ভবঘুরেকথা
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া

-জগদীশচন্দ্র রায়

ধনহীন বিদ্যাহীন যারা এই ভবে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা শান্তি নাহি পাবে।
আত্মোন্নতি অগ্রভাব প্রয়োজন তাই।
বিদ্যাচাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই।।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫৭৩)

বিচার পরিবর্তন হচ্ছে যেমন সব পরিবর্তনের মূল। তেমনি রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার উৎস। এই মৌলিক কথাকে কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুর ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই ক্ষমতার উৎসে পৌঁছানোর জন্য যে সব উপকরণ একান্ত প্রয়োজনীয় সে সব অর্জনের জন্য তিনি আন্দোলন শুরু করেন।

কারণ সব ধনের মধ্যে বিদ্যা হচ্ছে মহাধন। তাই সেই ধনকে প্রথমে অর্জন করতে হবে। বিদ্যাধন অর্জিত হলে আর্থিক ধনও এসে যাবে। তখন রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হলে আর্থিক ধনও এসে যাবে। তখন রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া যাবে।

তাই তিনি এই বিদ্যাহীনদের জাগানোর জন্য আরো জানিয়েছেন যে, পৃথিবীর কোণে কোণে যদি প্রত্যক্ষ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, যারা বিদ্যা ও অর্থধনে ধনী নয়, তারা কখনোই দেশের পরিচালনার মুখ্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না।

গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝেছিলেন ধর্মীয় আবেগে মানুষ বেশি সংগঠিত হবে। সংগঠিত হলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে। তিনি ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে নিয়েছেন, তবে ধর্মবিশ্বাসের উপর দাঁড়ান নি। মানুষকে জাগ্রত করার জন্য, শিক্ষার মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য তিনি ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

আর যদিও কোনো প্রকারে ঐ ক্ষমতার অধিকারী হয় তাহলে তারা সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। তাই আত্মোন্নতির অগ্রভাগে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে বিদ্যালাভ করা। এই বিদ্যালাভ করতে পারলে ধনও আসবে আর দেশ পরিচালনার জন্য ক্ষমতার অধিকারীও হওয়া যাবে।

এক কথায় সব সমস্যা সমাধানের চাবি হচ্ছে শিক্ষিত হওয়া। তবে সেই শিক্ষা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনই নয়, সঙ্গে সামাজিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে কোনো ক্ষেত্রে শান্তি আসবে না। এই উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর একটি সূক্ষ্ম সংকেত দিয়ে গেছেন যে, আপনাকে শুধু শিক্ষিত ও সম্পদশালী হলেই হবে না, রাজনৈতিক ক্ষমতাও দখল করতে হবে।

কারণ সেখানেই শাসনব্যবস্থার ও দেশের প্রগতির সব ক্ষমতা গচ্ছিত আছে। আপনাকে সেটাকে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।

গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝেছিলেন ধর্মীয় আবেগে মানুষ বেশি সংগঠিত হবে। সংগঠিত হলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে। তিনি ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে নিয়েছেন, তবে ধর্মবিশ্বাসের উপর দাঁড়ান নি। মানুষকে জাগ্রত করার জন্য, শিক্ষার মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য তিনি ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

যার ফলে পিছিয়ে রাখা মানুষেরা তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই করতে পারে। আর সেই অধিকার সুপ্ত আছে রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে। যেটা অর্জিত হতে পারে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করলে। তাই তিনি বলেছেন-

যে জাতির দল নাই, সে জাতির বল নাই।
যে জাতির নাই রাজা সে জাতি হয় না তাজা।।

কোনো সমাজ বা জাতিকে প্রগতি করতে হলে দলগতভাবে সংগ্রাম করতে হবে। সেই দলগত সংগ্রামের ফলে অধিকার অর্জন করা যাবে। কীভাবে? কারণ সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে পার্লামেন্টে। সেখানে পৌঁছাতে পারলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নতি করা যাবে।

আর যদি সংগঠিত হয়ে আন্দোলন করা না যায়, তাহলে সর্বদা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে নিজেরাই বিনাশপ্রাপ্ত হতে হবে। তাই সবাইকে একদল একবল হয়ে জাতির উন্নতির জন্য সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

তবে তিনি এই কাজের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক বাণী করেছেন যে-

মধ্যস্বত্ত্ব জমিদারী ধর্ম্ম ক্ষেত্রে নাই।
ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ করোনা গোঁসাই।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫৭৪)

প্রথমেই বলেছি যে, ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করলেও তিনি ধর্ম বিশ্বাসের উপর দাঁড়ান নি। এখানে এই অশিক্ষা, অজ্ঞানতার অন্ধকার ও দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করে সার্বিক ক্ষমতা অর্জনের যে স্তর; সেখানে পৌঁছানোর জন্য তিনি দলবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলেছেন।

অর্থাৎ এইসব প্রতিবন্ধকতা থেকে প্রতিকারকেও ধর্ম আন্দোলন হিসাবে যদি ধরে নেই; তাহলে দেখতে পাবো সেখানে যে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে তার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর সতর্ক বাণী দিয়েছেন যে, এই আন্দোলনের কাজ কিন্তু নিজেদেরই সংঘবদ্ধ হয়ে করতে হবে।

সেখানে অন্য কাউকে অংশীদার করলে সেটা বিপথে চালিত হবে। সাফল্যের চূঁড়ায় পৌঁছানো যাবে না। যার জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন দল করতে নিষেধ করেছেন।

বাস্তবে আমরা গুরুচাঁদ ঠাকুরকে কয়জনে জানি, আর কয়জনে মানি? তাঁকে জানতে ও বুঝতে হলে তাঁর জীবন ও কর্মের গভীরে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। তাঁর এতো বড় সতর্কবাণী কিন্তু এখনো আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।

তাঁর আজীবন সংগ্রামকে আমরা শুধু উপভোগ করছি, কিন্তু সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন কিছু করছি না। যার জন্য সমাজ ও জাতি এখনো পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আছে। আর মধ্যস্বত্ত্ব জমিদারি করছে সেই স্বার্থান্বেষী ভণ্ডের দল।

যারা আমাদের পতিত করে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল, আমাদের প্রতিপদে বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলেছে, আমাদের বৈদিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে, আমরা আজও তাদের চিনতে পারলাম না; চিনলেও তাদের ছাড়তে পারছি না। এটাই কোনো সমাজ ও জাতির প্রগতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।

শক্তি না দেখিলে কেউ করে না সম্মান।
শক্তিশালী হতে সবে হও যত্নবান।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫৭৩)

ধর্ম্মের পালক রাজা জানিবে নিশ্চয়।
রাজশক্তি বিনা কিছু বড় নাহি হয়।।
জাতি, ধর্ম্ম যাহা কিছু উঠাইতে চাও।
রাজশক্তি থাকে যদি যাহা চাও পাও।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৩৪৯)

বুদ্ধ ধর্ম-দর্শনের তিনটি মূল পথ- বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্গ। এই বুদ্ধ মানে শুধু ব্যক্তি গৌতম বুদ্ধ নন। এই বুদ্ধ মানে জ্ঞান- knowledge। ধর্ম মানে এখানে দর্শন, আদর্শ, নীতি। আর সংঘ এখানে এই জ্ঞান ও দর্শনের আদর্শকে প্রসারিত করার জন্য সংগঠিত শক্তি।

মতুয়া ধর্ম-দর্শনেও তিনটি মূল পথ এই অনুসারে হচ্ছে- ‘হরি’, মতুয়া ধর্ম ও মতুয়া সংঘ। এই ‘হরি’ মানে একদিকে যেমন হরিচাঁদ ঠাকুর, অন্য দিকে হরি মানে ‘জ্ঞান’। মতুয়া ধর্ম হচ্ছে দর্শন, আদর্শ ও নীতির সমন্বয়। আর মতুয়া সংঘ হচ্ছে এই ধর্ম-দর্শন ও আদর্শকে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিস্থাপিত করার মাধ্যম।

পৃথিবীতে সূর্য যেমন সকল জৈবিক শক্তির উৎস, তেমনি সংঘ শক্তি হচ্ছে সকল ক্ষমতার অর্জনের উৎস।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন

শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন

তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর

……………………………
আরো পড়ুন:

মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া

বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

……………………………
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!