ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
১৮৮৫, ১লা মার্চ
দোলযাত্রাদিবসে শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে
দোলযাত্রাদিবসে শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তিযোগ
[মহিমাচরণ, রাম, মনোমোহন, নবাই, নরেন্দ্র, মাস্টার প্রভৃতি ]

আজ ৺দোলযাত্রা, শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর জন্মদিন, ১৯শে ফাল্গুন, পূর্ণিমা, রবিবার, ১লা মার্চ, ১৮৮৫। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের মধ্যে ছোট খাটটিতে বসিয়া সমাধিস্থ। ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন – একদৃষ্টে তাঁহাকে দেখিতেছেন। মহিমাচরণ, রাম (দত্ত), মনোমোহন, নবাই চৈতন্য, মাস্টার প্রভৃতি অনেকে বসিয়া আছেন।

ভক্তেরা একদৃষ্টে দেখিতেছেন। সমাধি ভঙ্গ হইল। ভাবের পূর্ণমাত্রা। ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন – ‘বাবু’, হরিভক্তির কথা –

মহিমা – আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
বিরম বিরম ব্রহ্মন্‌ কিং তপস্যাসু বৎস ৷
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্‌ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্‌ ৷
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ৷৷

“নারদপঞ্চরাত্রে আছে। নারদ তপস্যা করছিলেন দৈববানী হল –

“হরিকে যদি আরাধনা করা যায়, তাহলে তপস্যার কি প্রয়োজন? আর হরিকে যদি না আরাধনা করা হয়, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? হরি যদি অন্তরে বাহিরে থাকেন, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? আর যদি অন্তরে বাহিরে না থাকেন, তাহলেই বা তপস্যার কি প্রয়োজন? অতএব হে ব্রহ্মন, বিরত হও, বৎস, তপস্যার কি প্রয়োজন? জ্ঞান-সিন্ধু শঙ্করের কাছে গমন কর। বৈষ্ণবেরা যে হরিভক্তির কথা বলে গেছেন, সেই সুপক্কা ভক্তি লাভ কর, লাভ কর। এই ভক্তি – এই ভক্তি-কাটারি – দ্বারা ভবনিগড় ছেদন হবে।”

[ঈশ্বরকোটি – শুকদেবের সমাধিভঙ্গ – হনুমান, প্রহ্লাদ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – জীবকোটি ও ঈশ্বরকোটি। জীবকোটির ভক্তি, বৈধভক্তি। এত উপচারে পূজা করতে হবে, এত জপ করতে হবে, এত পুরশ্চরণ করতে হবে। এই বৈধীভক্তির পর জ্ঞান। তারপর লয়। এই লয়ের পর আর ফেরে না।

“ঈশ্বরকোটির আলাদা কথা, – যেমন অনুলোম বোলুম। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে ছাদে পৌঁছে যখন দেখে, ছাদও যে জিনিসে তৈরী, – ইঁট, চুন, সুরকি, সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈরী। তখন কখন ছাদেও থাকতে পারে, আবার উঠা নামাও করতে পারে।

“শুকদেব সমাধিস্থ ছিলেন নির্বিকল্পসমাধি, – জড়সমাধি। ঠাকুর নারদকে পাঠিয়ে দিলেন, – পরীক্ষিৎকে ভাগবত শুনাতে হবে। নারদ দেখলেন জড়ের ন্যায় শুকদেব বাহ্যশূন্য – বসে আছেন। তখন বীণার সঙ্গে হরির রূপ চার শ্লোকে বর্ণনা করতে লাগলেন। প্রথম শ্লোক বলতে বলতে শুকদেবের রোমাঞ্চ হল। ক্রমে অশ্রু; অন্তরে হৃদয়মধ্যে, চিন্ময়রূপ দর্শন করতে লাগলেন। জড়সমাধির পর আবার রূপদর্শনও হল। শুকদেব ঈশ্বরকোটি।

“হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করে রামমূর্তিতে নিষ্ঠা করে থাকল। চিদঘন আনন্দের মূর্তি – সেই রামমূর্তি।

“প্রহ্লাদ কখন দেখতেন সোঽহম; আবার কখন দাসভাবে থাকতেন। ভক্তি না নিলে কি নিয়ে থাকে? তাই সে সেব্য-সেবকভাব আশ্রয় করতে হয়, – তুমি প্রভু, আমি দাস। হরিরস আস্বাদন করবার জন্য। রস-রসিকে ভাব, – হে ঈশ্বর, তুমি রস,১ আমি রসিক।

“ভক্তির আমি, বিদ্যার আমি, বালকের আমি, – এতে দোষ নাই। শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন; লোকশিক্ষা দিবার জন্য। বালকের আমির আঁট নাই। বালক গুণাতীত, – কোন গুণের বশ নয়। এই রাগ কল্লে, আবার কোথাও কিছু নাই। এই খেলাঘর কল্লে, আবার ভুলে গেল; এই খেলুড়েদের ভালবাসছে, আবার কিছুদিন তাদের না দেখলে তো সব ভুলে গেল। বালক সত্ত্ব রজঃ তমঃ কোন গুণের বশ নয়।

“তুমি ঠাকুর, আমি ভক্ত – এটি ভক্তের ভাব, এ আমি ‘ভক্তির আমি’। কেন ভক্তির আমি রাখে? তার মানে আছে। আমি তো যাবার নয়, তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ ‘ভক্তের আমি’ হয়ে।

“হাজার বিচার কর, আমি যায় না। আমিরূপ কুম্ভ। ব্রহ্ম যেন সমুদ্র – জলে জল। কুম্ভের ভিতরে বাহিরে জল। জলে জল। তবু কুম্ভ তো আছে। ওইটি ভক্তের আমির স্বরূপ। যতক্ষণ কুম্ভ আছে, আমি তুমি আছে; তুমি ঠাকুর, আমি ভক্ত; তুমি প্রভু, আমি দাস; এও আছে। হাজার বিচার কর, এ ছাড়বার জো নাই। কুম্ভ না থাকলে তখন সে এক কথা।”
………………………………
১ …রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্‌ধ্বানন্দী ভবতি।
কো হ্যোবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ। যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ। [তৈত্তিরীয়োপনিষদ্‌, ২।৭]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!