্টারও কালীদর্শন করিলেন। তৎপরে চাঁদনির ঘাটে আসিয়া গঙ্গার কুলে বসিলেন। গঙ্গার জল জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করিতেছে। সবে জোয়ার আসিল। মাস্টার নির্জনে বসিয়া ঠাকুরের অদ্ভুত চরিত্র চিন্তা করিতেছেন – তাঁহার অদ্ভুত সমাধি অবস্থা – মুহুর্মুহুঃ ভাব – প্রেমানন্দ – অবিশ্রান্ত ঈশ্বরকথাপ্রসঙ্গ – ভক্তের উপর অকৃত্রিম স্নেহ – বালকের চরিত্র – এই সব স্মরণ করিতেছেন। আর ভাবিতেছেন – ইনি কে – ঈশ্বর কি ভক্তের জন্য দেহ ধারণ করে এসেছেন?

অধর, মাস্টার, ঠাকুরের ঘরে ফিরিয়া গিয়াছেন। অধর চট্টগ্রামে কর্ম উপলক্ষে ছিলেন। তিনি চন্দ্রনাথ তীর্থের ও সীতাকুণ্ডের গল্প করিতেছেন।

অধর – সীতাকুণ্ডের জলে আগুনের শিখা জিহ্বার ন্যায় লকলক করে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এ কেমন করে হয়?

অধর – জলে ফসফরাস (phosphorus) আছে।

শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে ঘরে আসিয়াছেন। ঠাকুর অধরের কাছে তাঁর সুখ্যাতি করিতেছেন। আর বলিতেছেন, “রাম আছে, তাই আমাদের অত ভাবতে হয় না। হরিশ, লাটু, এদের ডেকে-ডুকে খাওয়ায়। ওরা হয়তো একলা কোথায় ধ্যান কচ্ছে। সেখান থেকে রাম ডেকে-ডুকে আনে।”

-১৮৮৪, ৩রা অগস্ট-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ত্রয়োবিংশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!