১৮৮৫, ২৭শে অক্টোবর
স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ও মহাকারণ
শ্যাম বসু – সূক্ষ্মশরীর কেউ কি দেখিয়ে দিতে পারে? কেউ কি দেখাতে পারে যে সেই শরীর বাহিরে চলে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – যারা ঠিক ভক্ত, তাদের দায় পড়েছে তোমায় দেখাতে! কোন্ শালা মানবে আর না মনবে, তাদের দায় কি! একটা বড়লোক হাতে থাকবে, এ-সব ইচ্ছা তাদের থাকে না।
শ্যাম বসু – আচ্ছা, স্থূলদেহ, সূক্ষ্মদেহ, এ-সব প্রভেদ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – পঞ্চভূত লয়ে যে দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্মশরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণ শরীর। তন্ত্রে বলে, ‘ভগবতী তনু।’ সকলের অতীত ‘মহাকারণ’ (তুরীয়) মুখে বলা যায় না।
[সাধনের প্রয়োজন – ঈশ্বরে একমাত্র ভক্তিই সার ]
“কেবল শুনলে কি হবে? কিছু করো।
“সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি হবে? তাতে কি নেশা হয়?
“সিদ্ধি বেটে গায়ে মাখলেও নেশা হয় না। কিছু খেতে হয়। কোন্টা একচল্লিশ নম্বরের সুতো, কোন্টা চল্লিশ নম্বরের – সুতার ব্যবসা না করলে এ-সব কি বলা যায়? যাদের সুতার ব্যবসা আছে, তাদের পক্ষে অমুক নম্বরের সুতা দেওয়া কিছু শক্ত নয়! তাই বলি, কিছু সাধন কর। তখন স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ মহাকারণ কাকে বলে সব বুঝতে পারবে। যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁর পাদপদ্মে একমাত্র ভক্তি প্রার্থনা করবে।
“অহল্যার শাপ মোচনের পর শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে বললেন, তুমি আমার কাছে বর লও। অহল্যা বললেন, রাম যদি বর দিবে তবে এই বর দাও – আমার যদি শূকরযোনিতেও জন্ম হয় তাতেও ক্ষতি নাই; কিন্তু হে রাম! যেন তোমার পাদপদ্মে আমার মন থাকে।
“আমি মার কাছে একমাত্র ভক্তি চেয়েছিলাম। মার পাদপদ্মে ফুল দিয়ে হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘মা, এই লও তোমার অজ্ঞান, এই লও তোমার জ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’
“ধর্ম কিনা দানাদি কর্ম। ধর্ম নিলেই অধর্ম লতে হবে। পুণ্য নিলেই পাপ লতে হবে। জ্ঞান নিলেই অজ্ঞান লতে হবে। শুচি নিলেই অশুচি লতে হবে। যেমন যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকাবোধও আছে। যার একবোধ আছে, তার অনেকবোধও আছে। যার ভালবোধ আছে তার মন্দবোধও আছে।
“যদি কারও শূকর মাংস খেয়ে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি তাকে, সে পুরুষ ধন্য; আর হবিষ্য খেয়ে যদি সংসারে আসক্তি থাকে -”
ডাক্তার – তবে সে অধম! এখানে একটি কথা বলি – বুদ্ধ শূকর মাংস খেয়েছিল। শূকর মাংস খাওয়া আর কলিক্ (পেটে শূলবেদনা) হওয়া। এ ব্যারামের জন্য বুদ্ধ Opium (আফিং) খেত। নির্বাণ-টির্বাণ কি জান? আফিং খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকত, বাহ্যজ্ঞান থাকত না; – তাই নির্বাণ!
বুদ্ধদেবের নির্বাণ সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা শুনিয়া সকলে হাসিতে লাগিলেন; আবার কথাবার্তা চলিতে লাগিল।