ভবঘুরেকথা

মন দিয়া শুন কহি গুরু পদাশ্রয়।
দীক্ষাগুরু শিক্ষাগুরু দুই মত হয়।।
প্রথমে দিলেন যিনি মন্ত্র উপদেশ।
মন্ত্রগুরু দীক্ষাগুরু হয় সে বিশেষ।।
গুরুতত্ত্ব কৃষ্ণতত্ত্ব যে জন জানায়।
শিক্ষাগুরু হন তিনি শাস্ত্রেয় ভাষায়।।
শিক্ষাগুরু হয় জান কৃষ্ণের স্বরূপ।
অন্তর্য্যামী ভক্তশ্রেষ্ঠ এই দুইরূপ।।
গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে।
গুরু রূপে কৃষ্ণ কৃপা করে ভক্তজনে।।

জীবের সাক্ষাৎ নাই গুরু চৈতন্যরূপে।
শিক্ষাগুরু হয় কৃষ্ণ মহন্ত স্বরূপো।।
ঈশ্বর স্বরূপে ভক্ত তার অধিষ্ঠান।
ভক্তের হৃদয়ে কৃষ্ণ সতত বিশ্রাম।।
কৃষ্ণগুরু ভক্ত শক্তি অবতার প্রকাশ।
কৃষ্ণ এই ছয় রূপে করেন বিলাস।।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে আছয়ে লিখন।
সে সব বৃত্তান্ত কহি শুন দিয়া মন।।
পুজা মূল পুরুপদ ধ্যান গুরুমুর্ত্তি।
মুর্ত্তিগুরুমূল কৃপা কহে স্মৃতিশ্রুতি।।
সর্ব্ব মন্ত্র মূল হয় গুরুমুখ বাক্য।
ভক্তি সহ হৃদি মাঝে করিবেক ঐক্য।।

গুরু বাক্য বিশ্বাস না হলে যে জনায়।
গুরুত্যাগী সেইজন বঞ্চিত সবার।।
তাহার সংসর্গ ত্যাগ অবশ্য করিবে।
নতুবা বৈষ্ণব অপরাধী সে হইবে।।
গুরুদেশ গুরুবেশ গুরু ধর্ম্মচার।
যে জনার লেশ নাই সঙ্গ ছাড় তার।।
অজ্ঞাত পাষাণ মন আছয়ে যাহার।
গুরুবিনা নিস্তারিতে কেবা আছ আর।
হরিভক্তি বিলাসেতে আছয়ে বর্ণন।
মন দিয়া সেই কথা শুন ভক্তগণ।।
গুরুতে আসক্তি হয় বলবান যার।
শাস্ত্র পড়ি কৃষ্ণভক্তি লাগে না তাহার।।
গুরু পাদপদ্মে নিষ্ঠা আছে যার মন।
কোন শাস্ত্র না পড়িয়া পণ্ডিত সে জন।।

যথা তথা পাও যদি গুরুর দর্শন।
দেখিলেই কৃতাঞ্জলি হইবে তখন।।
অষ্টাঙ্গেতে দণ্ডবত করিবে নিশ্চয়।
ছিন্ন তরুমূল হেন ভূমিতে পড়য়।
ব্রহ্মবৈর্ত্ত পুরাণেতে আছয়ে বর্ণন।
মন দিয়া সেই তথ্য শুন ভক্তগণ।।
গুরু কৃষ্ণ হয় ইষ্ট গুরু বন্ধু হন।
যাহা হৈতে মিলে ইষ্ট মিলে প্রেমধন।।
ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ যেই যাহা চায়।
তাঁহার চরণ ধ্যানে সকলি মিলায়।।
গুরু ভক্তি বিনে যদি ব্রত যোগধ্যায়।
প্রেম কাম নাহি মিলে সব ব্যর্থ যায়।।
গুরুনিষ্ঠ জনের চরণে নিবেদন।
শ্রীগুরু চরণে যেন থাকে মম মন।।

ভক্ত আর ভক্তি গুরু আর ভগবান।
একমাত্র চারি বস্তু একই সমান।।
গুরুপদ বন্দনাতে সর্ব্ব বিঘ্ন নাশে।
সাধ্য বস্তু সাধন সে বেদে ইহা ভাবে।।
ভক্তমাল গ্রন্থে পাছে যেরূপ বর্ণন।
আর কিছু গুঢ় তথা করহ শ্রবণ।।
ভগবানে ভক্তে আর শ্রীগুরু চরণে।
প্রেমভাব কেহ দিতে নারে গুরু বিনে।।
স্বয়ং ভগবান হয় আপনি মহস্ত।
স্বয়ং গুরু দেখ হয় স্বয়ং ভক্তিমন্ত।
রাধাকৃষ্ণ রঙ্গরস মন্ত্র কৃষ্ণ নাম।
অতএব হৃদিমাঝে রাখ অবিরাম।।

গুরু সেবা কর সবে একমন হৈয়া।
গুরু শিষ্য এক আত্মা দেখ বিচারিয়া।
তত্ত্বজ্ঞানে গুরু শিষ্য এক আত্মা হয়।
পূর্ব্বপিয় এই কথা মহাজনে কয়।।
গুরু শিষ্য ভিন্ন নহে পরমাত্মা দেখ।
গুরু বাখ্য সত্য করি হৃদয়েতে রাখ।।
গুরুরে মনুষ্য জ্ঞান কভু না করিবে।
গুরুতেই সর্ব্বদেব নিশ্চয় জানিবে।।
সহস্রারে মহাপদ্ম করি ধ্যানারোপ।
সাক্ষাৎ দেখিবে গুরু চৈতন্য স্বরূপ।।
শিক্ষা-গুরু পরম ব্রহ্ম ব্রজেন্দ্র নন্দন।
আত্মার চৈতন্য হৈলে জানেবে তখন।।
চিন্ময় আকার হরি দেখিবে যখন।
এক আত্মা হবে তবে নিত্যেতে গমন।।
ভক্তিতত্ত্ব সারে আছে এরূপ বর্ণন।
আর কিছু গূঢ় তথ্য করহ শ্রবণ।।

গুরু সেবা নিরন্তর করে সেই জন।
লক্ষীপতি সদা তারে করেন পাবন।
গুরুসেবা নাহি করে যেই দুরাচার।
তার সম পাপী নাই সংসার মাঝার।
গুরু প্রতি সদা মতি না থাকে যাহার।
মহাপাপী বলি খ্যাত সেই দুরাচার।
গুরু প্রতি সদা ভক্তি করয়ে যেজন।
গুরু সেবা আর পূজা করে অনুক্ষণ।
তার সম ভাগ্যবান নাহিক ধরায়।
তাহার পুণ্যের কথা বলা নাহি যায়।
মহাপুণ্যবান সেই অবনী ভিতরে।
তার সম নাহি সুখি সংসার মাঝারে।।
ব্রত যজ্ঞ উপবাসে যত পুণ্য হয়।
তীর্থস্থানে শ্রাদ্ধে যত পুণ্যের সঞ্চয়।।
গুরু সেবায় ততধিক পুণ্য দান করে।
কহিলাম সার কথা সবার গোচরে।।

ব্রহ্মা বিষ্ণু আদি করি যত দেবগণ।
গুরু সব নাহি কেহ শুন সর্ব্বজন।।
গুরুই সবার মূল গুরু সর্ব্বেশ্বর।
গুরু পতি গুরু মতি গুরু যোগেশ্বর।।
গুরু বিনা কার্য্য করে হেন সাধ্য কার।
সদ্বর্ব দেব রূপ তিনি শাস্ত্রের বিচার।।
সবার প্রধান তিনি বেদের বচন।
গুরু তুষ্টে সর্ব্ব কার্য্য হইবে সাধন।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্তে গণেশ খণ্ডেতে বর্ণন।
সেই কথা কহিলাম করহ শ্রবণ।।

……………………………………..
তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী
-শ্রীশ্রী চরণ দাস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!