ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীযুক্ত রাখালের জন্য চিন্তা – যদু মল্লিক – ভোলানাথের এজাহার

গান সমাপ্ত হইলে মুখুজ্জেরা গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুরও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলেন। কিন্তু ভাবাবিষ্ট। ঘরের বারান্দায় আসিয়া একেবারে সমাধিস্থ হইয়া দণ্ডায়মান। বারান্দায় অনেকগুলি আলো জ্বলিতেছে। বাগানের দ্বারবান ভক্ত লোক। ঠাকুরকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করিয়া সেবা করান। ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। দ্বারবানটি আসিয়া ঠাকুরকে পাখার হাওয়া করিতেছেন; বড় হাত পাখা।

বাগানের সরকার শ্রীযুক্ত রতন আসিয়া প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। নারায়ণ! নারায়ণ! – এই নাম উচ্চারণ করিয়া তাহাদের সম্ভাষণ করিলেন।

ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সদর ফটকের কাছে আসিয়াছেন। ইতিমধ্যে মুখুজ্জেরা ফটকের কাছে অপেক্ষা করিতেছেন।

অধর ঠাকুরকে খুঁজিতেছিলেন।

মুখুজ্জে (সহাস্যে) – মহেন্দ্রবাবু পালিয়ে এসেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মুখুজ্জের প্রতি) – এর সঙ্গে তোমরা সর্বদা দেখা করো, আর কথাবার্তা কয়ো।

প্রিয় মুখুজ্জে (সহাস্যে) – ইনি এখন আমাদের মাস্টারি করবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – গাঁজাখোরের স্বভাব গাঁজাখোর দেখলে আনন্দ করে। আমির এলে কথা কয় না। কিন্তু যদি একজন লক্ষ্মীছাড়া গাঁজাখোর আসে, তবে হয়তো কোলাকুলি করবে। (সকলের হাস্য)

ঠাকুর উদ্যান-পথ দিয়া পশ্চিমাস্য হইয়া নিজের ঘরের অভিমুখে আসিতেছেন। পথে বলিতেছেন – “যদু খুব হিঁদু। ভাগবত থেকে অনেক কথা বলে।”

মণি কালীমন্দিরে আসিয়া প্রণামাদি করিয়া চরণামৃতপান করিতেছেন। ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত – মাকে দর্শন করিবেন।

রাত প্রায় নয়টা হইল। মুখুজ্জেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। অধর ও মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর অধরের সহিত শ্রীযুক্ত রাখালের কথা কহিতেছেন।

রাখাল বৃন্দাবনে আছেন – বলরামের সঙ্গে। পত্রে সংবাদ আসিয়াছিল তাঁহার অসুখ হইয়াছে। দুই-তিনদিন হইল ঠাকুর রাখালের অসুখ শুনিয়া এত চিন্তিত হইয়াছিলেন যে, মধ্যাহ্নের সেবায় সময় ‘কি হবে!’ বলিয়া হাজরার কাছে বালকের ন্যায় কেঁদেছিলেন। অধর রাখালকে রেজিস্টারি করিয়া চিঠি লিখিয়াছিলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার পান নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – নারাণ চিঠি পেলে আর তুমি চিঠির জবাব পেলে না?

অধর – আজ্ঞা, এখনও পাই নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর মাস্টারকে লিখেছে।

ঠাকুরের চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবার কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে, ভক্তদের প্রতি) – যদু বলছিল, এক টাকার জায়গা হতে বেশ দেখা যায় – সস্তা।

“একবার আমাদের পেনেটী নিয়ে যাবার কথা হয়েছিল – যদু আমাদের চলতি নৌকায় চড়তে বলেছিল। (সকলের হাস্য)

“আগে ঈশ্বরের কথা একটু একটু শুনত। একটি ভক্ত ওর কাছে যাতায়াত করত – এখন আর তাকে দেখতে পাই না। কতকগুলি মোসাহেব ওর কাছে সর্বদা থাকে – তারাই আরও গোল করেছে।

“ভারী হিসাবী – জেতে মাত্রই বলে কত ভাড়া – আমি বলি তোমার আর শুনে কাজ নেই। তুমি আড়াই টাকা দিয়ো – তাইতে চুপ করে থাকে আড়াই টাকাই দেয়।” (সকলের হাস্য)

ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণপ্রান্তে পাইখানা প্রস্তুত হইয়াছে। তাই লইয়া যদু মল্লিকের সহিত বিবাদ চলিতেছে। পাইখানার পাশে যদুর বাগান।

বাগানের মুহুরী শ্রীযুক্ত ভোলানাথ বিচারপতির কাছে এজাহার দিয়াছেন। এজাহার দেওয়ার পর হইতে তাঁহার বড় ভয় হইয়াছে। তিনি ঠাকুরকে জানাইয়াছিলেন। ঠাকুর বলিয়াছেন – অধর ডেপুটি ম্যাহিস্ট্রেট, সে আসিলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করো। শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তী ভোলানাথকে সঙ্গে করিয়া ঠাকুরের কাছে আনিয়াছেন ও সমস্ত বলিতেছেন – ‘এর এজাহার দিয়ে ভয় হয়েছে’ ইত্যাদি।

ঠাকুর চিন্তিতপ্রায় হইয়া উঠিয়া বসিলেন ও অধরকে সব কথা বলিতে বলিলেন। অধর সমস্ত শুনিয়া বলিতেছেন – ও কিছুই না, একটু কষ্ট হবে। ঠাকুরের যেন গুরুতর চিন্তা দূর হইল।

রাত হইয়াছে। অধর বিদায় গ্রহণ করিবেন, প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – নারাণকে এনো।

-১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বর-

…………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : দশম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!