ভবঘুরেকথা

চোখ-বাঁধা বলদকে যেমন কলুর ঘানীতে জুড়িয়া দিলে তার গত্যন্তর নাই; ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, টানিতেই হইবে। এই কথা কেবল তোমার পক্ষেই খাঁটিবে, তাহা নহে; বস্তুতঃ সমগ্র দেশ জুড়িয়া খুঁজিলেও ইহার ব্যতিক্রমস্থল পাওয়া শক্ত।

কেন না, আজিকার যুগে শিক্ষা ব্যাপারটা হাত-পা বাঁধিয়া নাকের মধ্য দিয়া উদরে রবারের নল ঢুকাইয়া জোর জবরদস্তিতে ভোগপুরী ভুট্টার মণ্ড খাওয়ান’র সমান হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তোমার ক্ষুধা থাকুক আর না থাকুক, খাইতেই হইবে; ভাল লাগুক আর না লাগুক, গিলিতেই হইবে। গত্যন্তর নাই।

অর্থাৎ টাকা পয়সা খরচ করিয়া তোমরা যে শিক্ষালাভ কর, তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে দাসত্ব ব্যতীত আর কিছুই নহে। তোমার শিল ও তোমার নোড়া দিয়া তোমারই দাঁতের গোঁড়া ভাঙ্গা হইতেছে।

তোমার শক্তি এবং তোমার সামর্থ্য তোমারই স্বাধীন বুদ্ধি, স্বাধীন বৃত্তি এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠার পাদমূলে কুঠার হানিবার জন্য প্রয়োগ করা হইতেছে; তুমি অবোধ শিশুর মত নির্ব্বিবাদে তাহার সমর্থন করিতেছ, ইহাই দাসত্ব।

আত্মবিস্মৃতি দাস-মনোবৃত্তির জননী। যাহা কিছু আত্মবোধ, আত্মমর্য্যাদাবোধ এবং আত্মকুশলবোধকে প্রতিহত বা পদাহত করে, তাহাই দাসসুলভ ভীরুতা, কাপুরুষতা, অধ্যবসায়হীনতা, আত্ম অবমানশীলতা প্রভৃতিকে ডাকিয়া আনে। শিক্ষার প্রারম্ভে তোমরা মূল্য দিয়া আত্মবিস্মৃতি কিনিয়া আনিয়াছ, তাই তাহারই প্রসূত দাসত্ব তোমাদের ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্ত চুষিতেছে।

যথার্থ শিক্ষা মানুষের দুর্ব্বল মেরুদণ্ড সবল করে, কুব্জপৃষ্ঠ সরল করে, অবনমিত মস্তক উত্তোলিত করে। আর, যে শিক্ষা তোমরা পাইতেছ, তাহা তোমাদের পিঠের উপরে বৃথা বোঝা চাপাইয়া প্রাণান্তকারী যন্ত্রণার সৃষ্টি করিয়াছে।

মানব-জীবনের দুঃস্থ মুহূর্ত্তের জন্য শিক্ষা এক অব্যর্থ পাশুপত অস্ত্র, ইহা মানুষের সকল হিংস্রতার আক্রমণ হইতে স্বাধীন এবং স্বচ্ছন্দ রাখে; আর তোমাদের শিক্ষা তোমাদিগকে দৃষ্টিক্ষীণতা হইতে ক্ষীণায়ুষ্কতায় টানিয়া নেয়, দৈহিক অস্বচ্ছন্দতা হইতে ক্রমশঃ রাজযক্ষ্মার খর্পরে বলি দেয়। শিক্ষার চাপে তোমাদের পৌরুষ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, শিক্ষার প্রচণ্ড তাপে তোমাদের মনুষ্যত্ব দহিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে।

এই শিক্ষার জন্য অর্থ দাও কেন তাহাই ত’ জিজ্ঞাসা করিতেছ? আমার উত্তর অতি সহজ, অতি সরল। তোমরা মরিতে চাহ, বাঁচিয়া মরিয়া থাকিতে চাহ, মরিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিতে চাহ, তারই জন্য এই শিক্ষাকে চাহিয়া থাক। তোমরা টাকার জন্য লেখাপড়া কর, তাই লেখাপড়ার জন্য টাকা খরচ কর।

মনুষ্যত্বের জন্য পুরুষ্যত্বের লেখাপড়া তোমরা কর না, তাই, তোমরা পড়াশুনা করিতে পুরুষত্বের বা মনুষত্বের প্রয়োগ কর না। ক্লীব রহিয়াও তোমরা টাকা পাইলে খুশি, দীন-দরিদ্র থাকিয়া তোমরা পৌরুষদীপ্ত নির্ম্মল নির্ভীক জীবন পাইতে অসন্তুষ্ট। তাই তোমরা স্কুলে পাঠশালায় ঢুকিয়াছ।

যদি তাহাই না হইত, তাহা হইলে তোমরা নিজেদের জীবনকেই এক একটি বিদ্যায়তন করিয়া লইতে এবং সেই পাঠশালায় জীবন-বেদ অধ্যয়ন করিতে; জীবনের অতীত অভিজ্ঞতায় বর্ত্তমানকে সুষ্ঠরূপে নির্ম্মাণ করিতে তোমরা আপ্রাণ প্রয়াস পাইয়া অনায়াসে ভবিষ্যতের জন্য আনন্দলোক নির্দ্ধারণ করিয়া লইতে; বাহিরের কলকোলাহল অগ্রাহ্য করিয়া পরমানন্দ সাগরের অগম জলে নীরব নিথর ভাবে স্থান পাইতে; পাত্রা-পাত্র, ক্ষেত্রাক্ষেত্র, স্থানাস্থান বেশী বিচারে না আনিয়া অফুরন্ত তপঃশক্তির প্রভাবে জগৎকল্যাণে ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র সকলকে অক্ষোভ-অন্তরে সম্মিলিত করিতে পারিতে; শত শত অখণ্ডনীয় যুক্তি-প্রমাণের বোঝা বহিয়া যে লাভ নাই, একটি মাত্র সিদ্ধান্তে আস্থা ন্যস্ত করিয়া স্নিগ্ধ আশার অমল আলোকে পথ চলিবার প্রয়াস যে শ্রেয়ের শ্রেয়, তাহা সহজেই বুঝিতে পারিতে; জনসমাজে খ্যাত হইলাম আর অখ্যাত রহিলাম, তাহা না ভাবিয়া একান্ত মনে অখেদ-চিত্তে নিজেরই বিবেকানুকূল কর্ম্মের পথে দুঃখ সহিয়াও, বেদনা পাইয়াও অগ্রসর হইতে হইবে।

………………………………
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দের পরমহংসদেবের ‘আপনার জন’

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে ভারতের সাধক সাধিকা:

পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!