ভবঘুরেকথা
প্রজাপিতা ব্রহ্মা

প্রজাপিতা ব্রহ্মা মহাশয়ের প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মকুমারী মতে বলা হয়েছে, যদি মনুষ্যাত্মার পশু-পক্ষী ইত্যাদি ৮৪ লক্ষ যোনি ভোগ করিবার পর দুর্লভ যোনিতে জন্ম হইত তাহা হইলে তাহার দু:খ ভোগ করিবার কথা নয়, বরঞ্চ সুখ ভোগ করিবারই কথা। কিন্তু দেখা যায় যে মনুষ্যাত্মা দু:খ ভোগ করে আর সুখও ভোগ করে। অতএব এই যুক্তি ঠিক নয় যে দু:খ ভোগ করিবার জন্য মানুষকে পশু-পক্ষী ইত্যাদি যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হয়। মনুষ্য যোনিতেই অনেক প্রকার দু:খ আছে; মনুষ্যাত্মাকে দু:খ ভোগ করিবার জন্য পশু যোনিতে যাইতে হয় না। আপনি দেখিবেন যে মনুষ্য জীবনে যত প্রকারের দু:খ আছে, পশু যোনিতে তত প্রকারের দু:খ নাই। উদাহরণ স্বরূপ, ক্রমবর্ধমান সরকারি ট্যাক্স, দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্যতা ইত্যাদির চিন্তা, সন্তান-সন্ততিদের ভরণ-পোষণ, তাহাদের শিক্ষা এবং বিবাহ ইত্যাদির চিন্তা কেবল মনুষ্যেরই আছে। পশু-পক্ষী এই প্রকার চিন্তা হইতে মুক্ত। পশু-পক্ষীদের মান-অপমান, বেশ-ভূষা, ঘর-বাড়ি, খাট-পালঙ্ক, দাস-দাসী, মামলা-মোকদ্দমা, পরীক্ষার চিন্তা, পুলিশের অবস্থা, বেদনা, চিন্তা, চেষ্টা, আবশ্যকতা, কামনা বাসনা, হা-হুতাশ আছে যাহার জন্য মনুষ্যের জীবন সর্বদা দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে। ইহা ছাড়া রোগ-শোক, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা হিংস্র জীবের দ্বারাও মানুষ বহুপ্রকারের দু:খ ভোগ করিয়া থাকে। তাহা হইলে যখন মনুষ্য যোনিতেই মনুষ্যাত্মার বহুপ্রকারের দু:খ ভোগের ব্যবস্থা আছে তখন যোনি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কেমন করিয়া মানিয়া লওয়া যায়? ইহা ছাড়া আমরা প্রায়ই দেখি যে অনেক পশু-পক্ষী কোন কোন মনুষ্য হইতেও অধিক সুখি।

উদাহরণস্বরূপ, রেসের ঘোড়া অথবা গৃহপালিত কুকুরের উপর লোকে বহু অর্থ খরচ করে। ধনীর কুকুর গাড়ি চড়িয়া বেড়ায় এবং অনেক ভাল ভাল খাদ্য খায়। কিন্তু আজ সংসারে লক্ষ-লক্ষ মানুষ ক্ষুধায় কাতর হইয়া রাস্তায় বসিয়া আছে। এক টুকরো রুটির জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতেছে। রেসের ঘোড়ার শিক্ষক, তত্ত্বাবধানকারী লোক এমন কি ডাক্তারের পর্যন্ত বন্দোবস্ত আছে। এক একটি ঘোড়ার মূল্য এত যে মানুষের মূল্য তুলনায় যোগ্য নয়। এক একটি ঘোড়ার পরিচর্যা করিবার জন্য বেশ কিছু লোক নিযুক্ত হইয়া থাকে। এমন অনেক লোক আছে যাহাদের ভাগ্যে দুধ বা ঔষধ জোটেই না। অতএব ইহা স্পষ্ট যে মনুষ্যাত্মা মনুষ্য যোনিতেই সুখ ও দু:খ ভোগ করিয়া থাকে। আত্মার যোনি পরিবর্তনের যুক্তি হইতেছে মনুষ্য পশু পক্ষী হইতে অধিক সংবেদনশীল। যেমন ধরুন কোন মানুষ কোন সভা সমিতিতে দুই একটি অপমানসূচক শব্দ শুনিয়া এমনই আত্মাশ্লাঘা বা অপমান বোধ করে যে তাহার হৃদয়ের স্পন্দন হয়ত চিরদিনের মত থামিয়া যায়, অথচ একটি গর্ধভকে দণ্ডদ্বারা আট দশ বার আঘাত করিলেও সে তত দু:খবোধ করে না। সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে মানুষকে পাপ ভোগ করিতে অন্য যোনিতে যাইতে হয় না বরং অধিক সংবেদনশীল হওয়ার জন্য মনুষ্য সামান্য কারণে মনুষ্য যোনিতেই অধিক দু:খ ভোগ করিয়া থাকে।

…ভগবান বলিতেছেন, অন্তিম সময়ে মনুষ্যের যেমন স্মৃতি হয়, সেইরূপ বাসনা সে সঙ্গে লইয়া যায়, কিন্তু জন্ম হয় মনুষ্য যোনিতেই। যেমন, কেহ কাম বাসনা লইয়া যদি মরে, তাহা হইলে পরের জন্ম সে মনুষ্য শরীরই ধারণ করে কিন্তু তাহার কাম বাসনা অধিক হয়। বস্তুত: সংস্কার, বৃত্তি এবং বাসনার ফলস্বরূপ মনুষ্যাত্মা পশুর মত দেহ ধারণ করে না। মনুষ্যের দেহই ধারণ করে, কিন্তু তাহার মন ও আচরণ হয় পশুর মতো। আবার মনুষ্য কুকর্মের ফলস্বরূপ যদি পশু যোনিতে জন্মগ্রহণ করিত তাহা হইলে দিনে দিনে জনসংখ্যাও এত বাড়িত না। কখনো কখনো সমাচার পত্রে দেখা যায় যে কোন কোন মনুষ্যাত্মা পূর্বজন্মের কথা বলিতেছে। যেমন পূর্বজন্মে তাহার কে মাতা বা কে পিতা ছিল; কেহ হয়ত তাহার পূর্বজন্মের স্ত্রীর কথা বলিতেছে ইত্যাদি। কিন্তু এ পর্যন্ত এইরূপ সমাচার কোন পত্রে ছাপিতে দেখা যায় নাই যে কেহ বলিতেছে যে সে পূর্বজন্মে পশুর সন্তান ছিল। অতএব এই সমস্ত বিচার করিলে ইহাই সিদ্ধ হয় যে মনুষ্যাত্মার পশু যোনিতে জন্ম হয় না।

…সর্বপ্রথমে সত্যযুগ। সত্যযুগী সৃষ্টিই স্বর্গ বা বৈকুণ্ঠ নামে পরিচিত। ঐ সময় শ্রীনারায়ণ এবং তাহার বংশধরদের রাজ্য হয়। ১২৫০ বৎসরের এই যুগে শ্রীনারায়ণের আত্মার কূল ৮জন্ম ধরিয়া সূর্যবংশী রাজা-রাণী বা রাজবংশের সদস্যরূপে রাজত্ব করেন। তাহাদের প্রথম জন্মে আয়ুষ্কাল ১৫০ বৎসর হয়। তাহারা ১৬ কলা, সম্পূর্ণ নির্বিকারী, সর্বগুণসম্পন্ন ও পুরুষোত্তম ছিলেন। এইজন্য তাহাদিগকে দেবতাবর্ণ বা সত্ত্ব:প্রধান বলিয়র গণ্য করা হয়। এই যুগের রাজকূলের সদস্য সংখ্যা ১৬১০৮ এবং প্রজার সংখ্যা ৯ লক্ষ। অতএব মোট জনসংখ্যা ৯,১৬,১০৮।

ইহার পর ত্রেতাযুগ। এই যুগের দেবতাদের আয়ুষ্কাল ১২৫ বৎসর হইতে ১০০ বৎসরের মধ্যে হয়। ১২৫০ বৎসরের সেই যুগে শ্রীনারায়ণের আত্মা প্রায় ১২ জন্ম ধরিয়া চন্দ্রবংশী রাজা-রাণী বা রাজকূলের সদস্য রূপে রাজত্ব করেন। এই যুগে উহাদের আত্মা ১৪ কলা, সম্পূর্ণ নির্বিকারী হয় এবং শ্রীসীতার রাজ্য হয়। এই যুগেও রাজকূলের সদস্যসংখ্যা হয় ১৬,১০৮। কিন্তু প্রজার সংখ্যা হয় ৩৩ কোটি। অতএব মোট জনসংখ্যা হয় ৩৩,০০,১৬,১০৮। সত্য ও ত্রেতা যুগে সম্পূর্ণসুখ বিরাজমান থাকে। এই উভয় যুগে প্রকৃতিও যথাক্রমে সত্ত্ব প্রধান ও সত্ত্বগুণী হয় এবং জীবজন্তু, পশু পক্ষীও অনুরূপভাবে সুখি হয়।

ত্রেতা যুগের অবসানে দ্বাপর যুগ শুরু হয়। এই যুগে সত্ত্বগুণী ক্ষত্রীয়দের আত্মা ক্রমশ: দেহ অভিমানী এবং বিকারী হইয়া পরে, আর তাহার ফলে তাহারা দেবপদ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পূজারী মনুষ্যের অবস্থা প্রাপ্ত হয়। তাহাদের এই রজ:প্রধান স্থিতির জন্য তাহাদের বর্ণকে বৈশ্য বর্ণ বলা হয়। ১২৫০ বৎসরের এই যুগে ভক্ত শিরোমণী রাজা-রাণী অথবা উচ্চকূলের প্রজারূপে তাহারা ২১ বার জন্মগ্রহণ করে। সর্ব্বপ্রথম তাহারা নিরাকার শিবের পূজা আরম্ভ করে। ক্রমশ: তাহারা রজ:গুণী অবস্থা হইতে রজ: প্রধান অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং যতই দিন যায় ততই পতিত হইতে থাকে। ফলে নিজেদেরই পূর্ব্বস্বরূপ যথা শ্রীলক্ষ্মী ও শ্রীনারায়ণ অথবা শ্রীরাম ও শ্রীসীতার পূজা করিতে থাকে। ক্রমশ: অন্যান্য দেবী দেবতার পূজা অর্চ্চনা শুরু হইয়া যায় এবং শাস্ত্র তৈয়ারী হয়। এইরূপে ভক্তিও অব্যভিচারী হইতে ব্যভিচারীতে পরিণত হয়, অর্থাৎ এক পরমাত্মাকে ভক্তি না করিয়া অনেকেও ভক্তি করিতে থাকে।

দ্বাপর যুগের পর আসে কলিযুগ। এই যুগে মায়ার অর্থাৎ পাঁচবিকার যথা কাম, ক্রোধম লোভ, মোহ এবং অহঙ্কারের প্রকোপ সৃষ্টির উপর দিন-দিন বাড়িতে থাকে। ক্রমশ: মনুষ্যাত্মা তোমগুণী অবস্থা হইতে তমোপ্রধান অবস্থায় উপনীত হয়। অতএব সকল নরনারীই তমোগুণী শূদ্র বর্ণের হয় এবং পূজারী রাজা-রাণী অথবা প্রজা রূপে ৪২ বার জন্মগ্রহণ করে। এই যুগে ভক্তি এতই ব্যভিচারী হইয়া পরে যে অগ্নি, জল, বৃক্ষ, প্রস্তর ইত্যাদিও পূজা-অর্চনা হইতে থাকে। দ্বাপর ও কলিতে জনসংখ্যা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাইয়া কলির অন্তে ৬০০ কোটিরও অধিক জনসংখ্যা হয়। প্রজার উপর প্রজার শাসন হয়। ফলে অনুশাসন-হীনতা, মতভেদ, ধর্মভেদ, ভাষাভেদ প্রভৃতি সমস্যার উৎপত্তি হয় এবং মানুষের জীবন দু:খের চরম শিখরে উঠে। ভারতের অবস্থা একেবারে জর্জরীভূত হয়। যে ভারত স্বর্গ ছিল, পরমাত্মার সহিত যোগ রহিত হওয়ায় সেই ভারত শশ্মানে পরিণত হয়।

এইরূপে সত্যযুগী শ্রীনারায়ণ যখন কলিযুগের অন্তিমজন্মে বাণপ্রস্থ অবস্থায় উপনীত হন, তখন তাঁহার শরীরে পরমপিতা পরমাত্মা শিব অবতরণ করেন এবং সহজ-গীতা জ্ঞান ও রাজযোগ শিক্ষা দিয়া পতিত মনুষ্যকুলের উদ্ধার সাধন করেন। পরমপিতা পরমাত্মা দ্বারা এই জ্ঞান ও যোগ শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া পতিত মনুষ্যাত্মা ‘মরজীবা জন্ম’ লাভ করে। মনুষ্যাত্মার এই ৮৪ জন্মের উত্থান-পতনের কাহিনীকেই প্রকৃত সত্যনারায়ণের কথা বা অমর কথা বলে, কেন না অমরনাথ শিব কলিযুগী মৃত্যু লোককে সত্যযুগী অমর লোকে পরিণত করিবার জন্য এই কথা শোনান।

…‘মরজীবা জন্ম’ কথার অর্থ হইতেছে জীবন থাকিতে মরিয়া জন্ম লওয়া অর্থাৎ পুরণ বিকারী অভ্যাস ত্যাগ করিয়া নূতন দিব্য অভ্যাসে অভ্যস্থ হওয়া। অর্থাৎ পুরান দিনের কথা একেবারে ভুলিয়া যাওয়া এবং পুরান অভ্যাসগুলির পুনরাবৃত্তি না করা। ভাবটা এইরূপ, যেন আমি পুরান অভ্যাস বা পুরান দিনের হইতে মরিয়া গিয়াছি। ইহাকে ‘জীতে-জী-মরা”ও বলে। মোট কথা পুরান সব কিছু ভুলিয়া যাওয়া।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!