ভবঘুরেকথা
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি

ফকির লালনের বাণী : সাধকদেশ

৮৫১.
চাতক পাখির এমনি ধারা
তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা।

৮৫২.
অন্য বারি খায় না তারা
মেঘের জল বিনে।

৮৫৩.
মন হয়েছে পবন গতি
উড়ে বেড়ায় দিবারাতি।

৮৫৪.
ফকির লালন বলে গুরুর প্রতি
ও মন রয় না সুহালে।

৮৫৫.
চাতক বাঁচে কেমনে।
মেঘের বরিষন বিনে।

৮৫৬.
কোথা হে নব জলাধর
চাতকিনী মলো এবার।

৮৫৭.
ঐ নামে কলংক তোমার
বুঝি রাখলে ভূবনে।

৮৫৮.
চাতক মলে যাবে জানা
ঐ নামের গৌরব রবে না।

৮৫৯.
জল দিয়া করো সান্ত্বনা
দাসে রেখো চরণে।

৮৬০.
তুমি দাতার শিরোমনি
আমি চাতক অভাগিনী।

৮৬১.
সমুদ্রের কিনারে থেকে
জল বিনে চাতকী ম’লো।

৮৬২.
হায়রে বিধি ওরে বিধি
তোর মনে কি ইহাই ছিলো।

৮৬৩.
নবঘন বিনে বারি
খায় না চাতক অন্য বারি।

৮৬৪.
চাতকের প্রতিজ্ঞা ভারি
যায় যাবে প্রাণ সেও ভালো।

৮৬৫.
চাতক থাকে মেঘের আশে
মেঘ বরিষণ অন্য দেশে।
বলো চাতক বাঁচে কিসে
ওষ্ঠাগত প্রাণ আকুল।

৮৬৬.
লালন ফকির বলে রে মন
হলো না মোর ভজন সাধন,
ভুলে সিরাজ সাঁইজীর চরণ
মানব জনম বৃথা গেল।

৮৬৭.
পাখি কখন যেন উড়ে যায়।
বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।

৮৬৮.
খাঁচার আড়া প’লো ধসে
পাখি আর দাঁড়াবে কিসে।

৮৬৯.
ওই ভাবনা ভাবছি বসে
চমক জ্বরা বইছে গায়।

৮৭০.
ভেবে অন্ত নাহি দেখি
কার বা খাঁচা কেবা পাখি,
আমার এ আঙ্গিনায় থাকি
আমারে মজাতে চায়।

৮৭১.
আগে যদি যেত জানা
জংলা কভু পোষ মানে না,
তবে উহার সঙ্গে প্রেম করতাম না
লালন ফকির কেঁদে কয়।

৮৭২.
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ক’মনে আসে যায়।

৮৭৩.
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।

৮৭৪.
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।

৮৭৫.
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।

৮৭৬.
কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার,
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।

৮৭৭.
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।

৮৭৮.
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।

৮৭৯.
চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি।

৮৮০.
ভেদ-পরিচয় দেয় না আমার
ওই খেদে ঝরে আঁখি।

৮৮১.
পাখি বুলি বলে শুনতে পাই
রূপ কেমন দেখি নে ভাই
বিষম ঘোর দেখি;
চিনাল পেলে চিনে নিতাম
যেত মনের ধুকধুকি।

৮৮২.
পুষে পাখি চিনলাম না
এ লজ্জা তো যাবে না
উপায় করি কী;
পাখি কখন যেন যাবে উড়ে
ধুলো দিয়ে দুই চোখি।

৮৮৩.
আছে নয় দরজা খাঁচাতে
যায় আসে পাখি কোন পথে
চোখে দিয়ে রে ভেল্কি;
সিরাজ সাঁই কয় লালন বয়
ফাঁদ পেতে ওই সিঁদমুখী।

৮৮৪.
কী এক অচিন পাখি পুষলাম খাঁচায়,
হলো না জনমভরে তাঁর পরিচয়।

৮৮৫.
আঁখির কোণে পাখির বাসা দেখতে নারে কী তামাশা,
আমার এ আঁন্ধেলা দশা কে আর ঘুচায়।

৮৮৬.
পাখি রাম রহিম বুলি বলে ধরে সে অনন্ত লীলে,
বলো তাঁরে কে চিনিলে বলো গো নিশ্চয়।

৮৮৭.
যারে সাথে সাথে লয়ে ফিরি তারে বা কই চিনিতে পারি,
লালন কয় অধর ধরি কী রূপধ্বজায়।

৮৮৮.
দেখ না এবার আপন ঘর ঠাউরিয়ে।
আঁখির কোণে পাখির বাসা
যায় আসে হাতের কাছ দিয়ে।

৮৮৯.
সবে বলে পাখি একটা
সহস্র কুঠুরিকোঠা আছে আল সঙ্গত হয়ে,
নিগুমে তার মূল একটি ঘর
অচিন হয় সেথা যেয়ে।

৮৯০.
ঘরে আয়না আঁটা চৌপাশে
মাঝখানে পাখি বসে আছে আড়া পাতিয়ে,
দেখ নারে ভাই ধরার জো নাই
সামান্য হাত বাড়ায়ে।

৮৯১.
কেউ দেখতে যদি সাধ কর
সন্ধানীকে চিনে ধর দেবে দেখিয়ে,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমায়
বুঝাইতে দিন যায় বয়ে।

৮৯২.
কারে দিব দোষ নাহি পরের দোষ।
আপন মনের দোষে আমি প’লাম রে ফেরে।

৮৯৩.
আমার মন যদি বুঝিত লোভের দেশ ছাড়িত
লয়ে যেত আমায় বিরজা পারে।

৮৯৪.
মনের গুণে কেউ হলো মহাজন
ব্যাপার করে পেল অমূল্য রতন।

৮৯৫.
আমারে মজালি ওরে অবোধ মন
পারের সম্বল কিছু রাখলাম না রে।

৮৯৬.
অন্তিমকালের কালে কিনা জানি হয়
একদিন ভাবলি না অবোধ মনুরায়।

৮৯৭.
মনে ভেবেছ এ দিন এমনি বুঝি যায়
জানা যাবে যেদিন শমনে ধরে।

৮৯৮.
কামে চিত্ত হত মন রে আমার
সুধা ত্যেজে গরল খাই বেশুমার।

৮৯৯.
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমার
ভগ্নদশা ঘটলো আখেরে।

৯০০.
কারে বলবো আমার মনের বেদনা।
এমন ব্যথায় ব্যথিত মেলে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!