ভবঘুরেকথা
মা আনন্দময়ী

নবযুগের নারী

স্নেহের মা, নিজের জীবনটাকে ষোল আনা ভগবানের মধ্যে ডুবাইয়া না দিতে পারিলে আর কিছুতেই মনুষ্যজন্মের সার্থকতা সম্পাদিত হয় না। ভগবানকে নিজের মধ্যে পাওয়া এবং নিজেকে ভগবানের মধ্যে পাওয়াই হইতেছে সকল তপস্যার চরম সিদ্ধি, ইহাই জীবের পরম প্রাপ্তি। নারী ও পুরুষে এই বিষয়ে ব্যবস্থার ভেদ নাই। সকলেরই মুখ্য লক্ষ্য একমাত্র পরমাত্মায় আত্ম-সমর্পণ এবং আত্মায় পরমাত্মাকে দর্শন।

এই যে আত্মদর্শন, ইহারই মধ্য দিয়া নারীজাতির যথার্থ উন্নতি এবং যথার্থ স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে। এই আত্মদর্শনের মধ্যদিয়াই নারীর জীবন ঘৃণাভরে উপেক্ষিত দাসীর জীবন হইতে- ষড়ৈশ্বর্য্যশালিনী দিব্যদীপ্তিমালিনী কোটি-ব্রহ্মাণ্ড-পালিনী ভগবতীর জীবনে পরিবর্ত্তিত হইবে। সাধক-পুরুষ আজ যাহাকে তপো-বিঘ্ন-কারিণী বলিয়া বর্জ্জন করিতে প্রয়াস পায়, আত্ম-দর্শন তাহাকে পরমশ্লাঘনীয়া করিবে।

আজ যাহাকে পদসেবার কিঙ্করী বলিয়া গর্ব্বিত পুরুষ অবহেলা করে, আত্মদর্শন সেই নারীকে পুরুষের সর্ব্বার্থসিদ্ধিদাত্রী সুখসৌভাগ্যবিধাত্রী মহালক্ষ্মীতে পরিণত করিবে। আজ যাহাকে দেখিলে পুরুষের নীচ লালসা ও হীন প্রবৃত্তি ব্যতীত অপর কিছুই জাগ্রত হয় না, আত্মদর্শন তাহাকে সর্ব্বজনবরেণ্যা ত্রিভুবনধন্যা জগজ্জননীতে পরিণত করিবে।

আজ যাহাকে পুরুষ করে কদর্য্য সম্ভাষণ, আত্মদর্শন তাহাকে সসম্ভ্রম স্তুতির যোগ্যা করিবে; আজ যাহার প্রতি পুরুষ করে কদর্য্য ব্যবহার, আত্মদর্শন তাহাকে করিবে পুরুষ-জাতির পূজার দেবতা।

কথাটা দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইতেছি। মনে কর, একটী স্ত্রীলোক বলিল- ‘‘আমি স্বাধীন, সুতরাং কোনও বিষয়ে অপর কাহারও কর্ত্তৃত্বের ধার ধারিতে আমি বাধ্য নহি, আমার বিবাহ ইচ্ছামত হইবে, ইচ্ছামত ভাঙ্গিবে, জীবিকার্জ্জনের পথ আমি ইচ্ছামত গ্রহণ ও বর্জ্জন করিব, ইহার জন্য যদি আমার চরিত্রগতসম্পদের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু ঘটিয়া যায়, তবে তাহা আমারই ঘটিবে, এই বিষয়ে অন্য কাহারও কিছু বলিবার, কহিবার বা করিবার নাই।’’

স্ত্রী স্বাধীনতার আমি মা বড়ই পক্ষপাতী, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশসমূহের অনুকরণে আমাদের সমাজ-সংস্কারকগণ যাহাকে স্বাধীনতা বলিয়া প্রচার করিতে চাহিতেছেন, ঠিক্‌ তাহাকেই স্ত্রী-স্বাধীনতা বলিয়া গ্রহণ করিতে আমি কুণ্ঠিত হই। স্ত্রীজাতি পুরুষজাতির সহিত জীবনের প্রত্যেকক্ষেত্রে সমান অধিকার, সমান সুযোগ, সমান স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করিবে-

ইহা স্বাধীনতার একটা বহির্লক্ষণ মাত্র, কিন্তু ইহাই স্বাধীনতার সম্যক্‌ স্বরূপ নয়। স্বাধীনতার জন্ম হইতেছে আত্মদর্শনে, নিজেকে জানায়, নিজের সহিত ভগবানকে এবং ভগবানের সহিত নিজেকে ওতপ্রোতভাবে যোগযুক্ত অনুভব করায়।

স্বাধীনতার বহির্লক্ষণগুলি পরিদৃষ্ট না হইলেও, যিনি ইহা করিয়াছেন, সেই নারী স্বাধীন অর্থাৎ তিনি পুরুষের মত অফিসে চাকুরী করিয়া অর্থোপার্জ্জন না করিলেও স্বাধীন, ট্রাম, রেল, মটরকার বা সাইকেল না চালাইলেও স্বাধীন, ব্যবস্থাপক- সভায় জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে যোগদান করিয়া বিল পাশ করিবার চেষ্টা না করিলেও স্বাধীন অথবা জেলার জজ হইয়া বিচার-কার্য্য কিম্বা ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া শাসন পরিচালন না করিলেও তিনি স্বাধীন।

অপর পক্ষে আত্মদর্শন যাহার নাই, তিনি এ সকল ত’ সামান্য কথা, ইহা অপেক্ষা শতগুণ ঊর্দ্ধে উঠিয়া লম্ফঝম্ফ মারিলেও স্বাধীন নহেন। পুরুষের সহিত সমান পায়ে চলিতে পারা স্বাধীনতারই লক্ষণ নহে, সময়-বিশেষে পরাধীনতা হইতেও এই লক্ষণগুলি প্রকটিত হইতে পারে। যেমন ধর, একজন লোকের ঘন ঘন দাস্ত হয়, টাইফয়েড হইতেও দাস্ত হয়।

ভারতবর্ষে আজ মা স্বাধীনতারই দিন পরিয়াছে। ধর্ম্মে, কর্ম্মে, শিক্ষায়, সমাজে, সংস্কারে ও রাষ্ট্রে সর্ব্বত্র স্বাধীনতারই বিজয়-দুন্দুভি বাজিয়ে। ইহাই আজ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার অভিপ্রায়। তোমাদিগকেও এই স্বাধীনতার রুদ্রমন্ত্রে দীক্ষা লইতে হইবে। কিন্তু মা, মনে রাখিতে হইবে, সকল স্বাধীনতার মূল আত্মদর্শনে। নিজেকে জানিবার পূর্ব্বে কখনও প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ হয় না, স্বাধীনতার নাম করিয়া স্বৈরাচার ও ব্যভিচার হয় মাত্র।

কথাটা দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইতেছি। মনে কর, একটী স্ত্রীলোক বলিল- ‘‘আমি স্বাধীন, সুতরাং কোনও বিষয়ে অপর কাহারও কর্ত্তৃত্বের ধার ধারিতে আমি বাধ্য নহি, আমার বিবাহ ইচ্ছামত হইবে, ইচ্ছামত ভাঙ্গিবে, জীবিকার্জ্জনের পথ আমি ইচ্ছামত গ্রহণ ও বর্জ্জন করিব, ইহার জন্য যদি আমার চরিত্রগতসম্পদের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু ঘটিয়া যায়, তবে তাহা আমারই ঘটিবে, এই বিষয়ে অন্য কাহারও কিছু বলিবার, কহিবার বা করিবার নাই।’’

স্ত্রীলোকটী সত্য কথাই বলিয়াছে, প্রকৃতই নারীও পুরুষের ন্যায় সর্ব্ববিষয়েই স্বাধীন।

……………………………
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের নবযুগের নারী বর্তমান পত্রিকা থেকে
পুণঃপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরো পড়ুন:
মা সারদা দেবী
প্রজ্ঞাপারমিতা শ্রীশ্রীমা সারদা
বহুরূপিনী বিশ্বজননী সারদামণি
মা মনোমোহিনী
শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সপ্তসাধিকা
মাতৃময়ী তিনরূপ
নবযুগের নারী

মা আনন্দময়ী
আনন্দময়ী মায়ের কথা
ভারত উপাসিকা নিবেদিতা
রাসমণি
নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে
পূণ্যশীলা মাতা কাশীমণি দেবীর সাক্ষাৎকার
আনন্দময়ী মা
মা মারিয়াম :: পর্ব-১
মা মারিয়াম :: পর্ব-২
মা মারিয়াম :: পর্ব-৩
মা মারিয়াম :: পর্ব-৪
মীরার কথা
অলৌকিক চরিত্র মাদার তেরেসা
মা আনন্দময়ীর কথা
বৈষ্ণব সাধিকা যশোদা মাঈ
আম্মার সঙ্গলাভ
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!