ভবঘুরেকথা
পাগল মস্তান

সঙ্গে যাবি পাগল হবি: পর্ব-এক

-মূর্শেদূল মেরাজ

যদিও ভবঘুরের অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে। তারপরও সাধারণের কাছে ভবঘুরে মানেই পাগল। সহজভাবে বলতে গেলে ‘ভবঘুরেকথা’র অর্থ হলো- ‘পাগলের প্রলাপ’। একে গুরুত্ব দেয়ার তেমন কিছু নেই। কথায় বলে না ‘পাগলে কি না বলে’।

আর সেই পাগলের কথার কি আর ভিত্তি। তাকে গুরুত্ব দেয়ারই বা কি আছে? তাকে শোনারই কি আছে?? অন্যদিকে ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজিও সাধারণকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন- ‘পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে’

অর্থাৎ পাগলের সংস্পর্শে আসলে পাগলের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। তাই পাগল হতে না চাইলে পাগলের সঙ্গ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

তবে যে পাগলকে ভালোবাসে তার পক্ষে পাগলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাগলের এমনই লীলা। ললিত নারায়ণ বলেন- ‘তাঁর সঙ্গদোষে হয়রে আশেক দিওয়ান, ঘরে থাকা যায় না।’

সামাজিকভাবে পাগলকে বয়কট করা হলেও। সাধনপথে পাগলকে দেয়া হয়েছে প্রেমের দরজা। তবে সাধনপথের ভাবের পাগল আর সাজের পাগলকে দেয়া হয় পৃথক মর্যাদা। এখানে চাইলেই সকলে পাগল হতে পারে না। চাইলেই সকলে পাগল হয়ে থাকতেও পারে না।

সকল পাগল আবার মনের মতো পাগল হয়েও উঠতে পারে না। সকলে পাগলামীর গভীরতায় ডুবতে পারে না। এ বড়ই কঠিন প্রেমের খেলা। নিজের ভেতরের প্রেমকে চিনতে না পারলে পাগলের প্রেমের ঠাওর করা যায় না। তাই সাধক দিন শেষে গেয়ে উঠেন-

দেখি নকল পাগল সকল দেশে
নকল পাগল সকল দেশে,
আসল পাগল কয়জনা,
মনের মতো পাগল পেলাম না,
ও আমি, মনের মতো পাগল পেলাম না।
ক্ষ্যাপা তাইতে পাগল হোলাম না
মনের মত পাগল পেলাম না,
ও ক্ষ্যাপা, মনের মতো পাগল পেলাম না।।

কেউ পাগল পিরিতি রসে
বিষয় লালসে, ধনের মানের যশের পাগল
আছে দেশে, ক্ষ্যাপা রে
ধনের মানের যশের পাগল আছে দেশে।

তারা মোহে মত্ত সদা চিত্ত
মোহে মত্ত সদা চিত্ত,
নিত্য সত্য মানে না।
মনের মতো পাগল পেলাম না,
ক্ষ্যাপা রে, মনের মতো পাগল পেলাম না।।

শিবের মতো পাগল পাওয়া ভার
সুধা তে যে গরল জাগা হার
বলদ বাহন চর্ম আসন, সর্প অলংকার,
ক্ষ্যাপা রে, বলদ বাহন চর্ম আসন, সর্প অলংকার।

ও সে কিসের তরে ভিক্ষা করে
কিসের তরে ভিক্ষা করে?
ঘরে যার অন্নপূর্ণা,
মনের মতো পাগল পেলাম না,
ক্ষ্যাপা রে, মনের মতো পাগল পেলাম না।।

সবার ওপর এক পাগল আছে
এ জগৎ পাগল করেছে
রাধার প্রেমে বিভোর হয়ে গোলক ছেড়েছে,
ক্ষ্যাপা রে,
রাধার প্রেমে বিভোর হয়ে গোলক ছেড়েছে।

ও যার বাঁশির গানে বৃন্দাবনে
বাঁশির গানে বৃন্দাবনে
বৈদ্য উজান যমুনা
মনের মতো পাগল পেলাম না,
ও আমি, মনের মতো পাগল পেলাম না।
ও ক্ষ্যাপা তাইতে পাগল হোলাম না
মনের মতো পাগল পেলাম না।।

কেউ সেই ‘রূপ’ দেখে পাগল হয়। আবার কেউ ‘সেই রূপ’ দেখার জন্য পাগল হয়। কেউ কারো আদেশে পাগলের বেশ ধরে ঘুরে বেড়ায়। কেউ নিজে কেনো পাগল, তা জানার জন্য ঘুরে বেড়ায়। কেউ কিছুই জানে না। জানবার আগ্রহও নেই। সে কেবল ঘুরে বেড়ায়।

তাই সাধনপথে বা আধ্যাত্মবাদে পাগলকে বোঝা সবচেয়ে দুরূহ। সে নিজে ধরা না দিলে তাকে আবিষ্কার করা যায় না। আর সে যাকে ধরা দেয়, সে তার মাঝে বিলীন হয়ে যায়। সে পাগল হয় তার প্রেমে। পাগলের প্রেম বড্ড আঠালো। একবার লাগলে আর ছাড়ানো যায় না। গোঁফে তেল মেখে রাখলেও কাজ হয় না।

সাধনপথের পাগল কিন্তু প্রথাগত মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ নয়। সাধন পথের পাগল অথৈ জলের সাধক। সেই পাগল হওয়া সহজ নয়। বহু সাধনার বলে সেই পাগল হওয়া যায়। মা যেমন আদর করে সন্তানকে বলেন, আমার পাগল ছেলে। সেই ছেলে মস্তিষ্ক বিকৃত নয়, সে হলো পরানের ধন পাগল।

যে প্রেমে পাগল হয়, যে প্রেমের পাগল পারা। সেইতো নাড়ি ছেঁড়া ধন। আর সেই সন্তানকেই মা ডাকে পাগল বলে। যে বুঝতে চায় না কিছুই প্রেম ছাড়া। সাধনপথের পাগলও তেমনি। সে সৃষ্টি হয়ে স্রষ্টাকে সেই প্রেমের ডোরে বেঁধে ফেলে। সন্তান যেমন মাকে বাঁধে প্রেমে।

কেউ হয়তো হাঁটতেই থাকে আজীবন। কেউ হয়তো এক জায়গায় বসেই কাটিয়ে দেয় একটা জীবন। কেউ হয়তো এক জামার উপর শত সহস্র জামা পরে ঘুরে। কেউ হয়তো গায়ে কাপড়ই রাখে না। কেউ গায়ে লোহালক্কর পড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। কেউ নিজেকে বেঁধে রাখে শিকলে।

সন্তানের যেমন মায়ের উপর থাকে চরমতম অধিকার। মাকে যেমন সে ভালোবাসতে পারে। মায়ের উপর করতে পারে রাগ-অভিমান। জুড়ে দিতে পারে তর্ক। করতে পারে ঝগড়াঝাঁটি মারামারি কাটাকাটি। কিন্তু এ সবই যে করে প্রেমের অধিকার থেকে। তার সাথে মায়ের সম্পর্ক অন্তনির্হিত।

স্রষ্টার সাথে পাগলের সম্পর্কও তেমনি প্রেমের। নিবিড় প্রেমের সম্পর্ক। যে সম্পর্কের জেড়ে পাগল প্রচণ্ড অধিকার নিয়ে সাধন-ভজন করে। সাধনায় সে এতোটাই রত হয় যে জগতে কে কি বললো। কে কি ভাবলো। কে কি করলো। তাতে সময় দেবার মতো সময় তাদের থাকে না মোটেও।

পাগল থাকে আপন খেয়ালে। আপন ভুবনে। আপন তরঙ্গে। আপন চিন্তা-চেতনায়। আপন জগতে। কেবল পাগল হতে পারলেই তার সমান্তরালে ভাববার নূন্যতম চেষ্টা করা যেতে পারে। যদিও তা সম্ভব নয়। তারপরও তার ধারা ধরতে পারলে সে ধরা দেবে।

ভালোবাসবে। কাছে ডাকবে। প্রেম জাগ্রত করে দেবে।

ভাবজগতে পাগলের অনেক ভাব। কেউ জালালী পাগল, কেউ মজ্জুবি পাগল, কেউ উদাসী পাগল। আরো কত কি। এদের কেউ হয়তো সারাক্ষণ বিড় বিড় করতেই থাকে। কথা বলতেই থাকে। কেউ শুনুক না শুনুক নিজের খেয়ালে কথা বলতেই থাকে। কেউ হয়তো কথাই বলে না। উদাস দৃষ্টিতে কেবল থাকিয়ে থাকে। বা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।

আবার কেউ কেউ ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টে ফেলে। এই হাসছে, এই কাঁদছে, এই অভিমান করছে, এই প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠছে, এই কথা বলেই যাচ্ছে। আবার হয়তো চুপ। একবারে নিরব।

কেউ ঘুমায় দিবারাত্রি। কেউ ঘুমায় না। কেউ কেবল খেতে চায়। কাউকে জোড় করেও খাওয়ানো যায় না। কেউ কেউ দেখলেই টাকা চায়। এটা চায় ওটা চায়। আবার কেউ কেউ যাকে পছন্দ হয় তাকেই নিজের টাকা পয়সা সব দিয়ে দেয়।

কেউ হয়তো হাঁটতেই থাকে আজীবন। কেউ হয়তো এক জায়গায় বসেই কাটিয়ে দেয় একটা জীবন। কেউ হয়তো এক জামার উপর শত সহস্র জামা পরে ঘুরে। কেউ হয়তো গায়ে কাপড়ই রাখে না। কেউ গায়ে লোহালক্কর পড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। কেউ নিজেকে বেঁধে রাখে শিকলে।

কেউ জটাধারী। কেউ পরিপাটি-ছিমছাম। কেউ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে থাকে দিবারজনী কিন্তু বাজায় না কখনোই। কেউ আবার অন্যেরটা কেড়ে নিয়ে বাজিয়ে চলে। কেউ গান গাইতে শুরু করলেই থামতেই চায় না। কাউকে জোড় করেও এক লাইন গাওয়ানো যায় না।

কেউ ঘুরছে নিশান নিয়ে। কেউ ঘুরছে একতারা হাতে। কেউ ঘুরছে শ্মাশানে শ্মশানে। কেউ বা কবরস্থানে। কেউ আখড়ায় আখড়ায়। কেউ বা পীরের দরগায়। কেউ ঘুরে ফেলেছে অর্ধেক বিশ্ব বিনা পাসপোর্টে। কেউ আবার দারবার থেকে বাড়ায় নি এক পা।

কেউ ঘুমায় দিবারাত্রি। কেউ ঘুমায় না। কেউ কেবল খেতে চায়। কাউকে জোড় করেও খাওয়ানো যায় না। কেউ কেউ দেখলেই টাকা চায়। এটা চায় ওটা চায়। আবার কেউ কেউ যাকে পছন্দ হয় তাকেই নিজের টাকা পয়সা সব দিয়ে দেয়।

কেউ গান শুনলেই আত্মহারা হয়ে উঠে। নেচে গেয়ে মাতোয়ারা হয়। কেউ গান শুনে চলে যায় গভীর ভাবনায়। কেউ সর্বক্ষণ দিয়ে বেড়ায় খিস্তি খেউড়ি। কারো বা মুখে সুমিষ্ট বাণী।

কেউ গায়ে চাপিয়ে বেড়াচ্ছে গুরুর পোশাক। কেউ গায়ে চাপিয়েছে সহস্র গঞ্জনার অলঙ্কার। আসলে এভাবে বলে শেষ করা যাবে না। পাগলের বর্ণনা কি বলে বা দিয়ে শেষ করার উপায় আছে? এর এক শব্দে উত্তর হলো ‘না’। আসলে এসবই এক ধরণের ভেক তাদের। এক ধরণের আড়াল। জালাল খাঁ লিখেছেন-

দেখলে ছবি পাগল হবি ঘরে রইতে পারবি না
এই চৌদ্দ ভুবনে আমার মর্শিদ মৌলানা।।

মোহন মুরতি বাবার, দেখলে পরে ঘোচে আধার
আরশ কুরসি সাগর পাহাড় দেখবার বাকি থাকেনা।।

যিশু ভাবে খৃষ্টানেরা ভাবে জিন-দেব জৈনেরা
হিন্দু ভাবে মদনমোহন, শ্রীনন্দের কেলে সোনা।।

এশ্ক ভাবে রাখিলে প্রাণ,পানি হয়ে যায় পাষাণ
নুরেরই তছল্লি-শান করিয়া দেয় দিল ফানা।।

বাহিরে পীরের ছবি, ভিতরে সেই নুরের নবী
ধ্যানের দেশে আল্লা হবি জালাল কহে ডুবে দেখনা।।

যে পর্দার আড়ালে তারা তাদের প্রেম লুকিয়ে রাখে সযত্নে। কেবল প্রেমিককুলই তার সন্ধান করে নিতে পারে। বাকিদের কাছে তারা অস্পৃশ্য-অচ্ছুত মানুষ। যাদের সাথে পাশাপাশি বসে খাওয়া, পাশাপাশি চলাচল, কথাবার্তা বলাও গা রি রি করা ব্যাপার।

একবার এক কট্টর শরিয়তি ব্যক্তিকে দেখেছিলাম এক পাগল সাধকের পেছন পেছন ঘুরতে, সময় দিতে। পাগলের সেবা সুস্রসা করাই যেনো তার জীবনের ব্রত। কিন্তু তিনি তার নিয়মিত জীবন যাপন-বিশ্বাস কিছুই ত্যাগ করেন কি। একই সাথে দুই ভাব তিনি কি করে ধরে রেখেছেন বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়েছিল।

এই বলতে বলতে তিনি সশব্দে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, এ খোদা তুমি আমার মধ্যে প্রেম দাও। আমার মধ্যে প্রেম দাও। যাতে সক্কলরে ভালো বাসতে পারি। সবার মধ্যে এই যে ভেদ করি তা আমি আর নিতে পারি না খোদা।

সুযোগ মতো একদিন জানতে চাওয়াতে তিনি কঠিন চেহারা নরম করে হাসি হাসি মুখে বলেছিল, আর বলবেন না। উনারে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। একটা মানুষ কেন এতো কষ্ট করবে। কেন এতো অপরিষ্কার থাকবে? কেন সময় মতো খাবে না?

ঘুমাবে না? গোসল করবে না? তেল-জল নিবে না? বলেন এই সব সহ্য হয়? কোনো মানুষ এসব করে? বলেন আপনিই বলেন?

আমি বললাম, তা আপনি কি উনাকে প্রথাগত পথে ফিরিয়া আনার কাজ করে যাচ্ছেন? দেখে তো তা মনে হয় না।

উনি হাসিটা আরেকটু বাড়িয়ে বলেছিল, আরে না। সেই চেষ্টা প্রথমে নিয়েছিলাম সত্য। কিন্তু পরে জেনেছি। উনি সঠিক পথে আছে। উনি খাঁটি লোক। আমি তো কোনো কিছু ত্যাগ করতে পারি না। সংসারের মায়া। সম্পদের মায়া। সম্পর্কের মায়া কাটাইতে পারি না। বেহেস্তের লোভ ছাড়তে পারি না।

উনি পারছেন। তাই উনারে সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। এর বেশি কিছু না। এর বেশি কিছু না।

এই বলতে বলতে তিনি সশব্দে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, এ খোদা তুমি আমার মধ্যে প্রেম দাও। আমার মধ্যে প্রেম দাও। যাতে সক্কলরে ভালো বাসতে পারি। সবার মধ্যে এই যে ভেদ করি তা আমি আর নিতে পারি না খোদা।

(চলবে…)

……………………………….
স্থিরচিত্র: ফাহিমুর রহমান চৌধুরী

……………………………….
আরো পড়ুন:
সঙ্গে যাবি পাগল হবি: পর্ব-এক
সঙ্গে যাবি পাগল হবি: পর্ব-দুই
সঙ্গে যাবি পাগল হবি: পর্ব-তিন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • ইসমাইল জুমেল , বুধবার ৬ জানুয়ারি ২০২১ @ ৫:২৮ অপরাহ্ণ

    জানা নেই শোনা নেই তবু যেন ঘটনায় বসে আছি। অসাধারণ বর্ণনায় সমৃদ্ধ লেখা। জয় হোক ভবঘুরে কথার। জয়গুরু। প্রেম ও ভক্তি জানাই। ???

    • ভবঘুরে , বুধবার ৬ জানুয়ারি ২০২১ @ ৫:৩১ অপরাহ্ণ

      জয় হোক
      ভালোবাসা ও ভক্তি নিবেন
      পাশে থাকবেন
      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!