ভবঘুরেকথা

দেব দেবী করে পূজা গুরুচাঁদে মোর

ভক্ত শ্রীরাইচরণ গঙ্গাচর্না গাঁয়।
দয়াকরি গুরুচাঁদ তাঁর গৃহে যায়।।
হরিবর যেতে চায় প্রভু সন্নিধানে।
কিন্তু যেতে নাহি পারে পিতৃ আজ্ঞা বিনে।।
আনন্দ ভাবেন যদি যায় হরিবর।
গৃহে কভা না ফিরিবে সত্বর সত্বর।।
তাই যদি হরিবর কোথা যেতে চায়।
মনে সন্দ সে আনন্দ যেতে নাহি দেয়।।
প্রভুর অসাধ্য লীলা কে বুঝিতে পারে?
আনন্দের গৃহে কেহ পড়িলেন জ্বরে।।
আনন্দ বলিল ‘‘কেহ ওড়াকান্দী যাও।
বড়কর্তা গুরুচাঁদে সংবাদ জানাও।।
তিনি যে বিধান দিবে তাতে হবে মুক্তি।
মূল কথা করা চাই হরিচাঁদে ভক্তি।।
‘কে যায় কে যায় সবে বলাবলি করে।
কেহ বলে ‘‘পাঠাইয়া দাও হরিবরে।।’’
আনন্দে বলেন তাতে কাজ নাহি হবে।
ওড়াকান্দী গেলে হরে আর দুরে যাবে।।
অন্য কেহ যাও শ্রীঘ্র বিলম্ব না কর।
আমি বলি নীলমণি তুমি যেতে পার?
আনন্দের ছোট ভাই নাম নীলমণি।
দাদার আজ্ঞায় যাত্রা করিল তখনি।।
ওড়াকান্দী গিয়ে দেখে প্রভু বাড়ী নাই।
‘‘গিয়াছেন গঙ্গাচর্না’’ জেনে এল তাই।।
আনন্দ বলেন তবে ‘‘গঙ্গাচর্না যাও।
দেখ যদি গুরুচাঁদে সেইখানে পাও।।
তাতে নীলমণি বলে অমি পারিবনা।
এই ভাবে অস্বীকার করে সব জনা।।
অগত্যা আনন্দ তবে বলে হরিবরে।
যাবে যাও শীঘ্র কিন্তু এসো গৃহে ফিরে।।’’
আহা কি আনন্দ হল ভক্তের পরাণে।
নয়নের মণি হরি দেখিবে নয়নে।।
ত্রস্তগতি মহামতি গঙ্গাচর্না যায়।
মনোখেদে পড়ে কেদে প্রভুজীর পায়।।
আপনার কৃত গান পড়ে তার মনে।
ভাবে ভাবে ভাব যেন মিশে তার সনে।।
আমার গৌররূপে দেহ কায়,
ঘরে গুরজনার ভয়,
ফুকারিয়া কান্দিতে না পারি,
…..হরিবর সরকার
ভকতের ব্যথা প্রভু বুঝিলেন মনে।
ডাক দিয়া হরিবরে বলিল তখনে।।
‘‘কোন চিন্তা নাহি আর কর হরিবর।
আমিই বলিয়া দিব পিতাকে তোমার।।
সাধু সঙ্গে বাধা তেঁহ তোমাকে না দিবে।
মনের বাসনা তব পুরণ হইবে।।’’
হরিবর বলে কেন্দে ‘‘ওগো দয়াময়।
এসেছি বিধান নিতে পিতার আজ্ঞায়।।
প্রভু কয় দেখ চিন্তা তুমি নাহি কর আর।
গৃহে গিয়ে দেখি তুমি চলে গেছে জ্বর।।
অদ্য হেথা থাক সুখে কর নাম গান।।
কল্য তুমি নিজ গৃহে করিও প্রয়াণ।।
ফিরিবার পথে আমি দুর্গপুরে যাব।
তোমার পিতার ঠাঁই সকলি বলিব।।’’
প্রভুর বচনে তার চিত্ত শান্ত হল।
প্রেমানন্দে মেতে বলে হরি হরি বল।।
পর দিন চলিলেন আপন ভবনে।
গুরুচাঁদ রূপ সদা দেখে মনে মনে।।
গৃহে গিয়ে শুনিলেন সকলের ঠাঁই।
হরিবর গেলে অঅর জ্বর আসে নাই।।
ফুকারিয়া কান্দে সাধু ভাবে মনে মনে।
দেখেও চিনিনা আমি পরম রতনে।।
বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি যার চলে সর্ব্বস্থানে।
সামান্য মানুষ তাঁরে ভাবিয়াছি মনে।।
প্রভুর বচন সত্য নাহি হবে আন।
নিশ্চয় আসিবে হেথা প্রভু গুরুচাঁন।।
মাতা পিতা গৃহবাসী অন্যসব জনে।
ডাক দিয়া হরিবর বলিল তখনে।।
‘‘দয়া করে প্রভু মোরে দিল অজ্ঞা করি।
ফিরিবার পথে প্রভু আসিবে এ বাড়ী।।
খাদ্য দ্রব্য যাহা পার কর আয়োজন।
দয়া করে প্রভু যদি করেন ভোজন।।
সফল জীবন মোর হইবে তাহাতে।
দয়া করে কর সব তাহা ভাল মতে।।
আপনি খরিদ সাধু করিলেন দুগ্ধ।
দধি পাতে নিজে নিজে হয়ে ভাবে মুগ্ধ।।
গৃহবাসী অন্য সবে যোগ নাহি দেয়।
আসিবেন গুরুচাঁদ করেনা প্রত্যয়।।
হাটে গিয়ে হরিবর ফলমূল কিনে।
হেনকালে প্রভু এল তাহার ভবনে।।
আনন্দ বিনয় করে প্রভুজীর ঠাঁই।
প্রভু কহে ‘‘যারে চাই সেত বাড়ী নাই।।
এক কথা বলি আমি শুন মহাশয়।
হরিবরে বাঁধা তুমি দিওনা নিশ্চয়।।
সাধু সঙ্গ যদি করে তোমার নন্দন।
সেই গুণে মুক্তি পাবে বলিনু বচন।।
প্রভু যদি এই ভাবে বলিলেন কথা।
আনন্দ বসিয়া রহে হেঁট করি মাথা।।
মহাজ্ঞানী সে আনন্দ সুহ্ম বুদ্ধি রাখে।
প্রভুর বচন শুনি বলিল প্রভুকে।।
‘‘এই কথা বড় কর্তা বিশ্বাস না হয়।
কর্ম্মী বিনে কর্ম্মফল কেবা করে ক্ষয়?
সাধু সঙ্গ করে যদি পুত্র হরিবর।
তার কর্ম্মে ফল প্রাপ্তি হবেত তাহার।।
আমার উপায় তাতে কিবা হল বল?
জন্মাবধি কোন কর্ম্ম করি নাহি ভাল।।
আমার কর্ম্মের ফলে কার অধিকার?
কর্ম্মফল জানি তবে যার যার তার।।
নিতে চাও হরিবরে তারে তুমি লও।
আমার উপায় কিবা তাই বলে যাও।।
আনন্দের কথা শুনি তুষ্ট দয়াময়।
বলে যাহা বলি তাহা শুন মহাশয়।।
সুকর্ম্ম অকর্ম্ম ভবে চেনা বড় দায়।
কোন ভাবে কিযে হয় নাহি বোঝা যায়।।
নর হত্যা মহাপাপ শাস্ত্রে লিখিয়াছে।
বিশ্ববাসী সবে সেই নীতি শিখিয়াছে।।
যদি কেহ নরহত্যা করে কোন খানে।
রাজা তারে শাস্তি দেয় বাধিয়া পরানে।।
নরহত্যা দোষে দেখ নরহত্যা হয়।
কেবা পাপী কেন পাপী কার পাপ রয়?
ইহার মীমাংসা কিছু বলিব এখানে।
রাজার নাহিক পাপ শাস্তির বিধানে।।
শান্তিরক্ষা রাজধর্ম্ম শাস্ত্রের বচন।
শান্তির কারণে রাজা করেন শাসন।।
অশান্তি-আগুণ যদি জ্বলে কোন দুষ্ট।
শান্তি রক্ষা লাগি রাজা তারে করে নষ্ট।।
বিশ্বের কল্যাণ বটে তার মধ্যে রয়।
নরহত্যা দোষে রাজা তাতে দোষী নয়।।
এই কার্য্যে যে যে পালে রাজার আদেশ।
নরহত্যা দোষে স্পর্শ নাহি করে কেশ।।
বিশ্বের পালক যিনি রাজরাজেশ্বর।
সাধু-রীপী যত দেশ আছে ধরাপর।।
রাজার আদেশে তাঁরা শান্তি রক্ষা করে।
বিশ্ববাসী শান্তি পায় তাঁহাদের ধারে।।
সেই ব্রত নিতে চায় তোমার নন্দন।
তারে বাধা তুমি নাহি দিও কদাচন।।
তুমি বাধা নাহি দিলে তার ভয় নাই।
তাতে শুভ কর্ম্ম হবে আমি বলি তাই।।
‘‘করা বা করান ভাল’’ যত শুভ কাজ।
এই নীতি প্রচারিত সাধুর সমাজ।।
তোমার সাহায্যে যদি সেই হরিবর।
সাধু হতে পারে এই জাতির ভিতর।।
‘‘সাধ-করা’’ মূলে রবে তোমার সাহায্য।
সেই কর্ম্মফলে তুমি হবে বটে পূজ্য।।
শাস্ত্রী তুমি শাস্ত্রে তব বহু অধিকার।
কোন কথা শাস্ত্রমধ্যে করেছে প্রচার।।
‘‘বংশেতে সুপত্র যদি জন্মে একজন।
সেই বংশ উদ্ধার হয় তাহার কারণ।।’’
তাই বলি বাধা নাহি দিও হরিবরে।
তোমার মঙ্গল হবে বলি বারে বারে।।’’
প্রভুর বচন শুনি আনন্দ কান্দিল।
নত হয়ে প্রভুজীর চরণ বন্দিল।।
প্রভু বলে ‘‘আমি এবে গৃহে যেতে চাই।
কারে কি বলিব হরিবর বাড়ি নাই।।’’
এত বলি দয়াময় উঠিল নৌকায়।
হেনকালে এক নারী সেথা আসি কয়।।
‘‘দধি পেতে হরিবর রাখিয়াছে ঘরে।
মনে তাঁর ইচ্ছা ছিল দিতে তা তোমারে।।’’
প্রভু বলে ‘‘শীঘ্র আন খাব মাত্র তাই।
তোমরা আমার লাগি কিছু কর নাই।।’’
দধি খেয়ে প্রভু তবে বিদায় হইল।
রাউৎখামারে আসি বিশ্রাম করিল।।
হেনকালে হাট হতে এল হরিবর।
গৃহে গিয়ে শোনে বটে সব সমাচার।।
বিষম দুঃখেতে তার হৃদয় দহিল।
সঙ্গোপনে গৃহ হতে পালাইয়া গেল।।
মনে ভাবে যেই খানে হোক যত দূরে।
অবশ্য করিবে দেখা প্রভুর গোচরে।।
হেন কালে দেখা গেল রাউৎখামারে।
প্রভুর তরণী ভাসে ঘাটের উপরে।।
বালাদের ঘাটে তরী বাঁধা রহিয়াছে।
ধীরে ধীরে হরিবর এল তার কাছে।।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানে প্রভুজী উপরে।
এস্তগতি হরিবর গেল তথাকারে।।
গিয়া শোনে গৃহ মধ্যে প্রভু নিদ্রা যায়।
গান গায় হরিবর বসে বারান্দায়।।
যেই মাত্র গান শেষ করে হরিবর।
প্রভুজী বলেন কথা ঘরের ভিতর।।
‘‘গাও গাও আর গানগাও হরিবর।
গান ক্ষান্ত নাহি কর রাত্রির ভিতর।।’’
পরম আনন্দে গান করে মহাশয়।
অভুত অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিবারে পায়।।
গৃহমধ্যে দেখে যেন একটি জানালা।
সেখানে দাঁড়ায়ে আছে দ্বাদশী ললনা।।
কিবা সে রূপের আভা কহেন না যায়।
প্রতিমার মত সেথা দাঁড়াইয়া রয়।।
হরিবর মনে ভাবে কোন শ্রদ্ধা নারী।
প্রভুকে ব্যজন করে তাল বৃন্ত ধরি।।
পুনরায় গান করে পুনরায় চায়।
দেখে সেই নারী সেথা দাঁড়াইয়া রয়।।
এবার দেখিল শিরে স্বর্ণচূড়া বাঁধা।
মনে হয় ব্রজাঙ্গনা মানময়ী রাধা।।
বারে বারে তিন বার দেখে হরিবর।
তবুনা চেতনা জাগে হৃদয়ে তাহার।।
শুধু এই প্রশ্ন জাগে কেবা এই নারী।
দাঁড়ায়েছে কোন লাগি বুঝিতে না পরি।।
ঊষার কণক হাসি যবে দেখা দেয়।
সেই কালে গুরুচাঁদ তারে ডাকি কয়।।
‘‘গান ক্ষান্ত কর তুমি ওহে হরিবর।
শীঘ্র করি খুলে দাও ঘরের দুয়ার।।’’
অর্গল না ছিল বন্ধ ঘরের কপাটে।
হরিবর দ্বার খুলে তাতে অপকটে।।
দ্বার খুলে হরিবর দেখিলেন চাহি।
একা প্রভু গৃহমধ্যে আর কেহ নাহি।।
কোথাও জানালা নাহি কোথা কোন নারী।
একা প্রভু বসে খাটের উপরি।।
হতজ্ঞান হরিবর ভাবে মনে মনে।
‘‘নারী হস্তে সেবা নিতে প্রভুকে দেখিনে।।
রাত্রি কালে সেই কাল নাহি হল হুষ।
কিছুতে সে নারী নাহি হবেন মানুষ।।
দেবের দেবতা মোর প্রভু গুরুচান।
দেব দেবী সদা আসি করে তাঁর ধ্যান।।’’
এসব ভাবিয়া সাধু কান্দিতে লাগিল।
অন্তর্যাভামী গুরুচাঁদ তাঁহাকে কহিল।।
‘‘ভাগ্যগুণে অসম্ভব কিছু দেখা গেলে।
জ্ঞানী জনে সেই কথা কাহারে না বলে।।
যা’ দেখেছ ভাগ্যগুণে কারে নাহি কও।
প্রভাত হয়েছে এবে বাড়ী চলে যাও।।’’
দেব দেবী পূজা করে গুরচাঁদে মোর।
কাটিল না মহানন্দ তোর মায়া ঘোর।।
শ্রীগুরু-চরিত কথা সুধা হতে সুধা।
পিও সব ভক্তগণে যাবে ভব ক্ষুধা।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!