১৮৮৫, ২৫শে অক্টোবর
ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে
এই সকল কথা হইতেছে, এমন সময়ে ডাক্তার তঁহাকে দেখিবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। তিনি বলিতেছেন, “কাল রাত তিনটে থেকে আমার ঘুম ভেঙেছে। কেবল তোমার জন্য ভাবছিলাম, পাছে ঠাণ্ডা লেগে থাকে। আরও কত কি ভাবছিলাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাশি হয়েছে, টাটিয়েছে; শেষ রাত্রে একমুখ জল, আর যেন কাঁটা বিঁধছে।
ডাক্তার — সকালে সব খবর পেয়েছি।
মহিমাচরণ তাঁহার ভারতবর্ষ ভ্রমণের কথা বলিতেছেন। বলিলেন যে, লঙ্কাদ্বীপে ‘ল্যাফিং ম্যান্’ নাই। ডাক্তার সরকার বলিলেন, তা হবে, ওটা এন্কোয়ার করতে হবে। (সকলের হাস্য)
[ডাক্তারের ব্যবসা ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ]
ডাক্তারী কর্মের কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — ডাক্তারী কর্ম খুব উঁচু কর্ম বলে অনেকের বোধ আছে। যদি টাকা না লয়ে পরের দুঃখ দেখে দয়া করে কেউ চিকিৎসা করে তবে সে মহৎ, কাজটিও মহৎ। কিন্তু টাকা লয়ে এ-সব কাজ করতে করতে মানুষ নির্দয় হয়ে যায়। ব্যবসার ভাবে টাকার জন্য হাগা, বাহ্যের রঙ এই সব দেখা — নীচের কাজ।
ডাক্তার — তা যদি শুধু করে, কাজ খারাপ বটে। তোমার কাছে বলা গৌরব করা —
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ডাক্তারী কাজে নিঃস্বার্থভাবে যদি পরের উপকার করা হয়, তাহলে খুব ভাল।
“তা যে কর্মই লোকে করুক না কেন, সংসারী ব্যক্তির মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ বড় দরকার। ঈশ্বরে ভক্তি থাকলে লোকে সাধুসঙ্গ আপনি খুঁজে লয়। আমি উপমা দিই — গাঁজাখোর গাঁজাখোরের সঙ্গে থাকে, অন্য লোক দেখলে মুখ নিচু করে চলে যায়, বা লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু আর-একজন গাঁজাখোর দেখলে মহা আনন্দ। হয়তো কোলাকুলি করে। (সকলের হাস্য) আবার শকুনি শকুনির সঙ্গে থাকে।”
[সাধুর সর্বজীবে দয়া ]
ডাক্তার — আবার কাকের ভয়ে শকুনি পালায়। আমি বলি শুধু মানুষ কেন, সব জীবেরই সেবা করা উচিত। আমি প্রায়ই চড়ুই পাখিকে ময়দা দিই। ছোট ছোট ময়দার গুলি করে ছুঁড়ে ফেলি, আর ছাদে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি এসে খায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বাঃ, এটা খুব কথা। জীবকে খাওয়ানো সাধুর কাজ; সাধুরা পিঁপড়েদের চিনি দেয়।
ডাক্তার — আজ গান হবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — একটু গান কর না।
নরেন্দ্র গাহিতেছেন, তানপুরা সঙ্গে। অন্য বাজনাও হইতে লাগিল —
সুন্দর তোমার নাম দীন-শরণ হে,
বরিষে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ ও প্রাণরমণ হে।
এক তব নাম ধন, অমৃত-ভবন হে,
অমর হয় সেইজন, যে করে কীর্তন হে।
গভীর বিষাদরাশি নিমেষে বিনাশে,
যখনি তব নামসুধা শ্রবণে পরশে;
হৃদয় মধুময় তব নাম গানে,
হয় হে হৃদয়নাথ, চিদানন্দ ঘন হে।
গান — আমায় দে মা পাগল করে।
আর কাজ নাই মা জ্ঞান বিচারে ৷৷
(ব্রহ্মময়ী দে মা পাগল ক’রে)
(ওমা) তোমার প্রেমের সুরা, পানে কর মাতোয়ারা,
ওমা ভক্তচিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে ৷৷
তোমার এ পাগলাগারদে, কেহ হাসে কেহ কাঁদে,
কেহ নাচে আনন্দ ভরে;
ঈশা বুদ্ধ শ্রীচৈতন্য ওমা প্রেমের ভরে অচৈতন্য,
হায় কবে হব মা ধন্য, (ওমা) মিশে তার ভিতরে ৷৷
গানের পর আবার অদ্ভুত দৃশ্য। সকলেই ভাবে উন্মত্ত। পণ্ডিত পাণ্ডিত্যাভিমান ত্যাগ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন। বলছেন, “আমায় দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে।” বিজয় সর্বপ্রথমে আসনত্যাগ করিয়া ভাবোন্মত্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। তাহার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুর দেহের কঠিন অসাধ্য ব্যাধি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছেন। ডাক্তার সম্মুখে। তিনিও দাঁড়াইয়েছেন। রোগীরও হুঁশ নাই, ডাক্তারেরও হুঁশ নাই। ছোট নরেনের ভাবসমাধি হইল। লাটুরও ভাবসমাধি হইল। ডাক্তার সায়েন্স্ পড়িয়াছেন, কিন্তু অবাক্ হইয়া এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, যাঁহাদের ভাব হইয়াছে, তাঁহাদের বাহ্য চৈতন্য কিছুই নাই, সকলেই স্থির, নিস্পন্দ; ভাব উপশম হইলে কেহ কাঁদিতেছেন, কেহ কেহ হাসিতেছেন। যেন কতকগুলি মাতাল একত্র হইয়াছে।