ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীশ্রীরথযাত্রা বলরাম-মন্দিরে
১৮৮৫, ১৩ই জুলাই
পূর্ণ, ছোট নরেন, গোপালের মা

শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাড়ির বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। (৩০শে আষাঢ়, ১২৯২) আষাঢ় শুক্লা প্রতিপদ, সোমবার, ১৩ই জুলাই, ১৮৮৫, বেলা ৯টা।

কল্য শ্রীশ্রীরথযাত্রা। রথে বলরাম ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। বাড়িতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বিগ্রহের নিত্য সেবা হয়। একখানি ছোট রথও আছে, – রথের দিন রথ বাহিরের বারান্দায় টানা হইবে।

ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কাছে নারাণ, তেজচন্দ্র, বলরাম ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা। পূর্ণ সম্বন্ধে কথা হইতেছে। পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কাছে নারাণ, তেজচন্দ্র, বলরাম ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা। পূর্ণ সম্বন্ধে কথা হইতেছে। পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আচ্ছা, সে (পূর্ণ) কোন পথ দিয়ে এসে দেখা করবে? – দ্বিজকে ও পূর্ণকে তুমিই মিলিয়ে দিও।

“এক সত্তার আর এক বয়সের লোক, আমি মিলিয়ে দিই। এর মানে আছে। দুজনেরই উন্নতি হয়। পূর্ণর কেমন অনুরাগ দেখেছ।”

মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ, আমি ট্রামে করে যাচ্ছি, ছাদ থেকে আমাকে দেখে, রাস্তার দিকে দৌড়ে এল, – আর ব্যাকুল হয়ে সেইখান থেকেই নমস্কার করলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সাশ্রুনয়নে) – আহা! আহা! – কি না ইনি আমার পরমার্থের (পরমার্থলাভের জন্য) সংযোগ করে দিয়েছেন। ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল না হলে এইরূপ হয় না।

[পূর্ণের পুরুষত্তা, দৈবস্বভাব, – তপস্যার জোরে নারায়ণ সন্তান ]

“এ তিনজনের পুরুষসত্তা – নরেন্দ্র, ছোট নরেন আর পূর্ণ। ভবনাথের নয় – ওর মেদী ভাব (প্রকৃতিভাব)।

“পূর্ণর যে অবস্থা, এতে হয় শীঘ্র দেহনাশ হবে – ঈশ্বরলাভ হল, আর কেন; – বা কিছুদিনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে বেরুবে।

“দৈবস্বভাব – দেবতার প্রকৃতি। এতে লোকভয় কম থাকে। যদি গলায় মালা, গায়ে চন্দন, ধূপধুনার গন্ধ দেওয়া যায়; তাহলে সমাধি হয়ে যায়! – ঠিক বোধ হয়ে যায় যে, অন্তরে নারায়ণ আছেন – নারায়ণ দেহধারণ করে এসেছেন। আমি টের পেয়েছি।”

[পূর্বকথা – সুলক্ষণা ব্রাহ্মণির সমাধি – রণজিতের ভগবতী কন্যা ]

“দক্ষিণেশ্বরে যখন আমার প্রথম এইরুপ অবস্থা হল, কিছুদিন পরে একটি ভদ্রঘরে বামুনের মেয়ে এসেছিল। বড় সুলক্ষণা। যাই গলায় মালা আর ধূপধুনা দেওয়া হল অমনি সমাধিস্থ। কিছুক্ষণ পরে আনন্দ, – আর ধারা পড়তে লাগল। আমি তখন প্রণাম করে বললুম, ‘মা, আমার হবে?’ তা বললে, ‘হাঁ!’ তবে পূর্ণকে আর একবার দেখা। তা দেখবার সুবিধা কই?

“কলা বলে বোধ হয়। কি আশ্চর্য অংশ শুধু নয়, কলা!

“কি চতুর! – পড়াতে নাকি খুব। – তবে তো ঠিক ঠাওরেছি!

“তপস্যার জোরে নারায়ণ সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ও-দেশে যাবার রাস্তায় রণজিত রায়ের দীঘি আছে। রণজিত রায়ের ঘরে ভগবতী কন্যা হয়ে জন্মেছিলেন। এখনও চৈত্রমাসে মেলা হয়। আমার বড় যাবার ইচ্ছা হয়! – আর এখন হয় না।

“রণজিত রায় ওখানকার জমিদার ছিল। তপস্যার জোরে তাঁকে কন্যারূপে পেয়েছিল। মেয়েটিকে বড়ই স্নেহ করে। সেই স্নেহের গুণে তিনি আটকে ছিলেন, বাপের কাছ ছাড়া প্রায় হতেন না। একদিন সে জমিদারির কাজ করছে, ভারী ব্যস্ত; মেয়েটি ছেলের স্বভাবে কেবল বলছে, ‘বাবা, এটা কি; ওটা কি।’ বাপ অনেক মিষ্টি করে বললে – ‘মা, এখন যাও, বড় কাজ পড়েছে।’ মেয়ে কোনমতে যায় না। শেষে বাপ অন্যমনস্ক হয়ে বললে, ‘তুই এখান থেকে দূর হ’। মা তখন এই ছুতো করে বাড়ি থেকে চলে গেলেন। সেই সময় একজন শাঁখারী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডেকে শাঁখা পরা হল। দাম দেবার কথায় বললেন, ঘরের অমুক কুলুঙ্গিতে টাকা আছে, লবে। এই বলে সেখান থেকে চলে গেলেন, আর দেখা গেল না। এদিকে শাঁখারী টাকার জন্য ডাকাডাকি করছে। তখন মেয়ে বাড়িতে নাই দেখে সকলে ছুটে এল। রণজিত রায় নানাস্থানে লোক পাঠালে সন্ধান করবার জন্য। শাঁখারীর টাকা সেই কুলুঙ্গিতে পাওয়া গেল। রণজিত রায় কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় লোকজন এসে বললে, যে, দীঘিতে কি দেখা যাচ্ছে। সকলে দীঘির ধারে গিয়ে দেখে যে শাঁখাপরা হাতটি জলের উপর তুলেছেন। তারপর আর দেখা গেল না। এখনও ভগবতীর পূজা ওই মেলার সময় হয় – বারুণীর দিনে।

(মাস্টারকে) – “এ সব সত্য।”

মাস্টার – আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – নরেন্দ্র এখন এ-সব বিশ্বাস করে।

“পূর্ণর বিষ্ণুর অংশে জন্ম। মানসে বিল্বপত্র দিয়ে পূজা করলুম, তা হল না; – তুলসী-চন্দন দিলাম, তখন হল!

“তিনি নানারূপে দর্শন দেন। কখন নররূপে, কখন চিন্ময় ঈশ্বরীয় রূপে। রূপ মানতে হয়। কি বল?”

মাস্টার – আজ্ঞা, হাঁ!

[গোপালের মার প্রকৃতিভাব ও রূপদর্শন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – কামারহাটির বামনী (গোপালের মা) কত কি দেখে! একলাটি গঙ্গার ধারে একটি বাগানে নির্জন ঘরে থাকে, আর জপ করে। গোপাল কাছে শোয়! (বলিতে বলিতে ঠাকুর চমকিত হইলেন)। কল্পনায় নয়, সাক্ষাৎ! দেখলে গোপালের হাত রাঙা! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ায়! – মাই খায়! – কথা কয়! নরেন্দ্র শুনে কাঁদলে!

“আমি আগে অনেক দেখতুম। এখন আর ভাবে তত দর্শন হয় না। এখন প্রকৃতিভাব কম পড়ছে। বেটাছেলের ভাব আসছে। তাই ভাব অন্তরে, বাহিরে তত প্রকাশ নাই।

“ছোট নরেনের পুরুষভাব, – তাই মন লীন হয়ে যায়। ভাবাদি নাই। নিত্যগোপালের প্রকৃতিভাব। তাই খ্যাঁচা ম্যাঁচা; – ভাবে তার শরীর লাল হয়ে যায়।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!