ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সুরেন্দ্রের বাড়িতে, মনোমোহন-মন্দিরে ও রাজেন্দ্রের বাটীতে
শ্রীরামকৃষ্ণের শুভাগমন
১৮৮১, আষাঢ় মাসের একদিন
সুরেন্দ্রের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের শুভাগমন
রাম, মনোমোহন, ত্রৈলোক্য ও মহেন্দ্র গোস্বামী প্রভৃতি সঙ্গে

আজ শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসিয়াছেন। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ, আষাঢ় মাসের একদিন। সন্ধ্যা হয় হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বৈকালে শ্রীযুক্ত মনোমোহনের বাড়িতে একটু বিশ্রাম করিয়াছিলেন।

সুরেন্দ্রের দ্বিতলের বৈঠকখানার ঘরে ভক্তেরা আসিয়াছেন। মহেন্দ্র গোস্বামী, ভোলানাথ পাল ইত্যাদি প্রতিবেশীগণ উপস্থিত আছেন। শ্রীযুক্ত কেশব সেনের আসিবার কথা ছিল কিন্তু আসিতে পারেন নাই। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল ও আরও কতকগুলি ব্রাহ্মভক্ত আসিয়াছেন।

বৈঠকখানা ঘরে সতরঞ্চি ও চাদর পাতা হইয়াছে – তার উপর একখানি সুন্দর গালিচা ও তাকিয়া। ঠাকুরকে লইয়া সুরেন্দ্র ওই গালিচার উপর বসিতে অনুরোধ করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, একি তোমার কথা! এই বলিয়া মহেন্দ্র গোস্বামীর পার্শ্বে বসিলেন। যদু মল্লিকের বাগানে যখন পারায়ণ হয় শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদা যাইতেন। কয়মাস ধরিয়া পারায়ণ হইয়াছিল।

মহেন্দ্র গোস্বামী (ভক্তদের প্রতি) – আমি এঁর নিকট কয়েক মাস প্রায় সর্বদা থাকতাম। এমন মহৎ লোক আমি কখনও দেখি নাই। এঁর ভাব সকল সাধারণ ভাব নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গোস্বামীর প্রতি) – ও-সব তোমার কি কথা! আমি হীনের হীন, দীনের দীন; আমি তাঁর দাসানুদাস; কৃষ্ণই মহান।

“যিনি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। দূর থেকে দেখলে সমুদ্র নীলবর্ণ দেখায়, কাছে যাও কোন রঙ নাই। যিনিই সগুণ, তিনিই নির্গুণ; যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।

“শ্রীকৃষ্ণ ত্রিভঙ্গ কেন? রাধার প্রেমে।

“যিনিই ব্রহ্ম তিনিই কালী, আদ্যাশক্তি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। যিনি কৃষ্ণ তিনিই কালী।

“মূল এক – তাঁর সমস্ত, লীলা।”

[ঈশ্বরদর্শনের উপায় ]

তাঁকে দর্শন করা যায়। শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধিতে দর্শন করা যায়। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে মন মলিন হয়।

“মন নিয়ে কথা। মন ধোপা ঘরের কাপড়; যে রঙে ছোপাবে, সেই রঙ হবে! মনেতেই জ্ঞানী, মনেতেই অজ্ঞান। অমুক লোক খারাপ হয়ে গেছে অর্থাৎ অমুক লোকের মনে খারাপ রঙ ধরেছে।”

শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্ত এইবার আসিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

সুরেন্দ্র মালা লইয়া ঠাকুরকে পরাইতে আসিলেন। তিনি মালা হাতে করিয়া লইলেন – কিন্তু দূরে নিক্ষেপ করিয়া একপাশে রাখিয়া দিলেন।

সুরেন্দ্র অশ্রুপূর্ণ লোচনে পশ্চিমের বারান্দায় গিয়া বসিলেন; সঙ্গে রাম ও মনোমোহন প্রভৃতি। সুরেন্দ্র অভিমানে বলিতেছেন; – আমার রাগ হয়েছে; রাঢ় দেশের বামুন এ-সব জিনিসের মর্যাদা কি জানে! অনেক টাকা খরচ করে এই মালা; ক্রোধে বললাম সব মালা আর সকলের গলায় দাও। এখন বুঝতে পারছি আমার অপরাধ; ভগবান পয়সার কেউ নয়; অহংকারেরও কেউ নয়! আমি অহংকারী, আমার পূজা কেন লবেন। আমার বাঁচতে ইচ্ছা নাই।

বলিতে বলিতে অশ্রুধারা গণ্ড বহিয়া পড়িতে লাগিল ও বুক ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

এদিকে ঘরের মধ্যে ত্রৈলোক্য গান গাহিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছেন। যে মালা ফেলিয়া দিয়াছিলেন, সেই মালা তুলিয়া গলায় পড়িলেন। এক হাতে মালা ধরিয়া, অপর হাতে দোলাতে দোলাতে গান ও নৃত্য করিতেছেন। –

হৃদয় পরশমনী আমার –

আখর দিতেছেন –

(ভূষণ বাকি কি আছে রে!)
(জগৎ-চন্দ্র-হার পরেছি!)

সুরেন্দ্র আনন্দে বিভোর – ঠাকুর গলায় সেই মালা পরিয়া নাচিতেছেন! মনে মনে বলিতেছেন, ভগবান দর্পহারী। কিন্তু কাঙালের অকিঞ্চনের ধন!

শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে গান ধরিলেন:

যাদের হরি বলতে নয়ন ঝুরে
তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
(যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে)
(যারা আপনি মেতে জগৎ মাতায়)
(যারা আচণ্ডালে কোল দেয়)
(যারা ব্রজের কানাই বলাই)

অনেকগুলি ভক্ত ঠাকুরের সঙ্গে নৃত্য করিতেছেন।

সকলে উপবিষ্ট হইলেন ও সদালাপ করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সুরেন্দ্রকে বলিতেছেন, “আমায় কিছু খাওয়াবে না?”

এই বলিয়া গাত্রোত্থান করিয়া অন্তঃপুরে গমন করিলেন। মেয়েরা আসিয়া সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া অতি ভক্তভরে প্রণাম করিলেন।

আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিলেন।

শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন শুভাগমন করেন ‘আষাঢ় মাসের একদিন’ ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে তখন শ্রীযুক্ত কেশবের আসিবার কথা ছিল – কিন্তু তিনি আসিতে পারেন নাই। তিনি প্রথম পুত্র ও দ্বিতীয় কন্যার বিবাহ দিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন।

১লা শ্রাবণ, ১৫ই জুলাই, ১৮৮১ (শুক্রবার), কেশব তাঁহার জামাতা কুচবিহারের মহারাজার জাহাজে (Steam Yacht) করিয়া অনেক ব্রাহ্মভক্ত লইয়া কলিকাতা হইতে সোমড়া পর্যন্ত বেড়াইয়াছিলেন।১ পথে দক্ষিণেশ্বরে জাহাজ থামাইয়া পরমহংসদেবকে তুলিয়া লইলেন, সঙ্গে হৃদয়।

জাহাজে কেশব ত্রৈলোক্য প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তগণ, কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ, নগেন্দ্র প্রভৃতি।

নিরাকার ব্রহ্মের কথা কহিতে কহিতে শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হইলেন। শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল গান গাহিতেছেন ও খোল, করতাল বাজিতেছে। সমাধিভঙ্গের পর ঠাকুর গাহিতেছেন:

শ্যামা মা কি কল করেছে।
চৌদ্দপুয়া কলের ভিতরি কত রঙ্গ দেখাতেছে।

জাহাজ ফিরিবার সময় ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে নামাইয়া দেওয়া হইল। কেশব আহিরীটোলা ঘাটে নামিলেন – মস্‌জিদবাড়ি স্ট্রীট দিয়া পদব্রজে শ্রীযুক্ত কালীচরণ ব্যানার্জীর বাড়িতে নিমন্ত্রণে যাইবেন।

………………………………………
১ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্র এই বিবরণ মাস্টারকে দু-তিন মাস পরে বলিয়াছিলেন। বলিবার কয়েক মাস পরে মাস্টার ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন, ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!