ভবঘুরেকথা
লালন সাধক ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই

-সবিতা বসু

যুগে যুগে জীবের কল্যাণার্থে সৃষ্টিকর্তা এই ধরাধামে ‘মহাসাধক’ প্রেরণ করেছেন। কে আমি? আমি কেন এসেছি? আমার কি করণীয়? এই আমি কে? জানবার বুঝবার সঠিক তত্ত্ব মহাপুরুষেরা তত্ত্বজ্ঞ গুরুর চরণাশ্রিত হয়ে সাধক ভজন দ্বারা জানতে পেরেছিলেন এবং নিজের আত্মকল্যাণ ও জীবকুলের কল্যাণার্থে প্রদান করেছেন।

তেমনি এক মহাসাধক ‘বাউল সম্রাট লালন সাঁইজির’ দর্শনে অনুপ্রেরিত ভোলাই সাঁইজি সৎ শীর্ষ ‘কোকিল সাঁইজি’র চরণাশ্রিত হলেন মনোরঞ্জন বসু।

কবে সাধুর চরণধুলী মোর লাগিবে গায়।
আমি বসে আছি আশাসিন্ধু কুলে সদায়।।

বসে ছিলেন প্রকৃত সাধুর চরণধুলির আশায় এই সাধক। মানব জীবনের প্রকৃত মূল্যবোধ অন্তরের গভীরে উপলব্ধি করেছিলেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছিলেন শুদ্ধ গুরুর অন্বেষণে কোথায় পাব তাকে? যিনি আমার আমিকে খুঁজে দেবেন।

দারা পরিবার কোনো কিছুতেই আসক্ত ছিলেন না চিরদিন মানব জাতীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। জাত, প্রথা ও অনুসন্ধান এবং সৃষ্টিকর্তাকে হৃদয়ঙ্গম করাই ছিল তার সাধনার মূলমন্ত্র। সব মানুষ এক উপাদানে সৃষ্টি তবে, জাতিভেদ কেনো?

গুরু আশ্রম থেকে নাম পেলেন। ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই জানলেন গুরুতত্ত্ব। গুরু বস্তু রক্ষার প্রণালী, সাধন ভোজনের প্রকৃত নিয়ম, অটল তত্ত্ব। জগৎ সংসারে, মানবের মাঝে, মানুষের কল্যাণে, প্রকৃত ভক্ত দেখে বিলাতে লাগলেন বাউল দর্শন। অনেকে ভক্ত হলেন। তারা ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে পেলেন জীবন শক্তিকে ধরে রাখার সঠিক পন্থা। সাধন-ভজন এর প্রকৃত পদ্ধতি।

সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেলেন ‘কুষ্টিয়া জেলা ছেঁউড়িয়া’তে বাউল দর্শন থেকে। শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন কোকিল সাঁইজির এই সাধক গুরু কৃপায় সঠিক রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন বাউল দর্শনে। যে দর্শন জীবনের কথা বলে, যে দর্শন আত্মকল্যাণের কথা বলে, যে দর্শন মুক্তির কথা বলে সমস্ত মানবজাতির কল্যাণ নিহিত আছে এই দর্শনে।

শুরু হল অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা গুরুসান্নিধ্য লাভ করা। দিনের পর দিন না খেয়ে পরনে জরাজীর্ণ পরিধান। কোন দিকে দৃষ্টিপাত নাই একমাত্র ধ্যান কিভাবে গুরু পদাশ্রিত হওয়া যায়। কি করে গুরুকৃপা লাভ করা যায়।

কীভাবে আমার আমিকে জেনে আমাতে নীল হওয়া যায়। ‘লালন সাঁইজি’র আখড়াবাড়ি ছেঁউড়িয়া কুষ্টিয়া থেকে পায়ে হেঁটে যেতেন গুরু সেবার উদ্দেশ্যে। দীর্ঘদিন গুরুর সান্নিধ্যে থেকেছেন। তত্ত্বজ্ঞ গুরু জানেন, প্রকৃত ভক্ত কে। তাই দীর্ঘদিন দেখার পর গুরু বুঝেছিলেন ‘স্বর্ণপাত্র মনোরঞ্জন’। তাই প্রদান করলেন, ‘সিংহের দুধ’।

গুরু আশ্রম থেকে নাম পেলেন। ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই জানলেন গুরুতত্ত্ব। গুরু বস্তু রক্ষার প্রণালী, সাধন ভোজনের প্রকৃত নিয়ম, অটল তত্ত্ব। জগৎ সংসারে, মানবের মাঝে, মানুষের কল্যাণে, প্রকৃত ভক্ত দেখে বিলাতে লাগলেন বাউল দর্শন। অনেকে ভক্ত হলেন। তারা ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে পেলেন জীবন শক্তিকে ধরে রাখার সঠিক পন্থা। সাধন-ভজন এর প্রকৃত পদ্ধতি।

বলছিলাম একজন লালন সাধকের কথা। এই সাধক জগৎ সংসারে পেশাতে ছিলেন একজন ভেষজ চিকিৎসক (কবিরাজ)। অনেক সময় বিনামূল্যে আর্তের সেবা দিতেন। সমস্ত সময় মানব কল্যাণের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। জগৎ সংসারের বন্ধনের ধরাছোয়ার বাইরে ছিলেন তিনি, থাকতেন অন্তর মন্দিরে গুরু ধ্যানে মগ্ন।

গুরু ভক্তি এতোটাই প্রগাঢ় ছিল যে, তিনি শমনের ডাক শুনেছিলেন। পরোপারে যাবার আগে, শেষবারের মতো সমস্ত ভক্তবৃন্দ নিয়ে ছেঁউড়িয়াতে গেলেন গুরু সমাধিস্থলে। গুরুর কাছে অন্তরস্থল থেকে ভক্তি অর্ঘ নিবেদন করে গুরুর চরণে সমস্ত ভক্তদের অপন করলেন এবং তাদের কিছু যদি জানবার থাকে গুরুর কাছে প্রার্থনা করলেন। গুরু কৃপাতে জেনেছিলেন এটাই তার শেষ আশা ছেঁউড়িয়াতে।

‘মরণ কারো কথা শোনে না।’

চলে গেলেন ২ জানুয়ারি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। নিজ ভক্তের কোলে মাথা রেখে গুরুর চরণ স্মরণ করে নিজ ধামে। সমস্ত ভক্তের নয়ন জলে ভাসিয়ে। তিনি বুঝেছিলেন এই মানব জীবনে সমস্ত যদি সময় থাকতে তত্ত্বজ্ঞ গুরুর চরণাশ্রয় করে সাধন করা যায়।

বিশ্বের বিচিত্রতা, বিশালতা, সৃষ্টি রহস্য এবং প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপরি প্রকৃত বাউলগণের ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল বুনিয়াদ। এই বুনিয়াদের উপর নির্ভর করে বাউলের শুদ্ধ সাধন ভজন। এই সাধন দ্বারাই প্রকৃত ধর্ম পালন করেন তারাঁ।

তাই সাঁইজির পদে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। যে সাধকের কয়েকটি কথা বললাম সেটা এই সাধকের কৃপা ও তার ভক্তদের কৃপা বলে। তিনি আমার পরমারাধ্য পিতৃদেব। সাধককে কখনো সাধক বা গুরু রূপে দেখি নাই। বাবা জ্ঞানে দেখেছি কারণ সাধক দর্শন করবার জ্ঞান চক্ষু আমার নাই। আমি এক অতি নিকৃষ্ট পাপী।

সাধকের গুরু ভক্তি এতোটাই প্রবল ছিল এবং গুরু কৃপা এতোটাই প্রগাঢ় ছিল যে, তার আবাসস্থল গুরুর নামে ‘কোকিল কুঞ্জ’। মাগুরা সাহাপাড়া দোয়ার পাড়ে অবস্থিত। গুরুর আবাস ভূমিতে সাধকের সমাধিস্থল। সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাধক।

সাধু কথা বা সাধকের কথা লিখে শেষ করা যায় না এবং বিশ্রাম নেই। তবুও না জানাতে লিখতে অক্ষম। পরিশেষে সাধু কৃপাতে এবং বাবার ভক্তদের সান্নিধ্যে এসে আমি যতটুকু সূক্ষ্ম জ্ঞানে বুঝেছি সেটা স্বচ্ছ ও শুদ্ধ বাউল দর্শন। এই দর্শন নিয়ে জনসমাজে নানা রকম পৈশাচিকতার প্রচলন লক্ষ করা যায় কিন্তু এটা সঠিক নয়।

বিশ্বের বিচিত্রতা, বিশালতা, সৃষ্টি রহস্য এবং প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপরি প্রকৃত বাউলগণের ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল বুনিয়াদ। এই বুনিয়াদের উপর নির্ভর করে বাউলের শুদ্ধ সাধন ভজন। এই সাধন দ্বারাই প্রকৃত ধর্ম পালন করেন তারাঁ।

আত্মতত্ত্ব, আত্মদর্শন ও আত্মরক্ষা এটাই বাউলের দর্শন। এই দর্শনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের সংখ্যা খুবই কম। তবে এই সাধকের বাউল দর্শনের উপর এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, নিজের পুরো পরিবার এই দর্শনে বিশ্বাসী এবং এইমত পথ অবলম্বন করে নিজকে চেনার সঠিক পথে আত্মনিয়োগ করেছেন।

আমি সর্বান্তকরণে এই মতপথকে শ্রদ্ধা করি। সমস্ত সাধু চরণে ভক্তি অর্ঘ নিবেদন করে ‘একজন লালন সাধকের কথা’ লেখনির বিশ্রাম টানছি।

<<ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই ।। আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই>>

………………..
লেখক সবিতা বসু
মনোরঞ্জন গোঁসাইয়ের বড় কন্যা।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………….
আরো পড়ুন:
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই
আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই

মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
একজন লালন সাধকের কথা
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর দর্শন

মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -দুই
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন

মনোরঞ্জন গোঁসাই: স্বরূপ সন্ধানী দার্শনিক
মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর জীবন দর্শন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!