ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৬, ২৩শে এপ্রিল

প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি? হীরানন্দকে উপদেশ – নিবৃত্তিই ভাল
হীরানন্দ ঠাকুরের পায়ে হাত বুলাইতেছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন। লাটু ও আর দু-একটি ভক্ত ঘরে মাঝে মাঝে আসিতেছেন। শুক্রবার, ২৩শে এপ্রিল, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। আজ গুড্‌ ফ্রাইডে, বেলা প্রায় দুই প্রহর একটা হইয়াছে। হীরানন্দ আজ এখানেই অন্নপ্রসাদ পাইয়াছেন। ঠাকুরের একান্ত ইচ্ছা হইয়াছিল যে, হীরানন্দ এখানে থাকেন।

হীরানন্দ পায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন। সেই মিষ্ট কথা আর মুখ হাসি হাসি। যেন বালককে বুঝাইতেছেন। ঠাকুর অসুস্থ। ডাক্তার সর্বদা দেখিতেছেন।

হীরানন্দ – তা অত ভাবেন কেন? ডাক্তারে বিশ্বাস করলেই নিশ্চিন্ত। আপনি তো বালক।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – ডাক্তারে বিশ্বাস কই? সরকার (ডাক্তার) বলেছিল, “সারবে না”।

হীরানন্দ – তা অত ভাবনা কেন? যা হবার হবে।

মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি, জনান্তিকে) – উনি আপনার জন্য ভাবছেন না। ওঁর শরীররক্ষা ভক্তের জন্য।

বড় গ্রীষ্ম। আর মধ্যাহ্নকাল। খসখসের পর্দা টাঙ্গানো হইয়াছে। হীরানন্দ উঠিয়া পর্দাটি ভাল করিয়া টাঙ্গাইয়া দিতেছেন। ঠাকুর দেখিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) – তবে পাজামা পাঠিয়ে দিও।

হীরানন্দ বলিয়াছেন, তাদের দেশের পাজামা পরিলে ঠাকুর আরামে থাকিবেন। তাই ঠাকুর স্মরণ করাইয়া দিতেছেন, যেন তিনি পাজামা পাঠাইয়া দেন।

হীরানন্দের খাওয়া ভাল হয় নাই। ভাত একটু চাল চাল ছিল। ঠাকুর শুনিয়া বড় দুঃখিত হইলেন, আর বার বার তাঁহাকে বলিতেছেন, জলখাবার খাবে? এত অসুখ, কথা কহিতে পারিতেছেন না; তথাপি বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন।

আবার লাটুকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তোদেরও কি ওই ভাত খেতে হয়েছিল?

ঠাকুর কোমড়ে কাপড় রাখিতে পারিতেছেন না। প্রায় বালকের মতো দিগম্বর হইয়াই থাকেন। হীরানন্দের সঙ্গে দুইটি ব্রাহ্ম ভক্ত আসিয়াছেন। তাই কাপড়খানি এক-একবার কোমরের কাছে টানিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) – কাপড় খুলে গেলে তোমরা কি অসভ্য বল?

হীরানন্দ – আপনার তাতে কি? আপনি তো বালক।

শ্রীরামকৃষ্ণ (একটি ব্রাহ্ম ভক্ত প্রিয়নাথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া) – উনি বলেন।

হীরানন্দ এইবার বিদায় গ্রহণ করিবেন। তিনি দু-একদিন কলিকাতায় থাকিয়া আবার সিন্ধুদেশে গমন করিবেন। সেখানে তাঁহার কাজ আছে। দুইখানি সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে চার বৎসর ধরিয়া ওই কার্য করিয়াছিলেন। সংবাদপত্রের নাম, সিন্ধু টাইমস্‌ (Sind Times) এবং সিন্ধু সুধার (Sind Sudhar); হীরানন্দ ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বি. এ. উপাধি পাইয়াছিলেন। হীরানন্দ সিন্ধুবাসী। কলিকাতায় পড়াশুনা করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত কেশব সেনকে সর্বদা দর্শন ও তাঁহার সহিত সর্বদা আলাপ করিতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কালীবাড়িতে মাঝে মাঝে আসিয়া থাকিতেন।

[হীরানন্দের পরীক্ষা – প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) – সেখানে নাই বা গেলে?

হীরানন্দ (সহাস্যে) – বাঃ আর যে সেখানে কেউ নাই! আর সব যে চাকরি করি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি মাহিনা পাও?

হীরানন্দ (সহাস্যে) – এ-সব কাজে কম মাহিনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কত?

হীরানন্দ হাসিতে লাগিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এখানে থাক না?

[হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।]

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি হবে কর্মে?

হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।

হীরানন্দ আর একটু কথাবার্তার পর বিদায় গ্রহণ করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কবে আসবে?

হীরানন্দ – পরশু সোমবার দেশে যাব। সোমবার সকালে এসে দেখা করব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!