ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সেবক সন্নিকটে – হৃদয় দণ্ডায়মান

হৃদয় কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান। দর্শনমাত্র রাজপথের উপর দণ্ডের ন্যায় নিপতিত হইলেন। ঠাকুর উঠিতে বলিলেন। হৃদয় আবার হাতজোড় করিয়া বালকের মতো কাঁদিতেছেন।

কি আশ্চর্য! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও কাঁদিতেছেন! চক্ষের কোণে কয়েক ফোঁটা জল দেখা দিল! তিনি অশ্রুবারি হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন – যেন চক্ষে জল পড়ে নাই। একি! যে হৃদয় তাঁকে কত যন্ত্রণা দিয়াছিল তার জন্য ছুটে এসেছেন! আর কাঁদছেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ – এখন যে এলি?

হৃদয় (কাঁদিতে কাঁদিতে) – তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। আমার দুঃখ আর কার কাছে বলব?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সান্ত্বনার্থ সহাস্যে) – সংসারে এইরূপ দুঃখ আছে। সংসার করতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে। (মাস্টারকে দেখাইয়া) এঁরা এক-একবার তাই আসে; এসে ঈশ্বরীয় কথা দুটো শুনলে মনে শান্তি হয়। তোর কিসের দুঃখ?

হৃদয় (কাঁদিতে কাঁদিতে) – আপনার সঙ্গ ছাড়া, তাই দুঃখ!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুই তো বলেছিলি, ‘তোমার ভাব তোমাতে থাক আমার ভাব আমাতে থাক।’

হৃদয় – হাঁ, তা তো বলেছিলাম – আমি কি জানি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – আজ এখন তবে আয়, আর-একদিন তখন বসে কথা কহিব। আজ রবিবার অনেক লোক এসেছে, তারা বসে রয়েছে। এবার দেশে ধান-টান কেমন হয়েছে?

হৃদয় – হাঁ, তা একরকম মন্দ হয় নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আজ তবে আয়, আবার একদিন আসিস।

হৃদয় আবার সাষ্টাঙ্গ হইয়া প্রণাম করিল। ঠাকুর সেই পথ দিয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। সঙ্গে মাস্টার।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আমার সেবাও যত করেছে, যন্ত্রণাও তেমনি দিয়েছে! আমি যখন পেটের ব্যারামে দুখানা হাড় হয়ে গেছি – কিছু খেতে পারতুম না তখন আমায় বললে, “এই দেখ আমি কেমন খাই, তোমার মনের গুণে খেতে পারো না।” আবার বলতো, “বোকা – আমি না থাকলে তোমার সাধুগিরি বেরিয়ে যেত।” একদিন এরকম করে যন্ত্রণা দিলে যে পোস্তার উপর দাঁড়িয়ে জোয়ারের জলে দেহত্যাগ করতে গিয়েছিলুম!

মাস্টার শুনিয়া অবাক্‌! বোধ হয় ভাবিতেছেন, কি আশ্চর্য! এমন লোকের জন্য ইনি অশ্রুবারি বিসর্জন করিতেছিলেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আচ্ছা, অত সেবা করত, – তবে কেন ওর এমন হল? ছেলেকে যেমন মানুষ করে, সেইরকম করে আমাকে দেখেছে। আমি তো রাতদিন বেহুঁশ হয়ে থাকতুম, তার উপর আবার অনেকদিন ধরে ব্যামোয় ভুগেছি। ও যেরকম করে আমায় রাখত, সেইরকম আমি থাকতুম।

মাস্টার কি বলিবেন, চুপ করিয়া রহিলেন। হয়তো ভাবিতেছিলেন, হৃদয় বুঝি নিষ্কাম হইয়া ঠাকুরের সেবা করেন নাই!

কথা কহিতে কহিতে ঠাকুর নিজের ঘরে পৌঁছিলেন। ভক্তেরা প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। ঠাকুর আবার ছোট খাটটিতে বসিলেন।

-১৮৮৪, ২৬শে অক্টোবর-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চতুর্ত্রিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!