ভবঘুরেকথা
বিথঙ্গল আখড়া

এই দেশেতে এই সুখ হলো
আবার কোথায় যাই না জানি।
পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী
জনম গেল সেচতে পানি।।

লালন সাঁইজির গানের এই লাইনগুলো খুব মনে পরছিল যখন … বাজার থেকে আমরা নদীপথে হাওরের দিকে ছুটছিলাম। শাহিন ভাই এমন এক ভাঙা নৌকা ব্যাবস্থা করছে যে নৌকায় উঠার পর আমরা বুঝতে পারছি না এই নৌকা হাওর পারি দিতে পারবে কিনা। জরাজীর্ণ নৌকাটির বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি ঢুকছে দেদারসে। একটু নড়াচড়া করলেই মাঝি জোরে জোরে মাথা নাড়া শুরু করে। এই মাথা নাড়ার অর্থ হচ্ছে নড়াচড়া করা যাইবো না নড়লেই ডুইবা যাইবো। এতো জোরে জোরে মাথা নাড়ছে যে ঘাড় থেকে যে কোনো সময় মাথা খুলে ছুটে আসতে পারে আমাদের দিকে।

আমরা কাঠের পুতুলের মতো বসে আছি। নো নড়াচড়া। বর্ষার শেষ মুহূর্ত পানি নেমে গেছে। এই বেলায় নদীর পরন্ত যৌবন। তারপরও পানি কিন্তু নেহায়াত কম না। আমাদের সতর্ক চোখ ততক্ষণে দেখতে শুরু করেছে নৌকার আর কোথায় কোথায় ফাটল আছে। অল্প সময়েই তা বাদ দিতে হলো কারণ ফাটল এমন সব জায়গাগুলোতে দেখা যাচ্ছে তা বেশিক্ষণ দেখলে এই নৌকায় বসে থাকা মুষ্কিল হয়ে যাবে। তবে শাহীন ভাই ব্যাপক খুশি নৌকার ফাটল দেখে, হাসি হাসি মুখে বেশ উৎসাহ নিয়ে আমাদের ফাটল দেখাচ্ছে… ভাঙা নৌকা খুঁজে বের করার জটিল ও কঠিন কাজটি করে শাহীন ভাই পরম তৃপ্ত কেন তা ঠিক বোঝা গেলো না। ভাঙা নৌকা কি এ্যাডভেঞ্চারের অংশ। ভ্রমণ শেষে রশিয়ে রশিয়ে লেখা যাবে আমরা ভাঙা নৌকায় হাওর পারি দিয়েছি? কে জানে তবে আপাতত শক্ত হয়ে বসে থাকা আর গুণগুনিয়ে গেয়ে যাওয়া… পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী/জনম গেল সেচতে পানি।।


শাহিন ভাই বেশ কায়দা করে জায়গা করে আমাকে শুইয়ে দিলেন। ঢেউ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারি বলে ছোট মানুষের মতো ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছে যেন। আমিও সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে ব্যাগে মাথা দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। নৌকা দুলছে… মাঝে মাঝে মরমর করছে… মাঝি তার হাসি হাসি মুখে বসে আছে…

আঁকাবাঁকা নদীপথ ধরে আমাদের ভাঙা নৌকা চলছে দুলে দুলে। দুপুরের খাওয়াটা আমরা সেরে নিয়েছি বানিয়াচং … বাজারে… তারপর অটো চেপে … বাজার… এখন আমাদের সঙ্গে রয়েছেন কাওসার ভাই। হাসি খুশি কাওসার ভাইকে নিয়ে এখন আমরা পাঁচ জন। সঙ্গে ১৭/১৮ বছর বয়সী মাঝি আর মাঝির সাগরেদ ৯/১০ বছরের ছোট্ট ছেলে। এই ভাঙা নৌকা করেই তারা পুরো বর্ষা পারি দিয়েছে এই উত্তাল হাওর পথ। বিশ হাজার টাকা দিয়ে এই নৌকাটি কিনেছে মাঝি বর্ষার আগে। আগামী বর্ষায় এই নৌকা ভেঙে নতুন করে বড় ট্রলার বানাবে। ইঞ্জিনের তীব্র শব্দে মাঝির সাথে আর আলাপ জমাতে পারলাম না। অবশ্য ইতিমধ্যে আমরা নদী থেকে হাওরে পরেছি। আজ হাওর উত্তাল… নৌকা দুলছে… ঢেউ-এর পানি ছিটকে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে ছৈ-এর ভেতর পর্যন্ত। ভাগ্নে মদন কিন্তু করকর করেই যাচ্ছে। তাকে যতই বলা হচ্ছে নড়াচড়া করতে না সে ততই করছে। এমনি এমনি কি আর মদন। সে একাই কথা বলে যাচ্ছে। কাওসার ভাই ফোনে কথা বলে যাচ্ছে নিচু স্বরে। এলেন ভাই এরই ফাকে ঘুমিয়ে পরেছে। ঢেউ ক্রমশ বড় হচ্ছে… দুলুনি বাড়ছে নৌকায়… শাহিন ভাই বেশ কায়দা করে জায়গা করে আমাকে শুইয়ে দিলেন। ঢেউ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারি বলে ছোট মানুষের মতো ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছে যেন। আমিও সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে ব্যাগে মাথা দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। নৌকা দুলছে… মাঝে মাঝে মরমর করছে… মাঝি তার হাসি হাসি মুখে বসে আছে… তার সাগরেদ অনবরত নৌকা সেচে যাচ্ছে… ভাগ্নে করকর করছে… কাওসার ভাই ফোনে কথা বলেই চলছে… এলেন ভাইয়ের নাক ডাকার নিচু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে… শুধু শাহিন ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বেশ আয়োজন করে পান খাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম… নিজেকে শান্তনা দিতে লাগলাম এখন হাওরে ঢেউ থাকলেও পানি নেমে গেছে… এখানে বেশি পানি হবে না… হয়তো কোমড় পানি… কিন্তু মন কি মানে… গত রাতে ঘুম হয়নি… দুলনিতে এক সময় তন্দ্রার মতো এসে গেলো… সাইধা বিপদে পরতেই আমি বারবার শাহিন ভাই-এর সঙ্গ নেই? হায়রে এরে কয় বেড়ানো? যাক কি আর করা… চলার নামই তো জীবন কোথায় যেনো পরেছিলাম… এখন আর মনে পরছে না… তার বদলে মনে পরছে আসলেই কি এখানে কোমড় পানি নাকি বুক পানি নাকি ঠাই নেই!!!

নৌকা চলছে বিথলঙ্গের আখড়ার উদ্দেশ্যে। বানিয়াচং সত্য সত্যই বিশাল গ্রাম… যতদূর দেখা যাচ্ছে সবটাই নাকি বানিয়াচং-এর মধ্যে পরেছে জাননাম কাওসার ভাই-এর কাছ থেকে। নদী পার হয়েও হাওর দিয়ে এই যে চলছি তো চলছিই যেন এর শেষ নেই কখন যেয়ে পৌঁছাবো কে জানে… মাঝি অবশ্য বলেছিল ঘণ্টাখানেক লাগবে… যদিও ঘণ্টাখানেক অনেক আগেই দৌঁড়ে পালিয়েছে… আমাদেরকে আবার এ পথেই ফিরতে হবে… এবং এই ভাঙা নৌকা দিয়েই… রক্ষা করো…


রাস্তার বাম পাশে বিশাল বিশাল বিশাল এক ঘাট… পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি ঘাটের বাম পাশে ও দৃষ্টির সোজাসুজি আদিগন্ত হাওর… পানি কমে যাওয়ায় দূরে দূরে দুই একটা গাছের শির্ষ ভাগ নজরে পরছে। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ নিচে থৈ থৈ পানি বিশাল ঘাট… এ যেন এক স্বর্গীয় ভূমি। এক কথায় অস্বাধারণ। ঘাটের উল্টো দিকে বিথলঙ্গের আখড়ার প্রবেশ পথ…

অনন্তকাল শেষে এক সময় দূরের সবুজ লাইনটা একটা ভূমির অস্তিত্ব প্রমাণ করলো… দুলতে দুলতে শেষ বিকেলের অপরূপ আলোতে আমরা পৌঁছুলাম …. বাজারের ঘাটে… বাজারটি বিশাল হলেও পরন্ত বেলায় আর প্রাণ নেই… মানুষজনও কম… বাজারের মাঝ দিয়ে অল্প কিছুটা হাঁটার পরই আমরা পৌঁছালাম অসাধারণ সৌন্দর্যময় এক জায়গায়। বিস্ময় কাটিয়ে উঠার পর দেখলাম… রাস্তার বাম পাশে বিশাল বিশাল বিশাল এক ঘাট… পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি ঘাটের বাম পাশে ও দৃষ্টির সোজাসুজি আদিগন্ত হাওর… পানি কমে যাওয়ায় দূরে দূরে দুই একটা গাছের শির্ষ ভাগ নজরে পরছে। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ নিচে থৈ থৈ পানি বিশাল ঘাট… এ যেন এক স্বর্গীয় ভূমি। এক কথায় অস্বাধারণ। ঘাটের উল্টো দিকে বিথলঙ্গের আখড়ার প্রবেশ পথ… ঘাটটিও আখড়ারই অংশ। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে লোহার সদর দরজা পারি দিয়ে প্রবেশ করতে হবে আখড়ার ভেতর। আমরা কিছুটা সময় নিলাম নিজেদের ধাতস্থ করতে… শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখা বিথলঙ্গের আখড়ার সেই মোহনীয় ঘাট। ভরা বর্ষায় এখানে এক পূর্ণিমা রাতে থাকতে পারলে স্বর্গের স্বাদ পাওয়া যাওয়ার সম্ভবনা আছে তাতে আমাদের দ্বিমত রইলো না কারো। হাতে সময় নেই শাহিন ভাই মনে করিয়ে দিলো… তারাতাড়ি আখড়া দেখে নিতে হবে তারপর সন্ধ্যার আগেই হাওর পারি দিতে হবে… বুঝো এবার, যদি শান্তি মতো দেখতেই না পারি তাহলে আর আসা কেনো বাপু। কেবল এটুকু বলার জন্য যে আমরা বিথলঙ্গের আখড়ায় গিয়েছিলাম? নাকি এর মাটিতে পায়ের ছাপ রেখে যাওয়া? এর উত্তর আমাদের জানা নেই… পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পথ ধরে আমরা প্রবেশ করলাম আখড়ার ভেতরে… বাইরে থেকে যতটা ভাগগাম্ভীর্য পূর্ণ এই আখড়া ভেতরে আরো বেশি… কিন্তু সময়ের ভারে এবং সংস্কারের অভাবে বিশাল জায়গা নিয়ে বিস্তৃত আখড়াটি আজ ভগ্ন প্রায়… এর বেশিভাগ অংশই এখন আর ব্যবহার করা হয় না তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবহেলার চিহ্ন সুস্পষ্ট। এতোক্ষণে এলেন ভাই ক্যামেরা বের করেছে… ফটাফট ছবি তুলছে… আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি আখড়ার দুই মহলা আঙিনা… সাড়ি সাড়ি ঘর… টানা বারান্দা… বিশাল বিশাল থাম… চারপাশের বিশাল বিশাল থামের পরে টানা বারান্দা তারপরই আয়তকার অসংখ্য ঘর আর মাঝে প্রায় বর্গাকৃতির বিশাল উঠানের ঠিক মাঝে বাংলার দোচালা স্থাপত্য রীতিতে উপরে টিনের আর নিচে পাকা বিশাল দুটি কক্ষ… বর্তমান মূল আখড়া এ’দুটিই… মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ আমরা বিমোহিত…  আমরা ঘুঁড়ে ঘুঁড়ে দেখছি… তো দেখছি… যেনো শেষ নেই… এরই মাঝে আখড়ার লোকজনের সাথে কথা হলো… জানতে পারলাম… এই আখড়ায় বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের জন্য ১২০ টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে একজন করে থাকবার ব্যবস্থা। এখন অবশ্য অল্প কয়েকটিই ব্যবহার উপযোগী। আখড়া ঘুড়তে ঘুড়তে আমরা পেয়ে গেলাম আখড়ার সাধান বাবুকে। তার কাছ থেকেই জানা গেলো… এই আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী। তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থ সফর পরে ষোড়শ শতাব্দীতে এ স্থানে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয় এই আখড়া। রামকৃষ্ণ গোস্বামীর ধর্মমত বৈষ্ণব হলেও এই আখড়ার ভক্তরা চৈতন্যদেবের অনুসারী নয়। রামকৃষ্ণ গোস্বামী চৈতন্যদেবের শতবছর পূর্বে এই বৈষ্ণব মত প্রচার করেন। তাই তার ধর্মমত চৈতন্যদেবের ধর্মমত থেকে ভিন্ন। তার সময় এবং তার দেহ ত্যাগের পরেও এই আখড়া ছিল জমজমাট। সাধু-সন্ন্যাসীদের আশ্রম। দূর-দূরান্ত থেকে তখনকার মতো এখনো মানুষ এখানে আসে বিভিন্ন মানত করতে। ভক্তরা বিশ্বাস করে এখানে মানত করলে বিফল হয় না। বিভিন্ন আশাপূরণের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আগে রোগমুক্তির আশায়। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আমাদের সামনেই দেখলাম দু’এক জন রুগী এসেছে মহন্তর কাছ থেকে দোয়া নিতে। এক ফাঁকে মহন্তর সাথেও দেখা হলো আমাদের। ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সময় দিলেন আমাদের।

সূর্য ঢলে পরছে আমদের দলনেতা তাড়া দিতে শুরু করেছে সাথে মাঝি বেটাও এসে হাজির সেও নিচু স্বরে বলে বেড়াচ্ছে… তাড়াতাড়ি চলেন রাস্তা ভালো না বাতাস ছাড়ছে… দিন থাকতে থাকতে রওনা দিতে হইবো… আমার অবশ্য এখান থেকে একবারে যেতে ইচ্ছে করছে না। মুগ্ধতা এখনো কাটেনি। ভালো করে ইতিহাসটুকু শোনা হলো না… বিশাল রথটাও দেখা হলো না… বাজারটা ঘুরে দেখা হলো না… ঘাটে বসে জমিয়ে আড্ডা দেয়া হলো না… এমন তাড়াহুড়ো করলে হয়? আমরা যেনো শুনছিই না যে যেতে হবে… সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলাম… ঘুড়ে দেখছি যে যার মতো। আখড়ার একটি অংশ সংস্কারের কাজ চলছে। সংস্কার!!! এ সংস্কার চোখে দেখা যায় নারে ভাই… এমন অপরূপ কারুকার্য এমন একটা স্থাপত্য প্যালাস্তারার নিচে ঢাকা পরে সস্তা দরের সিমেন্টে লেপন হচ্ছে যে তা সহ্য করা সম্ভব নয়। জায়গায় জায়গায় ভেঙে ভেঙে নতুন করে সস্তাদরের ঘর বানানো হচ্ছে। কি আর বলা… আমরা আর কি বলতে পারি… আখড়ার লোকজন এতেই সন্তুষ্ট যে সংস্কার তো হচ্ছে… থাকবার ভালো ঘর দরকার… ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখানে বড় বিষয় নয়…

সূর্য ডুবুডুবু করছে… নৌকা চলছে… মাঝে মাঝেই উত্তাল ঢেউ… নৌকার মটমট ধ্বনি… সব কিছু ছাপিয়ে আবারে সাইজির গান…

এই দেশেতে এই সুখ হলো
আবার কোথায় যাই না জানি।
পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী
জনম গেল সেচতে পানি।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!