ভবঘুরেকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

মণিমোহনকে শিক্ষা – ব্রহ্মদর্শনের লক্ষণ – ধ্যানযোগ 

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মশারির ভিতর ধ্যান করিতেছেন। রাত ৭টা-৮টা হইবে। মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন – ও তাঁহার একটি বন্ধু হরিবাবু। আজ সোমবার, ২০শে অগস্ট, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, শ্রাবণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি।

আজকাল এখানে হাজরা থাকেন, রাখাল প্রায়ই থাকেন – কখনও অধরের বাড়ি গিয়া থাকেন। নরেন্দ্র ভবনাথ, অধর, বলরাম, রাম, মনোমোহন, মাস্টার প্রভৃতি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আসিয়া থাকেন।

হৃদয় ঠাকুরের অনেক সেবা করিয়াছিলেন। দেশে তাঁহার অসুখ শুনিয়া ঠাকুর বড়ই চিন্তিত। তাই একজন ভক্ত শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যের হাতে আজ দশটি টাকা দিয়াছেন হৃদয়কে পাঠাইতে। দিবার সময় ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ভক্তটি একটি চুমকি ঘটি আনিয়াছেন – ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন, “এখানকার জন্য একটি চুমকি ঘটি আনবে, ভক্তেরা জল খাবে।”

মাস্টারের বন্ধু হরিবাবুর প্রায় এগার বৎসর হইল পত্নীবিয়োগ হইয়াছে। আর বিবাহ করেন নাই। মা-বাপ, ভাই-ভগ্নী সকলেই আছেন। তাঁহাদের উপর স্নেহ-মমতা খুব করেন ও তাঁহাদের সেবা করেন। বয়ঃক্রম ২৮।২৯। ভক্তেরা আসিয়া বসিলেই ঠাকুর মশারি হইতে বাহির হইলেন। মাস্টার প্রভৃতি সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের মশারি তুলিয়া দেওয়া হইল। তিনি ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন ও কথা কহিতেছেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – মশারির ভিতর ধ্যান করছিলাম। ভাবলাম, কেবল একটা রূপ কল্পনা বই তো না, তাই ভাল লাগল না। তিনি দপ্‌ করে দেখিয়ে দেন তো হয়। আবার মনে করলাম, কেবা ধ্যান করে, কারই বা ধ্যান করি।

মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ। আপনি বলেছেন যে, তিনিই জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন – যে ধ্যান করছে সেও তিনি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর তিনি না করালে তো আর হবে না। তিনি ধ্যান করালে তবেই ধ্যান হবে। তুমি কি বল?

মাস্টার – আজ্ঞে, আপনার ভিতর ‘আমি’ নাই তাই এইরূপ হচ্ছে। যেখানে ‘আমি’ নাই সেখানে এরূপই অবস্থা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু “আমি দাস, সেবক” এটুকু থাকা ভাল। যেখানে “আমি সব কাজ করছি” বোধ, সেখানে “আমি দাস, তুমি প্রভু” এ-ভাব খুব ভাল। সবই করা যাচ্ছে, সেব্য-সেবক ভাবে থাকাই ভাল।

মণিমোহন পরব্রহ্ম কি তাই সর্বদা চিন্তা করেন। ঠাকুর তাহাকে লক্ষ্য করিয়া আবার কহিতেছেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ – ব্রহ্ম আকাশবৎ। ব্রহ্মের ভিতর বিকার নাই। যেমন অগ্নির কোন রঙই নাই। তবে শক্তিতে তিনি নানা হয়েছেন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ – এই তিনগুণ শক্তিরই গুণ। আগুনে যদি সাদা রঙ ফেলে দাও সাদা দেখাবে। যদি লাল রঙ ফেলে দাও লাল দেখাবে। যদি কালো রঙ ফেলে দাও তবে আগুন কালো দেখাবে। ব্রহ্ম – সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনগুণের অতীত। তিনি যে কি, মুখে বলা যায় না। তিনি বাক্যের অতীত। নেতি নেতি করে করে যা বাকি থাকে, আর যেখানে আনন্দ সেই ব্রহ্ম।

“একটি মেয়ের স্বামী এসেছে; অন্য অন্য সমবয়স্ক ছোকরাদের সহিত বাহিরের ঘরে বসেছে। এদিকে ওই মেয়েটি ও তার সমবয়স্কা মেয়েরা জানালা দিয়ে দেখছে। তারা বরটিকে চেনে না – ওই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করছে, ওইটি কি তোর বর? তখন সে একটু হেসে বলছে, না। আর একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না।

আবার একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না। শেষে তার স্বামীকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলে, ওইটি তোর বর? তখন সে হাঁও বললে না, নাও বললে না – কেবল একটু ফিক্‌ করে হেসে চুপ করে রইল। তখন সমবয়স্কারা বুঝলে যে, ওইটিই তার স্বামী। যেখানে ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান সেখানে চুপ।”

[সৎসঙ্গ – গৃহীর কর্তব্য ]

(মণির প্রতি) – “আচ্ছা, আমি বকি কেন?”

মণি – আপনি যেমন বলেছেন, পাকা ঘিয়ে যদি আবার কাঁচা লুচি পড়ে তবে আবার ছ্যাঁক কলকল করে। ভক্তদের চৈতন্য হবার জন্য আপনি কথা কন।

ঠাকুর মাস্টারের সহিত হাজরা মহাশয়ের কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সতের কি স্বভাব জানো? সে কাহাকেও কষ্ট দেয় না – ব্যতিব্যস্ত করে না। নিমন্ত্রণ গিয়েছে, কারু কারু এমন স্বভাব – হয়তো বললে, আমি আলাদা বসব। ঠিক ঈশ্বরে ভক্তি থাকলে বেতালে পা পড়ে না – কারুকে মিথ্যা কষ্ট দেয় না।

“আর অসতের সঙ্গ ভাল না। তাদের কাছ থেকে তফাত থাকতে হয়। গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। (মণির প্রতি) তুমি কি বল?”

মণি – আজ্ঞে, অসৎসঙ্গে মনটা অনেক নেমে যায়। তবে আপনি বলেছেন, বীরের কথা আলাদা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিরূপ?

মণি – কম আগুনে একটু কাঠ ঠেলে দিলে নিবে যায়। আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে তখন কলাগাছটাও ফেলে দিলে কিছু হয় না। কলাগাছ পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়।

ঠাকুর মাস্টারের বন্ধু হরিবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।

মাস্টার – ইনি আপনাকে দর্শন করতে এসেছেন। এঁর অনেকদিন পত্নীবিয়োগ হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি কি কর গা?

মাস্টার – একরকম কিছুই করেন না। তবে বাড়ির ভাই-ভগিনী, বাপ-মা এদের খুব সেবা করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – সে কি? তুমি যে “কুমড়োকাটা বঠ্‌ঠাকুর” হলে। তুমি না সংসারী, না হরিভক্ত। এ ভাল নয়। এক-একজন বাড়িতে পুরুষ থাকে, – মেয়েছেলেদের নিয়ে রাতদিন থাকে, আর বাহিরের ঘরে বসে ভুড়ুর ভুড়ুর করে তামাক খায়, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে। তবে বাড়ির ভিতরে কখনও গিয়ে কুমড়ো কেটে দেয়।

মেয়েদের কুমড়ো কাটতে নাই, তাই ছেলেদের দিয়ে তারা বলে পাঠায়, বঠ্‌ঠাকুরকে ডেকে আন। তিনি কুমড়োটা দুখানা করে দিবেন। তখন সে কুমড়োটা দুখানা করে দেয়, এই পর্যন্ত পুরুষের ব্যবহার। তাই নাম হয়েছে “কুমড়োকাটা বঠ্‌ঠাকুর”।

“তুমি এ-ও কর – ও-ও কর। ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে সংসারের কাজ কর। আর যখন একলা থাকবে তখন পড়বে ভক্তিশাস্ত্র – শ্রীমদ্ভাগবত বা চৈতন্যচরিতামৃত – এই সমস্ত পড়বে।”

রাত প্রায় দশটা হয় এখনও ৺কালীঘর বন্ধ হয় নাই। মাস্টার বৃহৎ উঠানের মধ্যে দিয়া রাম চাটুজ্যে মহাশয়ের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে প্রথমে ৺রাধাকান্তের মন্দিরে, পরে মা-কালীর মন্দিরে গিয়া প্রণাম করিলেন। চাঁদ উঠিয়াছে, শ্রাবণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া – প্রাঙ্গণ, মন্দিরশীর্ষ, অতি সুন্দর দেখাইতেছে।

ঠাকুর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া মাস্টার দেখিলেন ঠাকুর খাইতে বসিতেছেন। দক্ষিণাস্যে বসিলেন। খাদ্যের মধ্যে একটু সুজির পায়েস আর দুই-একখানি লুচি। কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টার ও তাঁহার বন্ধু ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। আজই কলিকাতায় ফিরিবেন।

-১৮৮৩, ২০শে অগস্ট-

………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চর্তুদশ অধ্যায় : অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!