ভবঘুরেকথা
সিরাজ শাহ্ বাবা

বাবা সিরাজ শাহ্

-মূর্শেদূল মেরাজ

১০ আশ্বিন ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের কুশিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম। পরবর্তী জীবনে সাধন সিদ্ধ হয়ে তিনি সিরাজ শাহ্ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার পিতা আব্দুর রাজ্জাক শাহ্ ও মাতা ছবুরুন নেছা।

জানা যায়, সিরাজ শাহ্’র পূর্বপুরুষ ইয়েমেন থেকে এদেশে আসেন। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের কুশিয়ারা গ্রামে বসতি স্থাপনের পর কয়েক পুরুষ ধরে সেখানেই বসবাস করে আসছেন।

সিরাজ শাহ্’র প্রপিতামহ সৈয়দ ফরজ আলী ঢাকার নবাব সলিমুল্লহ্’র অধিনস্থ সোনারগাঁ পরগনার জমিদার মৌলবী আবুল খায়েরের নায়েব ছিলেন। সৈয়দ ফরজের পুত্র সৈয়দ আবদুল হামিদ চিশতীয়া তরিকায় দাখিল হয়ে সাধনায় সিদ্ধ হয়ে ‘সৈয়দ আবদুল হামিদ চিশতী’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তারই বংশধারায় আলোকিত এক নাম সিরাজ শাহ্। ভক্তের কাছে তিনি দয়াল সিরাজ শাহ্ বাবা।

শৈশবে মাকে হারিয়ে সিরাজ শাহ্’র মনের মাঝে যে শূন্যতা ও নি:সঙ্গতা তৈরি হয়। তাতেই তার মাঝে এক ধরনের নিজের ভেতরে মগ্ন হওয়ার ভাবের উদয় হয়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ধর্মীয় শিক্ষায়ও তালিম নেন ছোটবেলা থেকেই। তবে স্কুলে আশাযাওয়ার পথে ছোটবেলা থেকেই বাড়ির আশপাশের পাগল-মস্তানরা তাকে পড়াশোনা না করে তাদের দলে যোগ দেয়ার আহ্বান করত বলে জানা যায়। এমনকি গভীররাতে পাগলরা তার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে তাদের সাথে যাওয়ার আহ্বান করতো।

শুধু পাগল-মস্তানরা নয় অনেকেই তার মাঝে ছোটবেলা থেকেই অলি হয়ে ওঠার আভাস পেয়েছেন। এমনি তার শিক্ষকরাও তাকে বিশেষ স্নেহ ও শ্রদ্ধা করতো বলে জনশ্রুতি আছে। যখন বয়স তার সবে তের কি চৌদ্দ সেই সময়ই পিতা রাজ্জাক শাহ্ তাকে নিয়ে মাটির নিচে ৪১ দিন করে চিল্লা শুরু করেন। সেসময় তিনি তিনবেলা একটি করে তিলের তেলের রুটি খেয়ে এবাদতে মগ্ন থাকতেন। বাবা রাজ্জাক শাহ্ ছিলেন ‘গাউছ দরবার’এর গদ্দিনশীন পীর।

সিরাজ শাহ্ নিজ নকশায় নারায়ণগঞ্জের বন্দরে মাজার শরীফ ‘সিরাজ শাহ্’র আস্তানা’র কাজ শুরু করেন। মাজারের মূলভাগ অর্থাৎ মাজারের অংশটি তিনি ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করে রাখেন। জানা যায়, সেখানে বসেই তিনি ইবাদত-ধ্যান-জিকিরে মগ্ন থাকতেন। আর বলতেন, ‘এই কবরেই আমাকে সমাধি করা হবে।’

১৯৬১ সালে ২৮ বছর বয়সে ফয়জুন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সিরাজ শাহ্। তখন তিনি পাইকপাড়ায় ভাড়াবাসায় থাকতেন। আর তার পিতা পরিবার নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগে। সংসার চালানোর জন্য সিরাজ শাহ্ এসময় বেশকিছূ ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করলেও দুনিয়ার মোহমায়ায় আবিষ্ট না থাকায় সেসবকের প্রায় কোনটাতেই সফলকাম হননি।

১৯৬৯ সালের দিকে পিতা রাজ্জাক শাহ্‌ মৃত্যুশয্যায় তাকে দেওভোগ ‘গাউছ দরবার’-এর মতোওয়াল্লী ও গদ্দিনশীন নিয়োজিত করেন। তিনি নিষ্ঠার সাথে সেই পবিত্র দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আপন সাধন-ভজন চালিয়ে যান।

পরবর্তীতে তার মামা তাকে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে ‘কাদরিয়া ভাণ্ডার’-এর মোতওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। সিরাজ শাহ্ ১৯৮৩ সালে বাগদাদ শরীফে গাউছ পাকের খেদমতে যান। সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে দেশে ফিরে আরো কিছু জায়গা কিনে ১৯৮৪ সালে কাদরিয়া ভাণ্ডারে ‘সিরাজ শাহ্’র আস্তানা’ নামে দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এই দরবার ‘কাদরিয়া ভাণ্ডার সিরাজ শাহ্ আস্তানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

সিরাজ শাহ্ নিজ নকশায় নারায়ণগঞ্জের বন্দরে মাজার শরীফ ‘সিরাজ শাহ্’র আস্তানা’র কাজ শুরু করেন। মাজারের মূলভাগ অর্থাৎ মাজারের অংশটি তিনি ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করে রাখেন। জানা যায়, সেখানে বসেই তিনি ইবাদত-ধ্যান-জিকিরে মগ্ন থাকতেন। আর বলতেন, ‘এই কবরেই আমাকে সমাধি করা হবে।’

এই অপরূপ সৌন্দর্যের দরবার শরীফে সিরাজ শাহ্’র অগুণিত ভক্ত-মুরিদ-আশেনাকে প্রায় সকল সময়ই মুখরিত থাকে। আর উৎসব-ওরশের সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সিরাজ শাহ্’র আস্তানা।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে দয়াল বাবা সিরাজ শাহ্ দেহত্যাগ করেন। তার দেহত্যাগের পর তার হাতে খেলাফত প্রাপ্ত তারই পুত্র শামীম সিরাজ শাহ্ গদ্দিনশীন আছেন। বর্তমানে তারই তত্ত্বাবধানে কাদেরিয়া ভাণ্ডারের নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় নানা অনুষ্ঠান-উৎসব। তারমধ্যে-

সপ্তাহের প্রতি সোমবার বাদ মাগরিব মুর্শিদ কেবলা বাবা সিরাজ শাহ্’র ওফাত বারে ফাতেহা শরীফ, জিকির আসকার ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শরীফ খতম, বাদ মাগরিব পবিত্র মিলাদ মাহফিল, ফাতেহা শরীফ ও জিকির মাহফিল।

প্রতি চন্দ্র মাসের ১০ তরিখ দিবাগত রাতে পবিত্র এগার শরীফ। বাদ মাগরিব।

প্রতি ইংরজি মাসের প্রথম শুক্রবার পবিত্র ‘দরূদ শরীফ’ ও পাক কালাম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ খতম, জিকির, মিলাদ মাহফিল এবং মোনাজাত। এইদিন ভোরে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

৪-৫ ফেব্রুয়ারি পবিত্র বার্ষিক ওরশ উদযাপন।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন। ভোর থেকে।

পয়লা রমজান গাওসুল আজমের পবিত্র জন্মদিন উদযাপন ও ইফতারের আয়োজন।

৬র জব সুলতানুল হিন্দ গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনু্দ্দীন চিশতীর পবিত্র ওরশ মোবারক উদযাপন। বাদ এশা।

পবিত্র ফতেহা ইয়াজদাহম উদযাপন। বাদ এশা।

পবিত্র আশুরা উদযাপন। বাদ যোহর ফাতেয়াখানি।

১০ আশ্বিন সিরাজ শাহ্’র জন্মদিনকে ভক্ত-মুরিদ ও আশেকানগণ ‘খোশরোজ হিসাবে যথাযথ মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে থাকে। বাদ আছর মিলাদ মাহফিল।

এছাড়া বছরব্যাপীই তরিকতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ নিয়মিত জিকির-আসকার, মিলাদ মাহফিল, তসবিহ-তাহলিল পাঠ যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।

…………………………………..
সিরাজ শাহ্ আস্তানার বাৎসরিক ওরশ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!