ভবঘুরেকথা
গুপ্তসংঘ

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘গুপ্তসংঘ: দুই’

সংঘের লজে প্রবেশের জন্য প্রত্যেক সদস্যদের একটি নাম ও কোডা নাম্বার থাকতো। এই কোড বলতে পারলেই লজে প্রবেশ করতে পারতো। কোড ভুল করলে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হতো বলেও জানা যায়। তারা যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য নিজেদের মধ্য গোপন ভোটের ব্যবস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দিতো।

তাদের প্রতীকের মধ্যে ইংরেজি ‘জি’ অক্ষরটি দেখা যায়। এই জি গড-জ্যাওমেট্রি নাকি জিওগ্রাফি তা সঠিক করে বলা যায় না। তবে এই প্রতীকে ব্যবহৃত কম্পাস ও বর্গ দিয়ে তারা এ জগৎ সৃষ্টির স্থপতিকে নির্দেশ করে বলে ধারণা করা হয়।

১৭৫০ সাল থেকে সংঘের সদস্যদের তিন স্তরে বিন্যাস করা হয়-

প্রথম ডিগ্রি: নব্য যোগদানকারী শিক্ষানবিশরা প্রথম স্তরের সদস্য বলে বিবেচিত।

দ্বিতীয় ডিগ্রি: দ্বিতীয় স্তরের সদস্য যারা মূলত ফেলো ক্রাফট। সদস্যদের মধ্যে যাদের ম্যাসনারি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণাপ্রাপ্ত তারা এই স্তরের সদস্য বলে বিবেচিত।

তৃতীয় ডিগ্রি: ম্যাসনারি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা এবং নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করলে তখন সদস্যরা মাস্টার ম্যাসন হিসেবে পরিচিত হয়। তারা এই স্তরের জন্য নির্বাচিত হয়।

সদস্য নির্বাচনে তারা সংঘের কোনো এক বা একাধিক ফ্রিমেসনরির সুপারিশকে প্রাধান্য দিয়। সংঘের তথ্য গোপন রাখতে পারবে এমন তরুণরা অগ্রাধিকার পায় সকল সময়।

তারা তাদের অনুষ্ঠানগুলো বেশ রীতিনীতি মনে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করতো। এতে তারা সংঘের স্তরভেদে বিশেষ ধরনের পোষাক ধারণ করে। সাথে নানা অলঙ্কার পরিধান করে। এর মধ্যে ব্যাজ, পিন, মুকুট, লকেট, প্রতীক প্রধান। তাদের পোশাকে সাদা, নীল, স্বর্ণালী, লাল রঙের ব্যবহার বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

নিজেদের মধ্যে পরিচয়ের সময় এমন বিশেষ কিছু ভঙ্গি বা মুদ্রা ব্যবহার করে যে, কথা না বলেও একে অন্যের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারে।

তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন জ্যামিতিক চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। এরমধ্যে কম্পাস ও বর্গ বেশি প্রাধান্য পায়। এসব চিহ্ন দিয়ে তারা তাদের আরাধ্য দেবতাই এই মহাবিশ্বের মহান স্থপতি বলে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।

বর্তমানেও ফ্রিম্যাসন্সরা বহাল তবিয়তে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তবে তারা এখন তাদের কার্যক্রম স্থাপত্যকলা থেকে সামাজিক কার্যে পরিবর্তন করেছে। এখনো তাদের সাথে যুক্ত হতে নানা প্রতিজ্ঞা ও ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হয়।

বাইরে থেকে তাদের উন্নত বিদ্যার অধিকারী কারিগর শ্রেণী মনে হলেও অভ্যন্তরে তারা শয়তানের পূজারি বলে প্রচারিত আছে। সাধনায় শক্তি অর্জনের জন্য তারা মানুষের রক্ত পর্যন্ত পান করে বলেও জনশ্রুতি আছে। আনুষ্ঠানিকা তারা প্রকাশ্যে পালন করলেও। তাদের সাধন-ভজনে সর্বকালেই কঠিন গোপনীয়তার মাঝে পালন করে থাকে তারা। এবং সদস্যরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেসব বাইরে প্রচার না করার জন্য।

বহুবার সন্দেহের তীর তাদের উপর উঠলেও তা সরাসরি প্রমাণ করা যায় নি। অনেকে বলে, ফ্রিম্যাসন্সরা মূলত ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে যাওয়া একদল কারিগরের সংঘ। সম্ভবত ব্যাবিলন বা মিশরে স্থাপত্য নির্মাণে তাদেরকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা ইউরোপে স্থায়ী হয়। যারা নিজেদের মধ্যে তাদের কাজের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য কোড ভাষার ব্যবহার করতো।

তাদের নিজেেদর মধ্যে করমর্দনের বেশকিছু বিশেষ প্রতীক ছিল। এই করমর্দনের মধ্য দিয়েই সদস্যরা বুঝে যেতো তারা কোন প্রসঙ্গে মিলিত হয়েছে।

বিদেশীদের কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই তারা এই কোড ভাষার প্রচলন করে। পরবর্তীতে তাদের আকর্ষণীয় এবং ইউরোপের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নতুন শৈলীর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য তাদেরকে বিশেষভাবে পরিচিতি দেয়। যেহেতু তারা ক্রীতদাস হিসেবে নয় স্বাধীন মানুষ হিসেবে ইউরোপ গিয়েছিল এবং নিজেরাই নিজেদের পছন্দ মতো কাজ করতো তাই তারা পরিচিতি পায় ফ্রিম্যান বা ফ্রিম্যাসন্সর নামে।

কিন্তু চার্চ ও সমাজের অন্যান্যদের কাছ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে তারা তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা করতো। পরবর্তীতে তাদের সাথে বিদেশীরাও যোগ দিলে তারা চার্চের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। সেসময় থেকেই তারা শয়তানের উপাসক হয়ে উঠে। যদিও এসব কথার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় লেখা হয়েছে, “ফ্রিম্যাসনরি হলো একটি সংঘ। মধ্যযুগে ক্যাথিড্রাল তৈরি এবং পাথরের কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের দিয়ে সংগঠিত হয়েছিল। ১৭১৭ সালে যুক্তরাজ্যে এই সংঘ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। ১৭৭৫ সালে লন্ডনে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়।

…ফ্রিম্যাসনরির কর্মকাণ্ড প্রচলিত অনেক ধর্ম থেকে ভিন্ন-অনেকক্ষেত্রে বিপরীত। ফ্রিম্যাসনরি কোনো খ্রিষ্টীয় প্রতিষ্ঠান নয়। একটি ধর্মের বিভিন্ন উপাদান ফ্রিম্যাসনরিতে রয়েছে। ফ্রিম্যাসনরি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, দাতব্য কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়।

…এটি প্রধানত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সংঘ। সংঘের সদস্যরা ঈশ্বর–বিশ্বাসী এবং তাঁরা মনে করেন আত্মা অমর। সংঘের সভ্যরা যেখানে মিলিত হন, তাকে ‘লজ’ বলা হয়।”

তবে ফ্রিম্যাসন্সরা আজো সন্দেহের বাইরে নয়। বিশ্বে ঘটে যাওয়া বহু ষড়যন্ত্রের সাথে তাদের নাম জড়িয়ে আছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বিশ্লেষকরা বলেন, তারা বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সরকারের সাথে যোগসাজস করে নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে চলছে এখনো।

স্কাল এন্ড বোনস

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি গুপ্তসংঘের কথা বহুকাল ধরে প্রচারিত। এই গুপ্তসংঘের নাম ‘দ্য অর্ডার অব স্কাল এন্ড বোনস’। যতদূর জানা যায়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রদের সবচেয়ে প্রাচীন গুপ্তসংঘ। ১৮৩২ সালে এই সংঘ গঠিত হয়।

প্রথমদিকে এর সদস্য নির্বাচনে পারিবারিক আভিজাত্যকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হতো। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তারা দীর্ঘদিন ধরে এই সংঘ পরিচালনা করে আসছে। জানা যায়, সংঘের জন্য তারা যাদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করতো। তারা বাধ্য হতো সংঘে যোগ দিতে। এজন্য প্রয়োজনে চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতেও তারা পিছপা হতো না। এই সংঘের মূল নাম ছিল ‘ব্রাদারহুড অব ডেথ’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টম্ব’ নামে একটা আলাদা বিশাল কক্ষ এর সদস্যদের মিলনকেন্দ্র বলে বিবেচিত। সেটাতে এখনো বাইরের কারো প্রবেশাধিকার নেই। বলা হয়ে থাকে, ভয়ঙ্কর সব জিনিস দিয়ে কেন্দ্রটিকে বিশেষ আবহ দেয়া হয়েছে। এর সাজসজ্জা দেখলে পিলে চমকে যায়। প্রলচিত আছে, এখনো প্রতি বৃহস্পতি ও রবিবার সদস্যরা এই ভবনে মিলিত হয়। এই মিলন অনুষ্ঠানটি ‘ম্যাসনিক’ নামে পরিচিত।

অনেকে একে ইলুমিনাতির একটি অঙ্গ সংঘও বলে থাকেন। তাদের মতে, এই সংঘ নেতৃত্বের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্যই সদস্যদের আত্মার শক্তিকে উজ্জীবিত করে বিশেষ গোপনীয় রীতিনীতির মধ্য দিয়ে। এজন্য তারা কালাজাদুর আশ্রয় নেয়। তারাই গোপনে আমেরিকার নেতৃত্বে কলকাঠি নাড়ছে।

অপশক্তির কাছ থেকে শক্তি অর্জন করে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে তারা মিলিত হয়। তবে তারা প্রকাশ্যে তা করতে চায় না। তারা চায় তাদের হয়ে অন্যরা পরিচালনা করবে। আর পেছনে থেকে তারা সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে।

প্রতিবছর তারা ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পনের জন্য সদস্যকে সংঘে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্বাচিত করে। যারা তাদের কার্যক্রমে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর সদস্য তালিকায় আমেরিকার বহু খ্যাতিমান ও প্রভাশালীর নাম পাওয়া যায়। এমনকি বেশ কয়েকজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামও আছে এই তালিকায়।

নিজেদের কার্যক্রমের কঠোর গোপনীয়তা পালনই তাদেরকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। কথিত আছে, তারা খ্যাতিমান, প্রভাবশালী, অপার্থিব ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের মাথার খুলি ও হাড় সংরক্ষণ করে। তা নিয়ে নানা আচাড়-ক্রিয়া করে থাকে। অনেকে বলেন, নতুন সদস্যদের সাহসের পরীক্ষা দিতে বিশেষ রাতে কবরস্থান থেকে মৃতের মাথার-খুলি হাড় সংগ্রহ করে এনে সংঘে উপস্থাপন করতে হয়।

অনেকে বলেন, বিশেষ রাতে সংঘের সদস্যরা কবরস্থানে বা বিশেষ জায়গায় সংরক্ষিত খুলি ও হাড়ে চুম্বন খেয়ে আনুষ্ঠানিতা শুরু করে। তার পর সেই খুলি ও হাড়কে নিয়ে চলে নানান ক্রিয়া; যা তারা সদস্য ব্যতিত অন্য সকলের কাছেই গোপন রেখে আসছে শতাব্দীর বেশি সময় ধরে।

আবার অনেকে বলেন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র খবরে আসার জন্য বিভিন্ন সময় অতিরঞ্জিত এসব গল্প বানিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু গল্প-সাহিত্য-প্রামান্য ছবি তৈরি হয়েছে। এতে করেই এসব খরব রটে গেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রচারের জন্য এসব খবরকে বাহাবা দিতেই টুম্ব সংরক্ষণ করে আসছে।

তারা বিশ্বাস করে একবার যে এর সদস্য হয়েছে সে আজীবন এর সদস্যই থাকবে। সংঘের সকল সদস্য পরিচিতি পায় ‘বোনস ম্যান’ হিসেবে। তারা বলে ‘ওয়ানস এ বোনস ম্যান, অলওয়েজ এ বোনস ম্যান’। দলের কাছে বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য তাদের রক্ত পান, নগ্ন হয়ে কফিনে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জনও করতে হয় বলে জনশ্রুতি আছে।

সাধন-ভজনের কিছু রীনীতি নিয়ে তারা বারবার সমালোচার মুখোমুখি হয়েছে। সেসব সময় সময় আদালত পর্যন্ত গড়ালেও প্রভাবশালী সদস্যদের হস্তক্ষেপে তা বেশিদূর এগোয়নি কখনোই।

অনেকে বলেন, তাদের নিজস্ব একটি দ্বীপ আছে, সেখানে বিশেষ দিনে সদস্যরা মিলিত হয়। আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি সেখানে বেশকিছু গোপনীয় সাধন-ভজনও তারা করে থাকে। দ্বীপটি ডিয়ার আইল্যান্ড নামে পরিচিত।

এ সংঘের প্রতীক অনেকটা বিপদ চিহ্নের মতোই একটা মানুষের খুলি ও তার পেছনে গুণ চিহ্নের মতো রাখা দুটি হাড়। আর চিনে লেখা ইংরেজিতে ‘থ্রি টু টু’ নাম্বার। এই থ্রি টু টু-র অর্থ বা এটি কেনো ব্যবহৃত হয়েছে তার সঠিক অর্থ এখনো কেউ প্রকাশ করেনি।

প্রচলিত আছে আমেরিকার সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থাও এই সংঘের সদস্যরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও গোয়েন্দা সংস্থা সেটি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এরপরও আমেরিকা জুড়ের ক্ষমতার পেছনের যে ষড়যন্ত্র তার সাথে এই সংঘের নাম এসেছে বহুবার।

তবে যাদের ঘিরে এত সব কথা-এতো সব আলোচনা, তাদের সদস্যরা এসব কখনো স্বীকার করেনি। তাদের অনেকের মতে, এটি কেবলই একটি ছাত্র সংগঠন। নতুন ও প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠন ছাত্রকল্যাণ ও মিলনমেলার জন্যই প্রতিষ্ঠিত।

আবার অনেকে বলেন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র খবরে আসার জন্য বিভিন্ন সময় অতিরঞ্জিত এসব গল্প বানিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু গল্প-সাহিত্য-প্রামান্য ছবি তৈরি হয়েছে। এতে করেই এসব খরব রটে গেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রচারের জন্য এসব খবরকে বাহাবা দিতেই টুম্ব সংরক্ষণ করে আসছে।

রসিক্রুসিয়ান

প্রতিষ্ঠাকালে ইলুমিনাতির যে উদ্দেশ্য ছিল তার ঠিক বিপরীত মতবাদের আরেকটি সংঘের ছিল রসিক্রসিয়ান। এটি বেশ প্রাচীন সংঘ বলে বিবেচিত। রসিক্রুসিয়ানদের বিশ্বাস আর ক্রিয়া ছিল মূলত জাদুবিদ্যা নিয়ে। তারা বিশ্বাস করতো জাদুবিদ্যায় তারা সকল কিছু করতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনেকে বলেন, একদল জার্মান প্রটেস্ট্যান্ট পনের শতকের দিকে এর প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রাপ্ত প্রাচীন কিছু নথির ভিত্তিতে বলা হয়, একজন রহস্যময় আলকেমিস্ট পৃথিবীর নানা স্থানে ঘুরে গুপ্তবিদ্যা অর্জন করে ইউরোপে স্থায়ী হন। তিনিই খুব গোপনীয়তা রক্ষা করে ইউরোপে তার বিশেষ মতের বিকাশ ঘটায়।

অল্প সময়ে তার সাথে জুড়ে যায় বেশকিছু মানুষ। কারণ সকলেই তখন চার্চের বিরুদ্ধে নতুন কিছু করার চিন্তায় রত ছিল। তারা গুপ্ত বিদ্যার নানা উপাচার করে নিজেদের আত্মাকে শক্তিশালী করতে পারতো বলে প্রচার হয়ে যায়। যদিও তাদের শনাক্ত করা চার্চের পক্ষে ছিল বেশ কঠিন।

কারণ তারা এতোটাই গোপণীয়তা রক্ষা করে সেসব করতো যে তাদের নিয়ে সমাজ গল্প প্রচারিত থাকলেও তাদের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা সেটা নিয়েই প্রশ্ন ছিল। তবে জাদুবিদ্যা বা কালাজাদুর চর্চা করতো বলে লোকে তাদের ভয় পেত এবং তাদের সংস্পর্শে আসতে চাইতো না। এও শোনা যায় এই সংঘ পরবর্তীতে ইউরোপের রাজনীতিকে প্রভাবিত করারও চেষ্টা করে।

হারমেটিক অর্ডার অব দা গোল্ডেন ডান

উইলিয়াম ওয়েইন ওয়েস্টকোট, ডক্টর উইলিয়াম রবার্ট উডম্যান ও স্যামুয়েল লিডেল ম্যাকগ্রেগর ম্যাদারসমের মতো প্রভাবশালী ম্যাসনত্রয় একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। তারা এর নামকরণ করেন ‘হারমেটিক অর্ডার অব দা গোল্ডেন ডান’।

এই সংঘকে অনেকে গুপ্তসংঘগুলোর মাঝে আন্ত যোগাযোগ স্থাপনকারী গুপ্তদল বলেও চিহ্নিত করেন। সেকারণে তারা একই সাথে বেশ কয়েকটি গুপ্তসংঘের সদস্য হতে পারে। তারা জাদুবিদ্যায় আত্মার শক্তিকে জাগ্রত করে সকল কিছু নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বলে জানা যায়।

অনেকে বলেন, তারা প্রাচীন অনেকগুলো গুপ্তসংঘ এমনকি খ্রিষ্ট ধর্ম, ক্বাবালা, হার্মেটিসিজ্‌ম, প্রাচীন মিশরীয় মতবাদ, আলকেমি ইত্যাদি থেকে তাদের নীতিমালা প্রণয়ন করে।

অর্ডো টেমপ্লিস ওরিয়েন্টিস

দি অর্ডো নামে পরিচিত এই সংঘের কার্যক্রম অনেকটাই ম্যাসনারিদের মতোই। বলা হয়ে থাকে, এলিস্টার ক্রোওলির নেতৃত্বে সংঘটি থেলেমা নামক এই নীতি প্রবর্তন করেন। যার প্রতিপাদ্য ছিল- “ভালোবাসাই হলো আইন। সবকিছু ভালোবাসারই অধীন। সেটা মনে রেখে তুমি যা খুশি তাই করো, সেটাই আইন।”

তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে এই সংঘও বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল বলে প্রচারিত আছে। পর্যায় ক্রমে স্তর পেরিয়ে শীর্ষে পৌঁছানোই নিয়ম।

আত্মাকে উন্নত করতে এরাও নানা ধরনের গোপনীয় রীতিনীতি পালন করতো। দুনিয়াব্যাপী তাদের সদস্য ছড়িয়ে আছে বলে তারা দাবী করে।

দ্য নাইটস টেম্পেলার

এই গুপ্তসংঘ মূলত বারো শতকের একটি ধর্মীয় সৈন্যদল। ধর্মের বিপরীতে কেউ কাজ বা ক্রিয়া করলে অত্যন্ত গোপনে তাদের চিহ্নিত করে নির্মম শাস্তি প্রদান করতো। তাদের সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে পরবর্তীতে তাদের প্রতীক ও নাম ব্যবহার করে ম্যাসনিকরা একটি সংঘ গড়ে তুলে বলে কথিত আছে।

তারাও গুপ্তসংঘ হিসেবে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। মূলত তারাও তাদের মতের বিপরীতে গেলে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার বিধানে বিশ্বাস করে।

এছাড়াও ইউনিফিকেশন অব ডেথ বা ব্লাক হ্যান্ড, হাসাসিন, দ্য বিল্ডারবার্গ গ্রুপ, অরিডো টেম্পলি ওরিয়েন্টালিস, অর্ডার অব দা সোলার টেম্পল ইত্যাদি গুপ্তসংঘের নামের কথা বলা যায়। যদিও বিশ্বব্যাপী এরকম গুপ্তসংঘের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না।

তবে আত্মার অপার্থিব শক্তি বিকাশের মাধ্যমে যে সকল গুপ্তসংঘ পরিচাললিত হতো বা হয় বলে বিবেচিত; তাদের মধ্যে কয়েকটি অভিজাত সংঘের কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। যার সাথে যুক্ত বিশ্বের বহু স্বনামধন্য, খ্যাতনামা, প্রভাবশালী, জনপ্রিয়, আলোচিত ব্যক্তিতের নাম।

এতো গোপন-গোপনীতার মাঝেও অনেক কিছুই আবার প্রকাশ্য। তবে প্রকাশ্য থাকলেও তা রপ্ত করা বা তার অর্থ অনুধাবন করা সকলের কর্ম নয়। সাধ্য-সাধনা-তপস্যার বিষয়। এ সবই গুরুমুখি বিদ্যা। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই ধারা এগিয়ে চলে।

এই গুপ্তসংঘ নিয়ে এই লেখায় আলোচনার অন্যতম কারণ হলো, আত্মা সম্পর্কে বিশ্বাস বা চর্চা কেবল অতি উৎসাহী বালকের অলীক কল্পনা বা সমাজের নিম্নশ্রেণীর বিশ্বাস নয় এটা যে বিশ্বব্যাপী বহু সফল মানুষেরও ভাবনা ও চর্চার বিষয় তা তুলে ধরা।

ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বহু অঞ্চলে শুধু গুপ্তসংঘ নয় এমন সব গুপ্ত সম্প্রদায় আছে; যারা হাজার হাজার বছর ধরে নিজেদের সাধন-ভজন, আচারের রীতিনীতি গুপ্ত রেখে চলেছে। কঠোর গোপনীয়তায় তারাও কম যায় না। সদস্য নির্বাচনেও তারা তেমনি বিচক্ষণ ও পারদর্শী।

ফকিরি, বৌদ্ধ মংক, কাপালিক, অঘোর, নাথসম্প্রদায়ের মতো অগণিত গুপ্ত সাধন-ভজন রীতি প্রচলিত আছে ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে। কালক্রমে নতুন নতুন নানা মত-পথ যেমন যুক্ত হয়েছে তেমনি অনেক মত-পথ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

এতো গোপন-গোপনীতার মাঝেও অনেক কিছুই আবার প্রকাশ্য। তবে প্রকাশ্য থাকলেও তা রপ্ত করা বা তার অর্থ অনুধাবন করা সকলের কর্ম নয়। সাধ্য-সাধনা-তপস্যার বিষয়। এ সবই গুরুমুখি বিদ্যা। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এই ধারা এগিয়ে চলে।

এর অন্যতম উদাহরণ ফকির লালন সাঁইজি। যিনি তাঁর সাধন-ভজনের সকল গুপ্ত কথা প্রকাশ্যে নিজ পদের মধ্যে প্রকাশ করে গেলেও তা এমনি এক রহস্যের চাদরে মুড়ে রেখেছেন যে, চাইলেই যে কেউ তার থেকে প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করতে পারবে না। এই রহস্য আরো ঘনীভূত করে ফকির লালন সাঁইজি বলছেন-

এ বড়ো আজব কুদরতি।
আঠারো মোকামের মাঝে
জ্বলছে একটি রূপের বাতি।।

কিবা কুদরতি খেলা
জলের মাঝে আগ্নিজ্বলা,
খবর জানতে হয় নিরালা
নীরে ক্ষীরে আছে জ্যোতি।।

ছনিমনি লাল জহরে
সে বাতি রেখেছে ঘিরে,
তিন সময় তিন যোগ ধরে
যে জানে সে মহারথী।।

থাকতে বাতি উজ্জ্বলাময়
দেখনা যার বাসনা হৃদয়,
লালন কয় কখন কোন সময়
অন্ধকারে হবে বসতি।।

…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!