ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ মণিরামপুর ভক্তসঙ্গে

ঠাকুর আহারান্তে ছোট খাটটিতে একটু বসিয়াছেন, এখনও বিশ্রাম করিতে অবসর পান নাই। ভক্তদের সমাগম হইতে লাগিল। প্রথমে মণিরামপুর হইতে একদল ভক্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একজন পি. ডব্লিউ. ডি. তে কাজ করিতেন, এখন পেনশন পান। একটি ভক্ত তাঁহাদিগকে লইয়া আসিয়াছেন। ক্রমে বেলঘরে হইতে একদল ভক্ত আসিলেন। শ্রীযুক্ত মণি মল্লিক প্রভৃতি ভক্তেরাও ক্রমে আসিলেন।

মণিরামপুরের ভক্তগণ বলিতেছেন, আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, ““না, না, ও-সব রজোগুণের কথা — উনি এখন ঘুমুবেন!”

চাণক মণিরামপুর — এই কথা শুনিয়া ঠাকুরের বাল্যসখা শ্রীরামের উদ্দীপন হইয়াছে। ঠাকুর বলিতেছেন, “শ্রীরামের দোকান তোমাদের ওখানে। ও-দেশে শ্রীরাম আমার সঙ্গে পাঠশালায় পড়ত। সেদিন এখানে এসেছিল।”

মণিরামপুরের ভক্তেরা বলিতেছেন, কি উপায়ে ভগবানকে পাওয়া যায়, একটু আমাদের দয়া করে বলুন।

[মণিরামপুরের ভক্তকে শিক্ষা — সাধন-ভজন কর ও ব্যাকুল হও]

শ্রীরামকৃষ্ণ — একটু সাধন-ভজন করতে হয়।

“দুধে মাখন আছে বললেই হয় না, দুধকে দই পেতে, মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। তবে মাঝে মাঝে একটু নির্জন চাই।১ দিন কতক নির্জনে থেকে ভক্তিলাভ করে, তারপর যেখানে থাক। জুতো পায় দিয়ে কাঁটাবনেও অনায়াসে যাওয়া যায়।

“প্রধান কথা বিশ্বাস। ‘যেমন ভাব তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয়।’ বিশ্বাস হয়ে গেলে আর ভয় নাই।”

মণিরামপুর ভক্ত — আজ্ঞা, গুরু কি প্রয়োজন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — অনেকের প্রয়োজন আছে।২ তবে গুরুবাক্যে বিশ্বাস করতে হয়। গুরুকে ইশ্বরজ্ঞান করলে তবে হয়। তাই বৈষ্ণবেরা বলে, গুরু-কৃষ্ণ-বৈষ্ণব।

“তাঁর নাম সর্বদাই করতে হয়। কলিতে নাম-মাহাত্ম্য। অন্নগত প্রাণ, তাই যোগ হয় না। তাঁর নাম করে, হাততালি দিলে পাপপাখি পালিয়ে যায়।

“সৎসঙ্গ সর্বদাই দরকার। গঙ্গার যত কাছে যাবে ততই শীতল হাওয়া পাব; অগ্নির যত কাছে যাবে ততই উত্তাপ পাবে।

“ঢিমে তেতলা হলে হয় না। যাদের সংসারে ভোগের ইচ্ছা আছে তারা বলে, ‘হবে, কখন না কখন ঈশ্বরকে পাবে!’

“আমি কেশব সেনকে বলেছিলাম, ছেলেকে ব্যাকুল দেখলে বাপ তিন বৎসর আগেই তার হিস্যে ফেলে দেয়।

“মা রাঁধছে, কোলের ছেলে শুয়ে আছে। মা মুখে চুষি দিয়ে গেছে; যখন চুষি ফেলে চিৎকার করে ছেলে কাঁদে, তখন মা হাঁড়ি নামিয়ে ছেলেকে কোলে করে মাই দেয়। এই সব কথা কেশব সেনকে বলেছিলাম।

“কলিতে বলে, একদিন একরাত কাঁদলে ইশ্বর দর্শন হয়।

“মনে অভিমান করবে, আর বলবে, ‘তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ; দেখা দিতে হবে।’

“সংসারেই থাক, আর যেখানেই থাক — ঈশ্বর মনটি দেখেন। বিষয়াসক্ত মন যেমন ভিজে দেশলাই, যত ঘষো জ্বলে না। একলব্য মাটির দ্রোণ অর্থাৎ নিজের গুরুর মূর্তি সামনে রেখে বাণ শিক্ষা করেছিল।

“এগিয়ে পড়; — কাঠুরে এগিয়ে গিয়ে দেখেছিল, চন্দন কাঠ, রূপার খনি, সোনার খনি, আরও এগিয়ে গিয়ে দেখলে হীরে, মাণিক।

“যারা অজ্ঞান, তারা যেন মাটির দেওয়ালের ঘরের ভিতর রয়েছে। ভিতরে তেমন আলো নাই, আবার বাহিরের কোন জিনিস দেখতে পাচ্ছে না। জ্ঞান লাভ করে যে সংসারে থাকে সে যেন কাচের ঘরের ভিতর আছে। ভিতরে আলো বাহিরেও আলো। ভিতরের জিনিসও দেখতে পায়, আর বাহিরের জিনিসও দেখতে পায়।”

[ব্রহ্ম ও জগন্মাতা এক ]

“এক বই আর কিছু নাই। সেই পরব্রহ্ম ‘আমি’ যতক্ষণ রেখে দেন, ততক্ষণ দেখান যে, আদ্যাশক্তিরূপে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন।

“যিনিই ব্রহ্ম তিনিই আদ্যাশক্তি। একজন রাজা বলেছিল যে, আমায় এককথায় জ্ঞান দিতে হবে। যোগী বললে, আচ্ছা তুমি এককথাতেই জ্ঞান পাবে। খানিকক্ষণ পরে রাজার কাছে হঠাৎ একজন যাদুকর এসে উপস্থিত। রাজা দেখলে, সে এসে কেবল দুটো আঙুল ঘুরাচ্ছে, আর বলছে, ‘রাজা, এই দেখ, এই দেখ।’ রাজা অবাক্‌ হয়ে দেখছে।

খানিকক্ষণ পরে দেখে দুটো আঙুল একটা আঙুল হয়ে গেছে। যাদুকর একটা আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে বলছে, ‘রাজা, এই দেখ, এই দেখ।’ অর্থাৎ ব্রহ্ম আর আদ্যাশক্তি প্রথম দুটা বোধ হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর দুটা থাকে না! অভেদ! এক! যে একের দুই নাই। অদ্বৈতম্‌।”

-১৮৮৩, ১০ই জুন-

…………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাদশ অধ্যায় : নবম পরিচ্ছেদ

……………………………….
১ যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ। [গীতা, ৬।১০] ২ গুরুর প্রয়োজন –
…আচার্যবান্‌ পুরুষো বেদ…। [ছান্দোগ্যোপনিষদ্‌, ৬।১৪।২]

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!