ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৪, ২৫শে জুন
তীর্থযাত্রা ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ – আচার্যের তিন শ্রেণী

পণ্ডিত – মহাশয়ের তীর্থে কতদূর যাওয়া হয়েছিল?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, কতক জায়গা দেখেছি। (সহাস্যে) হাজরা অনেক দূর গিছিল; আর খুব উঁচুতে উঠেছিল। হৃষীকেশ গিছিল। (সকলের হাস্য) আমি অত দূর যাই নাই, অত উঁচুতেও উঠি নাই।

“চিল শকুনিও অনেক উচ্চে উঠে, কিন্তু নজর ভাগাড়ে। (সকলের হাস্য) ভাগাড় কি যান? কামিনী ও কাঞ্চন।

“যদি এখানে বসে ভক্তিলাভ করতে পার, তাহলে তীর্থে যাবার কি দরকার? কাশী গিয়ে দেখলাম, সেই গাছ! সেই তেঁতুলপাতা!

“তীর্থে গিয়ে যদি ভক্তিলাভ না হল, তাহলে তীর্থ যাওয়ার আর ফল হল না। আর ভক্তিই সার, একমাত্র প্রয়োজন। চিল শকুনি কি যান? অনেক লোক আছে, তারা লম্বা লম্বা কথা কয়। আর বলে যে, শাস্ত্রে যে সকল কর্ম করতে বলেছে, আমারা অনেক করেছি। এদিকে তাদের মন ভারী বিষয়াসক্ত – টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, দেহের সুখ, এই সব নিয়ে ব্যস্ত।”

পণ্ডিত – আজ্ঞে, হাঁ। মহাশয়, তীর্থে যাওয়া যা, আর কৌস্তুভ মণি ফেলে অন্য হীরা মাণিক খুঁজে বেড়ানও তা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর তুমি এইটি জেনো, হাজার শিক্ষা দাও – সময় না হলে ফল হবে না। ছেলে বিছানায় শোবার সময় মাকে বললে, ‘মা, আমার যখন হাগা পাবে, তখন তুমি আমায় উঠিও।’ মা বললে, ‘বাবা, হাগাই তোমাকে উঠাবে, এজন্য তুমি কিছু ভেবো না।’ (হাস্য)

সেইরূপ ভগবানের জন্য ব্যাকুল হওয়া ঠিক সময় হলেই হয়।ম”

[পাত্রাপাত্র দেখে উপদেশ – ঈশ্বর কি দয়াময়? ]

“তিনরকম বৈদ্য আছে।

“একরকম – তারা নাড়ী দেখে ঔষধ ব্যবস্থা করে চলে যায়। রোগীকে কেবল বলে যায়, ঔষধ খেয়ো হে। এরা অধম থাকের বৈদ্য।

“সেইরূপ কতকগুলি আচার্য উপদেশ দিয়ে যায়, কিন্তু উপদেশ লোকের ভাল হল কি মন্দ হল তা দেখে না। তার জন্য ভাবে না।

“কতকগুলি বৈদ্য আছে, তারা ঔষধ ব্যবস্থা করে রোগীকে ঔষধ খেতে বলে। রোগী যদি খেতে না চায়, তাকে অনেক বুঝায়। এরা মধ্যম থাকের বৈদ্য। সেইরূপ মধ্যম থাকের আচার্যও আছে। তাঁরা উপদেশ দেন, আবার অনেক করে লোকদের বুঝান যাতে তারা উপদেশ অনুসারে চলে। আবার উত্তম থাকের বৈদ্য আছে। মিষ্ট কথাতে রোগী যদি না বুঝে, তারা জোর পর্যন্ত করে। দরকার হয়, রোগীর বুকে হাঁটু দিয়ে রোগীকে ঔষধ গিলিয়ে দেয়। সেইরূপ উত্তম থাকের আচার্য আছে। তাঁরা ঈশ্বরের পথে আনবার জন্য শিষ্যদের উপর জোর পর্যন্ত করেন।”

পণ্ডিত – মহাশয়, যদি উত্তম থাকের আচার্য থাকেন, তবে কেন আপনি সময় না হলে জ্ঞান হয় না, এ-কথা বললেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সত্য বটে। কিন্তু মনে কর, ঔষধ যদি পেটে না যায় – যদি মুখ থেকে গড়িয়ে যায়, তাহলে বৈদ্য কি করবে? উত্তম বৈদ্যও কিছু করতে পারে না।

“পাত্র দেখে উপদেশ দিতে হয়। তোমরা পাত্র দেখে উপদেশ দাও না। আমার কাছে কেহ ছোকরা এলে আগে জিজ্ঞাসা করি, ‘তোর কে আছে?’ মনে কর, বাপ নাই; হয়তো বাপের ঋণ আছে, সে কেমন করে ঈশ্বরে মন দিবেক? শুনছো বাপু?”

পণ্ডিত – আজ্ঞা হাঁ, আমি সব শুনছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – একদিন ঠাকুরবাড়িতে কতকগুলি শিখ সিপাহি এসেছিল। মা-কালীর মন্দিরের সম্মুখে তাদের সঙ্গে দেখা হল। একজন বললে, ‘ঈশ্বর দয়াময়।’ আমি বললাম, ‘বটে? সত্য নাকি? কেমন করে জানলে?’ তারা বললে, ‘কেন মহারাজ, ঈশ্বর আমাদের খাওয়াচ্ছেন, – এত যত্ন করছেন।’ আমি বললাম, ‘সে কি আশ্চর্য? ঈশ্বর যে সকলের বাপ! বাপ ছেলেকে দেখবে না তো কে দেখবে? ও-পাড়ার লোক এসে দেখবে নাকি?’

নরেন্দ্র – তবে ঈশ্বরকে দয়াময় বলব না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁকে কি দয়াময় বলতে বারণ করছি? আমার বলবার মানে এই যে ঈশ্বর আমাদের আপনার লোক, পর নন।

পণ্ডিত – কথা অমূল্য!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোর গান শুনছিলুম – কিন্তু ভাল লাগল না। তাই উঠে গেলুম। বললুম, উমেদারী অবস্থা – গান আলুনী বোধ হল।

নরেন্দ্র লজ্জিত হইলেন, মুখ ঈষৎ আরক্তিম হইল। তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!